চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি

ফরিদুল আলম

৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৩০ পূর্বাহ্ণ

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর টানা তৃতীয় মেয়াদে দায়িত্ব গ্রহণের পর এটা প্রথম ভারত সফর। আবার গত দুইবছরের কিছুবেশী সময়ের মধ্যে এটা তার দ্বিতীয় ভারত সফর। দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে যখন শীর্ষ পর্যায়ের এধরনের সফর চালাচালি হয় তখন সঙ্গতকারণেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয় এই সফরের মাধ্যমে কি অর্জিত হতে যাচ্ছে সেসব নিয়ে। কিন্তু এবারের সফরের সার্বিক বিষয়বস্তুর বিচারে আমার কাছে এটাকে খুব একটা সময়োপযোগী বলে বিবেচিত হয়নি।
দুই দেশের তরফেই বলা হয়ে থাকে যে বর্তমান সময়ে সম্পর্কের সোনালী যুগ চলছে এবং দ্বিপাক্ষিক অমীমাংসিত প্রায় সব বিষয়ই মীমাংসিত হয়ে গেছে, বাকী রয়ে গেছে কেবল তিস্তার পানি বন্টন চুক্তিটি। তবে ভৌগোলিক নৈকট্য এবং নিত্যনতুন সমস্যার বৈচিত্র্যের বিষয় লক্ষ্য করলে এমনটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি হওয়ার মতকোন সমস্যা নেই। এইতো কেবল গেল মাসে ঘোষিত আসামের নাগরিক পঞ্জি নিয়ে সাড়া ভারত জুড়ে এখন পর্যন্ত যে তোলপাড় চলছে এর ঢেউ কিন্তু খুব ভালভাবেই আছড়ে পড়েছে বাংলাদেশে। যদিও ভারতের বিদেশমন্ত্রকের তরফ থেকে এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের গত আগস্ট মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় আমাদের আশ্বস্ত করে বলা হয়েছিল যে বিষয়টি ভারতের আভ্যন্তরীণ বিষয়, সাম্প্রতিক সময়ে বিজেপি মন্ত্রী অমিতশাহ এবং তার অনুসারীরা অনেকটা প্রকাশ্যেই প্রচার করে বেড়াচ্ছেন যে নাগরিক পঞ্জি থেকে বাদপড়া মুসলমানদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হবে। সুতরাং উৎকন্ঠাতো কিছুটা থেকেই যায়।
আমি অনেকটা অধীর আগ্রহের সাথে প্রধানমন্ত্রীর এই ভারত সফরের গুরুত্ব উপলব্ধি করতেচেষ্টা করছিলাম। তার ৪দিনের এই সফরের শেষে সারাংশ যা দাঁড়াল তা হচ্ছে সফরের প্রথমদিন তিনি সেখানে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের সম্মেলনে বক্তব্য দেন, যেখানে আঞ্চলিক সহযোগিতার উপর গুরুত্ব আরোপ করে কেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আসবেন এর স্বপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। বাংলাদেশের সস্তা শ্রমবাজারের সাথে দক্ষিণ, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাথে ভৌগোলিক নৈকট্য এই সব কিছু মিলে প্রায় ৩০০ কোটি মানুষের সাথে এদেশের সংযোগ স্থাপনের একটি সুবিশাল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী সকলকে এদেশে আরও অধিকমাত্রায় বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহবান জানান। ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় সরকারের পরিকল্পনা এবং এর মধ্যে ১২টি ইতোমধ্যে চালু হয়ে যাওয়া এবং এর সন্তোষজনক অগ্রগতি সকলকে আশাবাদী করে তুলতে পারে বলে তিনি মনে করিয়ে দেন।
মূলত বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে যোগদানের বাইরে এই সফরটি ছিল একটি দ্বিপক্ষীয় সফর এবং স্বাভাবিকভাবেই এই সফরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য কি অর্জন করতে চাইছে এরকম একটা প্রত্যাশা থেকেই যায় সবার মাঝে। তারপরও আমরা লক্ষ্য করেছি এবারের এই সফরকে ঘিরে কোন ধরনের উচ্চাশা সরকার কিংবা দেশের মানুষের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়নি। এবারের এই সফরে দুই দেশের শীর্ষনেতৃত্বের মধ্যে বেঠকটি অনুষ্ঠিত হয় সফরের তৃতীয় দিনে, যেখানে ৭টি চুক্তি এবং ৩টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়, যার মধ্যে জ্বালানী সহযোগিতা, ভারতের ক্রেডিট লাইনের আওতায় উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবয়ন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে হায়দারাবাদে বিশ্ব বিদ্যালয়ের সহযোগিতা, যুব উন্নয়ন ইত্যাদি।
দুই দেশের মধ্যে বহুল অপেক্ষিত তিস্তার পানিবন্টন চুক্তি ২০১১ সালের পর থেকে আর অগ্রসর হতে পারেনি। এ নিয়ে ভারতের সরকারের তরফ থেকে তেমন একটা তাগিদ আছে বলেও কখনও মনে হয়নি, যদিও এবারের সফরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর তরফ থেকে বাংলাদেশের সরকার প্রধানকে আশ্বাস দিয়ে বলা হয়েছে তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে কাজ করতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে নতুন যেটা তা হল, তিস্তা ছাড়াও আরও ছয়টি অভিন্ন নদীর (মনু, মুহুরি,খোয়াই,গোমতী, ধরলা, দুধকুমার) জল কীভাবে ভাগাভাগি করা যায়, অবিলম্বে তার একটি খসড়া কাঠামো প্রস্তুত করতে দুই নেতা যৌথ নদীকমিশনকে নির্দেশ দিয়েছেন। উল্লেখ্য এখানে ৬টি নদীর কথা বললেও একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন নদী হিসেবে তিস্তাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যা থেকে তিস্তা নিয়ে ভারত যে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের সাথে কোন চুক্তিতে উপনীত হচ্ছে না সেটা অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। এতদিন ধরে দিল্লীর কাছ থেকে আমরা শুনে এসেছি যে পশ্চিম বঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণে তারা বাংলাদেশের সাথে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে কোন চুক্তিতে আসতে পারছে না, অথচ এবার টানা দ্বিতীয় মেয়াদে নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর আমরা দেখেছি কাশ্মীরের ৩৭০ অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিশেষ সুবিধা বাতিল এবং স্পর্শকাতর নাগরিকপঞ্জিতে তারা হাত দিয়েছে, যা নিয়ে রাষ্ট্রজুড়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে, অথচ বিজেপি সরকার তাদের নীতিতে অটল। আর তাদের এই অটল অবস্থার মূলে রয়েছে তাদের ব্যাপক বিজয়। এছাড়া একটি কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় স্বার্থে কি করবে না করবে তা সবসময় রাজ্য সরকারের কাছে জবাবদিহিতার সুযোগ নেই। রাজ্যে যদি বিরোধীদল সরকারে থাকে তবে এটাই স্বাভাবিক যে তারা প্রতি পদে পদে কেন্দ্রীয় সরকারর উদ্যোগকে বাধাগ্রস্ত করবে। সুতরাং তৃণমূলের আপত্তির কারণে কেন্দ্রীয় সরকার এই চুক্তি করতে পারছেনা এটা দিন যতই যাচ্ছে ততই হাস্যকর একটি যুক্তি হিসেবে ঠেকছে আমাদের কাছে। তাছাড়া আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে যে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিও বর্তমানে একটি শক্ত অবস্থান সৃষ্টি করেছে। বিগত নির্বাচনে রাজ্যে ৪২ টির মধ্যে তারা ১৮টি আসনে জয়লাভ করে রেকর্ড করেছে। গতবার জিতেছিল মাত্র ২টিতে। তারা আগামী বছর রাজ্য বিধানসভায় জয়লাভ করতে বর্তমানে মরিয়া।
এবারের সফরটি নিয়ে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে এরই মধ্যে। কেউ কেউ এত বছরেও তিস্তার পানি না পেয়ে উপরন্তু ভারতকে ফেনী নদীর পানি ১ দশমিক ৮ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করে ত্রিপুরার সাবরুম শহরে পানীয় জলের প্রয়োজন মেটাতে অনুমোদন দেয়াকে হতাশাজনক বলে মনে করছেন। এছাড়াও এদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের আগমনের শুরু থেকেই এ নিয়ে ভারতের রহস্যজনক ভূমিকাকে আরও রহস্যজনক বলে মনে করছেন অনেকেই। সাম্প্রতিক সময়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে ভোটাভোটিতে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের পক্ষে ভোট না দিয়ে নীরবতা প্রদর্শন এই সমস্যা নিয়ে অতীতে বাংলাদেশের পাশে থাকার ভারতের অঙ্গীকারের সাথে বৈপরীত্বের সামিল বলে বলে মনে হয়েছে। এবারের সফরের এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানে ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে এমন অঙ্গীকার তাই খুব একটা টেকসই বলে মনে করার উপায় নেই।
দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি নিয়ে ভারতের অবস্থান এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। ভারতের তরফে এনিয়ে বাংলাদেশের দুশ্চিন্তগ্রস্তবার কারণ নেই বলা হলেও এই সফরে দুই নেতার মধ্যে যৌথ বিবৃতিতে বিষয়টি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। এই নাগরিকপঞ্জির পর এবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিতশাহ নতুন করে নাগরিকত্ব আইন করে মুসলমানদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেবেন বলে ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এনিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোন আশ্বাস বাংলাদেশকে দেয়া হয়নি।
সবকিছু মিলিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এবারের ভারত সফরকে অনেক ম্লান একটি সফর বলে মনে হয়েছে, যেখানে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের প্রতি উষ্ণ আতিথেয়তা প্রদর্শনের কোন তোড়জোড় ছিল না, ছিল না তেমন আনুষ্ঠানিক ব্যস্ততাও। সফরের সবকিছু ছাপিয়ে কেবল আমাদের দেয়ার পাল্লাটাই এবার অধিক ভারী মনে হয়েছে। ভারতকে চট্টগ্রাম এবং মংলা বন্দর ব্যবহারে বাংলাদেশের সম্মত হওয়ার পাশাপাশি আমরা তাদের কোন বন্দর ব্যবহারের অনুমতি পাইনি। আমাদের গ্যাসের সংকট থাকা সত্ত্বেও ত্রিপুরায় এলপিজি রপ্তানীর বিষয়টি আমাদের সংকট ভবিষ্যতে ঘনীভূত করে তুলতে পারে। ভারতের সাথে আমাদের বেশ কয়েকবছর ধরে নৌ ট্রানজিট চলমান রয়েছে, আলোচনা রয়েছে সড়কপথে ট্রানজিটের বিষয়টি নিয়েও। ইতোমধ্যে জানা গেছে এই নৌ ট্রানজিট বন্দরের অবকাঠামোগত সুবিধা এবং সার্বিক কারণে দুইদেশের জন্যই তেমন আকর্ষণীয় হয়ে উঠতে পারেনি। এসব নিয়ে আলোচনা এবং সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত পারষ্পরিক স্বার্থের দিকটিকে আরও তুলে ধরতে পারত। তবে আশার কথা এই যে ভারত এবং বাংলাদেশ দুই দেশই একে অপরের সাথে বর্তমানে সম্পর্কের এমন ধারা বজায় রাখছে, যেখান থেকে যখন তখন যে কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা করার সুযোগ রয়েছে। তেমনিভাবে দুই শীর্ষ নেতার আলোচনায় হয়ত এমন অনেক বিষয় এসেছে, যা প্রকাশ্যে আসেনি কৌশলগত কারণে অথচ, তা দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। কূটনীতিতে এমনটা হয়। আমরাও তাই আশা করতে পারি যে নরেন্দ্র মোদি এবং শেখ হাসিনা এই দুজনই যেহেতু এই মুহূর্তে যার যার দেশের জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছেন, যার যার জাতীয় স্বার্থে তাই প্রতিবেশী দেশের সাথে সবার আগে সুসম্পর্ক দৃঢ় করা প্রয়োজনেÑএই বিষয়ে উভয়ই যথেষ্ট জ্ঞান রাখেন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট