চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

শীতের শুরুতে কোভিড-১৯ সেকেন্ড ওয়েভ

নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে

শীতের শুরুতে কোভিড-১৯ সেকেন্ড ওয়েভ

ডোমচিলের দৃষ্টি

এজাজ ইউসুফী

১১ ডিসেম্বর, ২০২০ | ৩:৩০ অপরাহ্ণ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসন্ন শীতে করোনার দ্বিতীয় দফা সংক্রমণ সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছিলেন। কিন্তু জনগণ সে কথা অনুধাবন করতে পারেনি। আমিও না। কিন্তু নিজে করোনা পজিটিভ হওয়ার পর ভাবছি ‘কোভিড-১৯ সেকেন্ড ওয়েভ’ নিয়ে আমার সচেতনতাও কাজ দেয়নি। বলা হয়েছে, মাস্ক পরলে ৯৫ থেকে ৯৮ শতাংশ নিরাপদ। আমি এসময় দুটি মাস্ক পরেও রক্ষা পেলাম না।

গত মার্চ থেকে শুরু হওয়া এই প্রাণঘাতি রোগ শুরু হলেও লকডাউনের মধ্যেও পত্রিকায় কাজ করেছি। সহকর্মীদের অনেকেই অসুস্থ ছিলেন। কিন্তু নিজেকে বাঁচিয়ে চলতে সক্ষম হয়েছিলাম। দ্বিতীয় ঢেউয়ে তা আর পারা গেলো না।

মানব ইতিহাসের অন্যতম অতিমারিতে এ পর্যন্ত ৬,৮৭,৯২,৩৬৩ আক্রান্ত এবং ১৫,৬৭,০৫৬ মৃত্যুর (বৃহস্পতিবার পর্যন্ত) রেকর্ড করা হয়েছ। সুতরাং এই রোগ কতটা প্রাণঘাতি হয়ে উঠেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রেক্ষাপট : গত মাসের ২৭ ও ২৮ তারিখ বগুড়ায় লেখক চক্রের লিটল ম্যাগাজিন ‘লিরিক’ সম্পাদনার কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সম্মাননা ২০২০ দিয়েছে। তা নিতে চট্টগ্রাম থেকে সুবর্ণায় ঢাকা যাই ২৬ তারিখ। সেখান থেকে এসি বাসযোগে রাতে বগুড়ায়। ২৯ তরিখ ফিরে আসি। দুটোই বাসযাত্রা। বগুড়া থেকে লাক্সারিয়াস এসআর প্লাস এবং ঢাকা থেকে দোতলা বাসের গ্রিন লাইনে। সংক্রমণটি ঘটে আমার ধারণা বাসেই মধ্যেই। বিশেষ করে এসি বাস বলে। কারণ, এ ধরনের বাসে একজন রোগিও যদি ওঠেন তবে রক্ষে নাই। রোববার ফিরে সোমবারের হালকা জ্বর। অফিস করছি। বাইরে যাচ্ছি। কিন্তু তেমন একটা অসুবিধা ছিলো না। পারিবারিক চাপে করোনা টেস্ট দিলাম মেডিকেলে। রেজাল্ট পজিটিভ।

ভর্তির বিড়ম্বনা : পছন্দের প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তির চেষ্টায় তদবির পর্যন্ত করতে হলো। দৈনিক পূর্বকোণের আমার সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরী, জিএম জিলানী, সিনিয়র্স ক্লাবের চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ও সিটি কর্পোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্যকর্মকর্তা ডা. সেলিম আকতার চৌধুরীর কল্যাণে ৫ ঘণ্টার জন্য প্রথমে ঠাঁই হলো এইচডিইউ-তে। যেহেতু দ্রুত ইনজেকশন শুরু করতে হবে তাই এই ট্রানজিট। সেখানে দেখতে হলো যমে-মানুষে টানাটানি। আনকন্শাস একজন রোগী প্রলাপ বকছেন- ‘অ্যাঁই মরি গেলে পোয়াওলর কী অবস্থা হইবু’। আক্ষেপের বিষয় হচ্ছে, বাইরে একজন রোগীরও কোনো আত্মীয়-স্বজনের দেখা পেলাম না। ৫ ঘণ্টায় এদের কেউ দেখতে এলো না। সন্ধ্যা ৭টায় আমাকে যখন কেবিনে নেয়া হচ্ছে তখন শুধু আমার স্ত্রী অপেক্ষমাণ। তবে, এইচডিইউসহ যেখানেই নেয়া হলো- দেখলাম ডাক্তার, নার্স কিংবা সাহায্যকর্মীদের মধ্যে কোনো প্রকার ভীতি নেই। ভীতিকর পিপিই-ও নেই। এটাই আমার মনের জোর বাড়িয়ে দেয়।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা : কোভিড-১৯ পজিটিভ রিপোর্ট পাওয়ার পর পরই ডা. শিমুল ভৌমিকের তত্ত্বাবধানে শেভরনে বুকের সিটি স্ক্যানসহ যাবতীয় পরীক্ষার নমুনা দিয়ে এলাম। আশ্চর্যজনকভাবে বুকের সিটি স্ক্যানে কোভিডের কোনো নখরাঘাতের চিহ্ন দেখা গেলো না। বলতে গেলে শূন্য শতাংশ। তবে, হালকা নিউমোনিয়ার রিপোর্ট দিলো। অন্য সব টেস্টেও তেমন কিছু পাওয়া গেলো না! শেভরনের জিএম বন্ধু পুলক পারিয়াল বললো- ভয়ের কিছু নাই। ঘরে থেকে নাভিতে কার্ডিনাক ইনজেকশন নিলেই চলবে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম বাসায় অন্যদের সংক্রমণ হতে পারে। হসপিটালে ভর্তি হওয়াই ভালো। তাই করতে একদিন সময় লেগে গেলো। পার্কভিউ হসপিটালের প্রায় করোনা ওয়ার্ডে একটি সিটও খালি নেই! তারপর সেই তদবিরে সিদ্ধি লাভ।

পার্কভিউ-স্বাস্থ্যসেবা : বেসরকারী হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মনিটরিং সেল এর প্রধান চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমানের তত্ত্বাবধানে পার্কভিউ হাসপাতালের ১১ তলায় জরুরি ভিত্তিতে ‘কোভিড-১৯ রেড জোন’ চালু করা হয়। বর্তমানে ১০ ও ১১ তলা মিলিয়ে আইসিইউসহ ৬৪ বেড আছে। সহকারী ম্যানেজার মোহাম্মদ আবদুল মালেক জানান, গত একমাস ধরে কোনো কেবিন খালি থাকছে না। এখান থেকে একজন রোগীকে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ফিরতে ১০ থেকে ১৫ দিন সময় লাগে। তিনি জানান, ৯৮% রোগী ভালো হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। মহাব্যবস্থাপক তালুকদার জিয়াউর রহমান তাঁর সহকারীদের দিয়ে সার্বক্ষণিকভাবে আমার খোঁজ রেখেছেন। আর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এটিএম রেজাউল করিম ফ্রন্ট বক্স পাঠিয়েছেন উপহার স্বরূপ। পরিচ্ছন্নতা ও সার্বিক ব্যবস্থা বেশ উন্নত।

চিকিৎসা : কোভিড-১৯ এর এখনো কোনো ঔষধ নেই। তাই একজন রোগিকে চারিদিক থেকে সুরক্ষার ব্যবস্থা নেন। নব্বই বছর বয়সী মার্গারেট কিনানকে দিয়ে যুক্তরাজ্যের ফাইজার করোনা ভ্যাকসিনের ঐতিহাসিক যাত্রা শুরু করেছে ৮ ডিসেম্বর। এই ভ্যাকসিন করোনা মহামারি রোধে বড় ভূমিকা রাখবে আশা করা যায়। যদিও ইতোমধ্যেই করোনায় দেশে মৃত্যুসংখ্যা সাত হাজার এবং আক্রান্ত ৫ লাখের কাছাকাছি।

চিকিৎসা ব্যয় : কোভিড-১৯ এর কোনো সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। কিন্তু আপনি পজিটিভ হয়েছেন মানে খরচের খাতা ভারি হতে শুরু করবে। প্রথমে ক্লিনিক্যাল টেস্টেই চলে যায় বড় অংক। তারপর শত রকমের ঔষধ সব প্রায় হাজার টাকার উপরে। নিম্নবিত্তের অবস্থা কী হতে পারে ভাবছি। কার্ডিনেক্স, এন্টিবায়োটিক, এস্টোরয়েড কী নেই এই তালিকায়। আমি ডাক্তারকে বলেছি আমাকে যাতে ‘জবসফবংরারৎ ’ ইনজেকনশন না দেয়ার জন্য। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলে বলেছি হু’র (ডঐঙ) অনুমোদন নেই। এটা ট্রাম্প ভেল্কি। যাক, আল্লাহ যাতে আপনাকে এই ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখেন। এ চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাধারণের জন্য সরকারী সহায়তা জরুরি। কারণ, রোগির সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। শীত ঝাঁকিয়ে বসলে বিপদ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে বলা যাচ্ছে না।

সু-সমন্বিত রোডম্যাপ : বাংলাদেশে আসলে করোনা আগামী দিনে কি পরিস্থিতি তৈরি করবে তা এখনই বলে দেয়া যাবে না। এই রোগের ক্যারেক্টারও দ্রুত বদলে যাচ্ছে। এখন সব বয়েসী লোকের মধ্যে সংক্রমণ বাড়ছে। নারীরাও আছে এই তালিকায়। এইচডিইউতে দেখলাম একেবারে কম বয়েসী সুদর্শন এক তরুণ। তার অবস্থা নিশ্চয় খারাপ। হাতে ক্যানোলা নিয়ে লিখছি। চারিদিকে রিস্ক ফ্যাক্টর বেড়ে গেছে। সাবধান হোন। কারণ, আমার-আপনার আশ্চর্য সুন্দর পৃথিবীটা নিমিষেই বদলে যেতে পারে। বদলে দিতে পারে আপনার পরিবার। গত ১৪ নভেম্বর ৮৬ বছরের মাকে কেড়ে নিয়েছে নিষ্ঠুর কোভিড-১৯। করোনাভাইরাস পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩১ দফা অবশ্য পালনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রমের উপর জোর দিয়েছেন। জনপ্রশাসনকে এই সুরক্ষা ব্যবস্থা দ্রুত কার্যকর করতে হবে। তিনি গণ-সচেতনতা তৈরি করতে বলেছেন আমাদের গণমাধ্যমকর্মীদের। এখন শুধু কোভিড সংকট মোকাবেলার ‘সুসমন্বিত রোডম্যাপ’ ধরে এগিয়ে যেতে হবে।

পরিশেষ : পরিশেষে বলতে চাই, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকাকে সচল রেখে মানুষ বাঁচাতে হবে। বিপদে বন্ধুর পরিচয়। সাংবাদিক মিতা এজাজ মাহমুদ, অনুজ মোহসিন চৌধুরীসহ অনেক বন্ধু-বান্ধব সারাক্ষণ খোঁজ-খবর রেখেছেন তাদের জন্য অকৃত্রিম ভালাবাসা। বিশেষ করে মনিটরিং সেল প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মিজানুর রহমান, আমার সম্পাদক ডা. ম. রমিজউদ্দিনের সহযোগিতা বহুদিন মনে থাকবে। কেউ কেউ নিজ সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে দেখে গেছেন- তাদের জন্য কৃতজ্ঞতা। পৃথিবীর এই মহাবিপদে মানুষই পারে রুখে দাঁড়াতে সভ্যতার ইতিহাস তাই বলে। আমি বলি-

এক জীবনে দুই মহামারি বিজয়িনী
ম্যারিল শাপিরোর মতো ১০৭ বছর
বয়সে আমরাও বেঁচে উঠবো আবার।
‘আমি ভয় করবো না ভয় করবো না’
মরবার আগে চিত্রিনী নারীর মতো
জ্যোৎস্নাভরা রাতে করোনাভাইরাসের
সঙ্গে লড়ে যাবো অদম্য সাহসে।
(আমরা বেঁচে উঠবো আবার/এজাজ ইউসুফী)

লেখক: কবি ও সাংবাদিক।

 

 

 

 

পূর্বকোণ/পি-আরপি

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট