চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

জীবন এত সুন্দর হবে কখনো ভাবিনি

সালমা আনজুম লতা

১৬ মার্চ, ২০২১ | ১২:৩৬ অপরাহ্ণ

আজ ১৪ মার্চ। ১৯৮৪ সালের ঠিক এই দিনে মেজর মহিউদ্দিন আহমেদের সাথে আমার জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করেছিলাম। আজ সেই ইনিংসের ৩৭ বছর পূর্ণ হলো। আলহামদুলিল্লাহ !

যখন থেকে বিয়ের বয়স হয়েছে তখন থেকে মনে মনে স্বামী হিসেবে প্রথম পছন্দ করতাম কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। কী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন মানুষ, সুন্দর তাদের বাচনভঙ্গি, ছাত্র-ছাত্রীদের আকর্ষণ করার কী অদ্ভুত ক্ষমতা ! বিনা কারণেই এক নম্বর অপছন্দ ছিল ডাক্তার, দুই নম্বর অপছন্দ ছিল আর্মি অফিসার। বিয়ের অল্প কয়দিন পর মেজর সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা আপনি আর্মিতে না গেলে কি করতেন ? উনি বললেন, মেডিকেল এ পড়ার খুব ইচ্ছে ছিল। ডাক্তার হতে চেয়েছিলাম। আমি মুচকি হাসলাম।

একেবারে অজানা-অচেনা, এমনকি আমার অদেখা একজন মানুষের সাথে কেমন করে এতটা বছর বসবাস করলাম ? ভাবলে অবাকই লাগে, যেখানে খাওয়ার মিল নেই, রুচির মিল নেই, পছন্দের মিল নেই। দুজনের বয়সের বেশ ব্যবধান। মাত্র ১২ দিনের নোটিশেই আমাদের বিয়ের তারিখ ঠিক হয়েছিল। এত অল্প সময়ে খোঁজখবর নিয়ে যেটুকু বোঝা গেল তাতে আমার ভাইদের দু’একজনের এ বিয়েতে মত ছিলনা। কারণ পাত্র মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ তখন থেকেই নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন, প্রতিদিন কুরআন মাজীদ তিলওয়াত করেন, তাহাজ্জুদও পড়েন ।

আর আমি ? শবেবরাত, রামাদান, কঠিন পরীক্ষা ছাড়া নামাজ পড়িনা। আমার শ্বশুর বাড়িতে অনেকেই পর্দা মেনে চলেন। আমাদের বাড়িতে মা চাচীরা বোরখা পরলেও আমি আধুনিক মেয়েদের মতই পোষাক পরি। ওই সময়ই মাঠে গিয়ে ক্রিকেট খেলা দেখি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গাই। ভাইদের ভয় ছিল আমি ওই পরিবারে গিয়ে এডজাস্ট করতে পারবো না। আমাদের মুরুব্বী স্থানীয়রা মেজর সাহেবকে দেখে খুবই পছন্দ করেছিলেন। তার চেয়ে বেশি পছন্দ করেছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুরকে। আমার শ্বশুর ১৯২৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছিলেন। বিভিন্ন স্কুলে ৪১ বছর শিক্ষকতা করেছেন। সত্যিকারের একজন ভাল মানুষ বলতে যা বোঝায় আমার শ্বশুর তাই ছিলেন। সেদিন আমার সহজ সরল মায়ের একটাই কথা ছিল, পাত্র নামাজি। এই পাত্রের সাথেই বিয়ে দাও। আব্বা অসুস্থ ছিলেন। তাই আমার মায়ের মতামতকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন আমার বড় আট ভাইবোন। তাড়াহুড়োর মধ্যেও বেশ জাঁকজমক ভাবেই বিয়ে হয়ে গেল। বাড়ির শেষ বিয়ে বলে কথা। মহিউদ্দিন সাহেব বিয়ের দিন যোহর এবং আসর নামাজ আদায় করলেন বিয়ের স্টেজে শেরওয়ানী পরেই। চতুর্দিকে আত্মীয় আর বন্ধুদের কানাঘুষা শুরু হয়ে গেলো। আমি নির্বাক। বিদায় নেয়ার সময় আব্বা আমার মাথায় হাত রেখে শুধু একটা কথাই বল্লেন, ‘আমি তোমার জন্য দুআ করছি, তুমি রাজরানী হবে ।’

আমি নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা পর্যন্ত সারা পথ অজানা আশংকা আর চোখের পানি ফেলতে ফেলতে প্রবেশ করলাম নতুন সংসারে। ফাল্গুনের শেষ দিন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাকে বরণ করতে করতে মাগরিবের আজান পড়ে গেল। যে যার মত চলে গেলেন নামাজ পড়তে। জোরে জোরে ‘ইকামত’ দিয়ে মেজর সাহেবও দাঁড়িয়ে পড়লেন নামাজে। আমি নতুন বউ কিংকর্তব্যবিমূঢ়। বিয়ের চারদিন পর ১৭ই মার্চ বউভাত হল তৎকালীন বিডিআর অফিসার্স মেসে। নিয়মমাফিক বাবার বাড়িতে গেলাম। যাকে বলে ‘ফিরানি’। চারদিন পর নখের নেইলপলিশ তুলে সেদিন থেকে শুরু করলাম নামাজ। নামাজ দিয়ে শুরু হলো আমাদের দুজনের প্রথম বোঝাপড়া। আলহামদুলিল্লাহ !

ভাড়া বাড়িতে ছিলাম তিন মাস। এরপর পিলখানায় সরকারি বাসা পেলাম। মেজর সাহেব ফজরের নামাজ পড়ে চলে যান পিটিতে। তারপর অফিস। বিকেলে গেমস। বলতে গেলে সারাদিন বাসায় আমি একা। গান শুনবো কিংবা ম্যাগাজিন পড়বো তার উপায় নেই। শেলফ ভর্তি মারেফুল কোরআন, বেহেশতি জেওর আর কিমিয়ায়ে সা’দাত। বাসায় বিচিত্রা বা চিত্রালী রাখা হত না। আমার এই জীবনটা যে আমারই ছিল ওই সময় তা যেন ভুলেই গিয়েছিলাম। মনে হত অন্য মানুষের জীবনটাই আমি কাটিয়ে যাচ্ছি।

আমি বাবার বাড়িতে ছিলাম সর্বকনিষ্ঠ। আদরে আদরে যাকে বলে বাঁদর। চূড়ান্ত অগোছালো। সবরকম অনিয়মই ছিল আমার নিয়ম। দেরি করে ঘুম থেকে ওঠা, কলেজ থেকে ফিরে জুতা ড্রইং রুমে তো ব্যাগ বেডরুমে। বিয়ের পর দেখি মেজর সাহেব আমার ঠিক উল্টো। তখন সংসারকে মনে হতো জেলখানা, ওনার নিয়মনীতিকে মনে হতো সামরিক শাষন। কোথায় এসে পড়লাম আমি ? অফিস থেকে ওনার ফেরার সময় হলেই আমি তটস্থ থাকতাম। আর বারবার পর্যবেক্ষণ করতাম কোথাও ভুল করেছি কিনা।

কি ব্যাপার? পেপারটা এখানে কেন? পেপারের ২য় পাতা কোথায়?
জ্বী, মানে বেডরুমে।
ঠাণ্ডা পানির বোতল টেবিলে কেন?
এইতো ,একটু আগেই রেখেছি।
বাথরুমের ফ্লোরে এত লম্বা লম্বা চুল কার?
মনে মনে বলি, কার আবার ? আমার ।
কি অদ্ভুত প্রশ্নরে বাবা?

এত কঠিন শাষনের মধ্যেই এই মানুষটিকে আস্তে আস্তে ভালবাসতে শুরু করেছিলাম। তার জন্য আমার প্রয়োজন হয়েছিল সময়, ওনার প্রতি শ্রদ্ধা, বোঝাপড়া। ওনার ইস্পাত কঠিন ব্যক্তিত্বের মাঝেও অনেক গুণ ছিল । অত্যন্ত সৎ, নামাজি, চরিত্রবান, কঠোর পরিশ্রমী, আন্তরিক, কেয়ারিং ছিলেন। আমি খুব রোমান্টিক, উনি চূড়ান্ত বেরসিক। আমি চঞ্চল, উনি গম্ভীর। আমি গল্প করতে ভালবাসি। উনি স্বল্পভাষী। কিন্তু কোথায় যেন একটা গভীর টান, একটা মায়া, অকৃত্রিম ভালবাসা। তা না হলে এমন একজন মানুষের সাথে এতদিন থাকলাম কি করে ?

বিয়ের এক বছরের মধ্যেই বড় ছেলে শাহরিয়ার নাফীসের জন্ম হলো। ওর ডাক নাম ‘আবীর ‘। বিয়ের অনেক আগেই এই নামটা পছন্দ করে রেখেছিলাম। ভেবেছিলাম ছেলের বাবা নামটা রাখতে রাজী হবেন না। কারণ সংসারের সবকিছুই চলতো মেজর সাহেবের পছন্দে। “আবীর” নামটা উনার পছন্দ হওয়াতে আমি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলাম। আমি পরপর তিন ছেলের মা হলাম। কাছ থেকে দেখলাম একজন অসাধারণ বাবাকে। আমার দেখা একজন শ্রেষ্ঠ বাবা হলেন মেজর মহিউদ্দিন সাহেব। কোন পিতা সন্তানদের এতটা ভালবাসতে পারেন সেটা ওনাকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।

মাঝখানে চলে গেল অনেকগুলো বছর। শুধু আমাদের সুখের জন্য সরকারি চাকরির পরও আরো ১৫ বছর প্রাইভেট চাকরি করলেন। নিজে কষ্ট করে ছেলেদের ভাল স্কুলে পড়ালেন। আমি পেলাম স্থায়ী ঠিকানা। নিজের স্বপ্নের বাড়ি “কাশবন”। ছেলেদের লেখাপড়া শিখিয়েছি , ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছি। সত্যিকারের মানুষ কতটুকু হয়েছে জানিনা। তবে আমার মনে হয় আমার আব্বার দুআ আল্লাহ কবুল করেছেন। আমি রাজরানী হতে পেরেছি। ২০১২ সালে দুজন একসাথে হজ করেছি। সুখী হওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন হয়না। মক্কায় গিয়েই প্রথম অনুভব করেছি আমরা জন্ম জন্মান্তরের প্রেমিক প্রেমিকা।

দাম্পত্য জীবন মানেই ত্যাগ, ছাড়, বোঝাপড়া। আমি চেষ্টা করেছি। আমার নিজের অবস্থান থেকে সরে এসেছি ৯০% পর্যন্ত। সেকারণে মেজর সাহেবকে ছাড় দিতে হয়নি। আমি এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি। ছেলেরা কোন স্কুলে পড়বে, বাড়িটা কেমন হবে, গাড়ি কোন রংয়ের কিনবো এমনকি রুমের ফার্নিচার কোথায়, কিভাবে রাখবো সবকিছুতে ওনার পছন্দটাকেই প্রাধান্য দিয়েছি সারাজীবন। আমি বিশ্বাস করি ভালবাসা যেখানে গভীর নত হওয়া সেখানে গৌরবের। কেউ কেউ বলেন, স্বামী মেজর হলে স্ত্রীরা হন কর্নেল। কিন্তু আমার পদোন্নতি হয়নি। আমি ৩৭ বছর ধরেই সৈনিকের ভূমিকা পালন করে ‘ জ্বি স্যার, জ্বি স্যার ‘ করে যাচ্ছি।

আমার পরম বন্ধু ,আমার বেটার হাফ প্রায়ই বিটার হাফ হয়ে যান সেটা না বল্লে আমার লেখাটাই অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমি বেড়াতে পছন্দ করি। উনি একেবারেই না। আমি লং ড্রাইভে গিয়ে ওনার হাতে হাত রেখে গান শুনতে চাই। মেজর সাহেব গাড়ি চালাবার সময় আরো সংযত। নো গান, নো গল্প। আমি টক খেতে ভীষণ পছন্দ করি। উনি টক খাবারকে কোন খাবারই মনে করেন না।

আমাদের দাম্পত্য জীবনে ম্যাচিং নেই বললেই চলে। শুধু কন্ট্রাস্ট আর কন্ট্রাস্ট। শুধু কি তাই ? যৌবনেও উনি কখনো বলেননি তোমার গানের গলা ভারী মিষ্টি, তোমার লেখালেখি অসাধারণ ! কিংবা তোমার গভীর কাজল কালো চোখের সাগরে আমি ডুব দিতে চাই। উনি ওনার মত করেই ভালবেসেছেন। মেজর সাহেবের ভালবাসার ভাষা বড় বিচিত্র ! আমার কথা শুনে কেউ কেউ বলে আমি নাকি বাড়াবাড়ি করি। আমি নাকি ভালবাসার ট্যাবলেট খেয়েছি। হতেও পারে।

ব্যক্তিগত জীবনে আমরা তিন পুত্রের জনক জননী। দুজন নাতি নাতনি আছে। সুখ দুঃখ নিয়েই আমাদের দিন রাত্রি। বাকি জীবন এমনি করেই কাটিয়ে দিতে চাই। আমাদের সময়টি টোয়েন্টি ক্রিকেট ছিলনা, ওয়ানডে ও কম জনপ্রিয় ছিল। টেস্ট ক্রিকেটই ছিল উপভোগ্য। আমাদের দাম্পত্য জীবনের ইনিংসটাকেও টেস্ট ক্রিকেটের মতই টেনে নিয়ে যেতে চাই অনেকদূর ।

পরম করুণাময়ের কাছে চাই আমাদের সুস্থ্য ও দীর্ঘজীবন। আরও একজন পুত্রবধূ ও বেশ কয়েকজন নাতি নাতনি দিয়ে ভরে যাক আমাদের সুখের সংসার।

সবশেষে মেজর মহিউদ্দিন সাহেবের (আবীরের আব্বা) উদ্দেশ্যে দুটো কথা বলতে চাই। ৩৭ বছরেও যা বলতে পারিনি, যা বলা হয়নি। হয়তো বলা যায়ও না।

না বলা কথায় আমি তোমাকে চাই ,
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই ,
এ জীবন ভালবেসে আমি তোমাকে চাই ,
শেষপর্যন্ত আমি তোমাকেই চাই ।

লেখক: সালমা আনজুম লতা, অ্যারিযোনা, যুক্তরাষ্ট্র ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট