চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ, ২০২৫

বায়ান্নর একুশ : দুর্জয় ও স্বাধীনতার ভিত্তি

ড. মো. আবু তাহের

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ | ১২:২৭ অপরাহ্ণ

ইতিহাসে মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য জীবনদানকারী একমাত্র দেশ বাংলাদেশ। বায়ান্নর একুশ এদেশের মানুষকে আত্নপ্রত্যয় ও স্বাধিকারের বিষয়ে সচেতন করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত করে। উল্লেখ্য, ১৯৯৯ থেকে বায়ান্নর একুশ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালিত হচ্ছে, যা বাংলাদেশকে বিশ্বব্যাপী মহীয়ান করেছে। এটা ধ্রুবসত্য উপনিবেশিক আমলে বিট্রিশ শাসকেরা এতদাঞ্চলকে শাসন করার জন্য যেমনি সাম্প্রদায়িকতাকে বিভিন্ন রূপে ব্যবহার করে তেমনি সমাজকাঠামোর ভিত্তি হিসেবে বর্ণ ও ধর্মকে মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

তাই আলফ্রেড লায়াল ১৮৭৫ সালে এক প্রবন্ধে বলেন, ‘ভারতের ২৪ কোটি লোক রক্ত, বর্ণ ও ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত।’ সুতরাং বিট্রিশ শাসন অব্যাহত রাখার স্বার্থে তারা এ বিভক্তি অটুট রাখার প্রাণান্ত প্রয়াস চালায়। তবে ঊনিশ শতকের শেষার্ধে কংগ্রেস এবং বিংশ শতকের শুরুতেই মুসলিম লীগের উদ্ভব হয়। কংগ্রেস ক্রমেই ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারক-বাহক হয়ে উঠে; আর মুসলিম লীগ প্রথমে মুসলমানদের ধারক-বাহক হয়ে উঠলেও পরে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলনের অগ্রদূত হয়ে উঠে। তবে দীর্ঘ ১৯০ বছর বিট্রিশ শাসনামলের শেষের দিকে আমরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে পেলাম হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদ। এ রাজনীতির পরিণতিতে বাংলা ভাগ হয়ে যায়।

 

মূলত দু’বঙ্গকে এক করার জন্য নয়; বরং পূর্ববঙ্গের বাঙালিকে বাঙালি হওয়ার যে আকাক্সক্ষা ’৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হয় তা ক্রমাগত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে- এ যেন মাতৃগর্ভে শিশুর বেড়ে উঠা; জন্মলাভের উদ্দেশ্য। বস্তুত: দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৪ আগস্ট ১৯৪৭ ও ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ যথাক্রমে জন্ম নেয় পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটো রাষ্ট্র। পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টির সাত মাসের মাথায় তৎকালীন পাকিস্তানী নেতৃত্ব বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির উপর আঘাত করে বক্তব্য দিতে থাকে। তখনই বাঙালিরা উপলব্দি করেন পাকিস্তানের এ অদ্ভূত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মাধ্যমে আর যাই হোক বাঙালির স্বার্থ সংরক্ষিত হবে না। প্রয়োজন হবে বাঙালির স্বাধিকার ও স্বার্থরক্ষার জন্য স্বাধীন রাষ্ট্রের।

 

অন্যদিকে ডিসেম্বর ১৯৪৭ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত এক শিক্ষাসম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়; যদিও পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মাতৃভাষা ছিল বাংলা। এর প্রতিবাদে পূর্ববাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মাতৃভাষা রক্ষার চেতনার অগ্নিস্পৃহা থেকে পূর্ববাংলার জনগণের আন্দোলন-সংগ্রামের একপর্যায়ে তৎকালীন সরকার বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে বাধ্য হয়। এতে পূর্ববাংলার জনগণ নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য-ভাষা-সংস্কৃতি নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস ও আত্নপ্রত্যয় খুঁজে পায়। অধিকন্ত পূর্ববাংলার কবি-সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা ভাষা-সংস্কৃতি ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে নিয়ে ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে এতদাঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে অনুরণিত ও স্বাধীনতার দিকে ধাবিত করে।

 

বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার বিষয়ে ১৯৫১ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের উপর উর্দুভাষা চাপিয়ে দিলে তা হবে গণহত্যার সামিল এবং প্রয়োজন হলে আমি একাই এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করব। আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি।

 

বাংলাভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশ এবং বাঙালিত্বের সঙ্গে মনুষত্বের সংযোগ ঘটিয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন জাতি ও ভাষারাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। মূলত: ভাষা একটি ইহজাগতিক বিষয়; রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সেই পথ ধরেই এগোচ্ছিল এবং তারই ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধ চেয়েছে রাষ্ট্রে ইহজাগতিকতার প্রতিষ্ঠা ঘটাতে। যে যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালন করবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও আচরণে; রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্ম মিশে যাবে না। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ’৭২ এর সংবিধানে চারটি মূলনীতির (গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতিয়তাবাদ) মাধ্যমে এর সম্মিলন ঘটায়।

 

একুশ মানেই দুর্জয় ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করা। একুশের পথ বেয়ে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম এবং অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে আমরা ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে এদেশের মানুষ একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে মরণপদ লড়াই করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সব মানুষের মানবাধিধকার স্বীকৃতই ছিল বাংলাদেশের সংবিধানের মূল ভিত্তি। সুচিন্তিত গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও কৌশলি নেতৃত্বের মাধ্যমে জাতীয় অধিকার প্রতিষ্ঠা যে সম্ভব, তৎকালীন নেতৃত্ব তার প্রমাণ সমগ্র বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন।

 

মূলত ধর্মভিত্তিক নয়; বরং ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রজ্বলন ঘটিয়ে সবার ঐক্যবদ্ধতায় বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছিলো। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, পুঁজিবাদী শোষণ-বঞ্চনা বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর সুপরিকল্পিত আক্রমণের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ সর্বদা সোচ্চার-সংগ্রাম করেছে। ঊপনিবেশিক ভারতবর্ষ ও পরাধীন পাকিস্তানের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত এবং বাংলা ভাষার মর্যাদা অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের প্রাণপণ লড়াই ও রক্ত দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, এখনো সর্বক্ষেত্রে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সেভাবে এগোয়নি।

 

 

বায়ান্ন পরবর্তীকালে একুশের চেতনা বিস্তার ও বাংলা ভাষার মর্যাদা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখেন। স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রাম এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযদ্ধ তৎকালীন ভূমিকা ইতিহাসের পাতায় স্বর্নাক্ষরে লেখা আছে। কেউ চাইলেও মুছে ফেলতে পারবে না বরং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে তাদের ভূমিকা আরো উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতার হয়ে উঠবে। স্বাধীনতার ৫৪ বছর শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও দেশ অনেক এগিয়ে। জনগণ এর সুফলও ভোগ করছে। এখন বাংলাদেশ ২০৪১ মধ্যে আধুনিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখে। এজন্য আমাদের কর্তব্য হচ্ছে সততা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্ব স্ব অবস্থান থেকে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। আর এটাই হোক বায়ান্নর একুশের শহীদদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন।

 

লেখক: প্রফেসর, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, চবি; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সাবেক সদস্য, বাংলাদেশ মঞ্জুরি কমিশন।

 

পূবকেোণ/ইব

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট