চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

ভ্যাকসিন প্রয়োগে চাই ন্যায়ভিত্তিক সুষম বণ্টন

ডা. মো. সাজেদুল হাসান

৬ জানুয়ারি, ২০২১ | ১২:৫৫ অপরাহ্ণ

কোভিড বিপন্ন পৃথিবীকে আশা জাগিয়েছে ভ্যাকসিন। এখন প্রয়োজন এর ন্যায়ভিত্তিক সুষম বন্টন। এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণে হার্ড ইমিউনিটি গড়তে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার অন্তত ৮০ ভাগের কোভিড টিকা গ্রহণ করতে হবে। সে হিসাবে ৬ শ’ কোটি লোকের জন্য ১২শ কোটি ডোজ টিকার প্রয়োজন। এটি এককালীন হিসাব। বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত নন এই টিকা কতদিন পর্যন্ত মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারে। যদি বছর বছর এই টিকা নিতে হয় তাহলে প্রতি বছরই সমপরিমাণ টিকার প্রয়োজন হবে। ইতোমধ্যে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত ফাইজার, মডার্না এবং অক্সফোর্ড সব মিলিয়ে বর্তমান বছরের মধ্যে ৫শ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের ঘোষণা দিয়েছে।

 

কিন্তু প্রভাবশালী ধনী দেশগুলি এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল ভ্যাকসিন এলায়েন্স (জিএভিআই) কোভ্যাক্স প্রোগ্রামের আওতায় ৭২৫ কোটি ডোজ টিকা অগ্রিম কিনে নিয়েছে। তাহলে বাংলাদেশের মত নিন্মমধ্য আয়ের দেশগুলোর সুযোগ কোথায়? সরকার অবশ্য অক্সফোর্ড-এস্ট্রাজেনেকার টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ভারতের সেরাম ইন্সটিটিউটের সাথে একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছে। চুক্তি অনুযায়ী সেরাম প্রতিমাসে ৫০ লক্ষ করে ৬ মাসে ৩ কোটি ডোজ টিকা সরবরাহ করবে এবং ফেব্রুয়ারির শুরুতেই তার প্রথম চালান আসার কথা। কিন্তু সেটি বাস্তবায়নে কিছু অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে যদিও আশার কথা আজ বাংলাদেশ ও ভারতের উচ্চ পর্যায় হতে টিকা প্রাপ্তির নিশ্চয়তার সংবাদ পরিবেশন করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশ যদি দ্রুত কোনো উৎস হতে টিকা সংগ্রহ না করতে পারে তাহলে তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

(১) দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত কোভিড সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকবে এবং সরকারি এবং ব্যক্তিগণ চিকিৎসা ব্যয় আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পাবে।

(২) তৈরি পোশাকশিল্পের বৈদেশিক ক্রেতারা নিরুৎসাহিত হবে এবং রপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

(৩) বৈদেশিক শ্রমবাজার সংকুচিত হবে। (৪) আন্তর্জাতিক ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা বজায় থাকবে। ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। 

সুতরাং ভ্যাকসিন বাবদ সরকারের যে ব্যয় হবে তার আর্থিক, সামাজিক ও মানবিক মূল্য অনেক বেশি। আশার কথা সরকার যথাসময়ে বিষয়টির গুরুত্ব অনুভব করেছে এবং সে অনুযায়ী আর্থিক বরাদ্দ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় সরকারের সদিচ্ছা ও অর্থবরাদ্দই যথেষ্ট নয়, আরও কিছু বিষয়ে দুরদর্শী সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে।

করণীয়ঃ
(১) টিকা সংগ্রহের অন্যান্য উৎসগুলির দ্রুত সন্ধান করে যোগাযোগ স্থাপন ও আগাম ক্রয় নিশ্চিত করতে হবে।

(২) বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার কোভ্যাক্স কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশের জন্য ভর্তুকিমূল্যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ৬ কোটি ডোজ টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে।

(৩) চীনের আনতই জিফেই এবং সম্ভাবনাময় অন্যান্য টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর পরিণতি যেন সিনোভ্যাকের মত না হয়।

(৪) পরীক্ষামূলক টিকা প্রদানের একটি নীতিমালা তৈরি করে ওয়েবসাইটে দিতে হবে যাতে টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াটি জানতে পারে।

(৫) টিকা প্রাপ্তির জন্য বৈদেশিক নির্ভরতা কাটিয়ে যোগ্যতাসম্পন্ন সহনীয় প্রতিষ্ঠানকে টিকা উৎপাদনের জন্য উৎসাহ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশীপ বা সেরাম ইন্সটিটিউটের মত যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের সুযোগ তৈরি করতে হবে। এটি একদিকে যেমন স্বনির্ভরতা সৃষ্টি করবে অন্যদিকে ব্যয়সাশ্রয়ীও হবে। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করে এই অতিমারি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভূমিকা রাখতে পারবে।

(৬) টিকা প্রাপ্তির অগ্রাধিকারে ন্যায়ভিত্তিক, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের ভারসাম্য থাকতে হবে। অপারেশন পর্যায়ে এটিই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। এখানে সম্মুখসারির যোদ্ধারা যেমন তালিকার শীর্ষে থাকবে তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠিও প্রধান বিবেচনায় আসবে। বিদেশগামী শ্রমিক এবং তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীরাও যেন গুরুত্বক্রমে প্রাধান্য পায়।

(৭) স্বাস্থ্যবিভাগের টিকা সংরক্ষণাগার অপ্রতুল হলে অন্যান্য সংস্থার সংরক্ষণাগার এবং প্রয়োজনে ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক হিমাগার ভাড়ার ভিত্তিতে গ্রহণ করতে হবে।

(৮) মাঠপর্যায়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, কঠোর কোল্ডচেইন, দক্ষ জনবল ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।

কোভিড সহসাই নির্মূল হবে কথাটি এখন সুদূরপরাহত। তাই বহুপক্ষের সম্মিলনে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। টিকাদান কর্মসূচিতে বাংলাদেশের দক্ষতা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে স্বীকৃত। যথাযথ লজিস্টিক, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ, সঠিক টিকা ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বে¡র মাধ্যমে বাংলাদেশ কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিশ্বে রোল মডেল হতে পারে।

 

ডা. মো. সাজেদুল হাসান
অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। 

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট