চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মৃতিতে অমলিন আবুল কালাম স্যার

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

৯ অক্টোবর, ২০১৯ | ১২:৩১ পূর্বাহ্ণ

‘(হে মোহাম্মদ) তুমি পড়, (পড়) তোমার মালিকের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন, যিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট বাঁধা রক্ত থেকে, তুমি পড় এবং (জেনে রাখ) তোমার রব বড় মেহেরবান, তিনি (মানুষকে) কলম দ্বারা (জ্ঞান) শিখিয়েছেন, তিনি মানুষকে (এমন কিছু) শিখিয়েছেন যা (তিনি না শেখালে) সে কখনও জানতে পারত না’-(সূরা আল্-আলাক-¡ আয়াত ১-৫)। শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড। একটি উন্নত জাতি গঠনে শিক্ষার কোন বিকল্প নেই। এই মহান কর্তব্যকে যিনি আমৃত্যু আগলে ধরে রাখেন, তিনিই হলেন সমাজের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি শিক্ষক। যে বা যাঁরা এ মহান পেশাকে জীবনের একমাত্র ব্রত হিসাবে গ্রহণ করেছেন, তাঁরাই জাতিকে দিতে পেরেছেন একটি মেধাবী ও সৎ মানবিক সমাজ আর নিজেরা হয়েছেন পরম সম্মানিত।
আর যাঁরাই এ পেশার মাধ্যমে সমাজ ও জাতিকে কলুষিত করেছেন, তাঁরাই সমাজে অত্যন্ত ঘৃণিত ও ধিকৃত ব্যক্তি হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে। তেমনি একজন মহান শিক্ষকের কথা বলছি আজ, যিনি গত ২৪ আগস্ট ২০১৯ এক অনাকাক্সিক্ষত ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন। চলে গেছেন ওপারের দেশে-যেটার পৃথিবী সম্পূর্ণ অন্যরকম। এ নশ্বর পৃথিবীর কোন আয়োজন সেখানে থাকবে না। কোন রঙ্গ-মঞ্চের আসর সেখানে থাকবে না। ক্রীড়া-কৌতুক প্রতিযোগিতার আসর জমবে না সেখানে, কোন ব্যাংক হিসাব থাকবে না। থাকবে না কোন দালান-কোঠার হিসাব- থাকবে শুধু জিন্দেগীর আমলের হিসাব। ছোট্ট একটি মাটির ঘরে বসবাস সে সমস্ত কবরবাসীদের। সমাজে অনেক শিক্ষকই দুনিয়ার মায়া ছেড়ে চলে যান। সবার খবর হয়তো আমরা পাই না কিন্তু কিছু কিছু শিক্ষক আবুল কালাম স্যারদের মতন জীবনের পরতে পরতে অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় স্মৃতিচিহ্ন রেখে যান, যা হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য উত্তম আদর্শ।
রাউজানের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষপ্রতিষ্ঠান রাউজান আর আর এ সি মডেল হাই স্কুলে দীর্ঘ জীবন শিক্ষকতা করেছেন এ মহান শিক্ষক। মাঝখানে শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে ওষুধ কোম্পানী থেরাপিওটিক্স এর চট্টগ্রামস্থ কালুরঘাট অফিসে যোগদান করেন, ৭-৮ বছর পর পুনরায় তিনি ঐতিহ্যমন্ডিত রাউজান হাই স্কুলে যোগদান করেন। ২০০৯ সালে তিনি স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে প্রায় ২ বছর গহিরা দলইনগর উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। সর্বশেষ তাঁর কর্মজীবন ছিল রাউজান এমদাদুল ইসলাম নূরানী কেজি। এখানে সাফল্যের সাথে ৩ বছর অধ্যক্ষ পদে কর্মরত ছিলেন। আমরা যখন রাউজান ছালামতউল্লাহ্ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম, তখন পার্শ্ববর্তী স্কুল রাউজান হাই স্কুলের একজন অগ্নিশর্মা অথচ সততার কঠিন ভাস্বর শিক্ষকের কথা শুনতাম- তিনি আর কেউ নন, কালাম স্যার। তাঁর ভয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা সদা সর্বদা তটস্থ থাকত। কঠোর সময়ানুবর্তিতা ছিল কালাম স্যারের জীবনের অন্যতম প্রধান গুণ-এ গুণে গুণান্বিত হয়ে তিনি তাঁর গোটা জীবনকে সাজিয়েছেন আর ছাত্র-ছাত্রীদেরকে উপহার দিয়েছেন একটি সুন্দর ও পরিশীলিত ছাত্র-জীবন। যদিও আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না কিন্তু তাঁর প্রতি ছিল আমার অগাধ শ্রদ্ধা। বিশেষত ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি একজন শিক্ষকের যে দায়িত্ববোধ থাকা উচিত তার পুরোধা ছিলেন তিনি। দুঃখজনক হলেও সত্যি এই যে, আজকাল শিক্ষকের প্রতি ছাত্র-ছাত্রীদের সম্মানবোধ নেই বললেই চলে। আবার অনেক শিক্ষক অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতেও দেখা যায়। কিশোর সমাজ সদ্য আধুনিকতার ছোঁয়ায় জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন গ্যাং গ্রুপে। এন্ড্রয়েড ফোনের সুবিধায় কৈশোর ও ছাত্রজীবন বিকিয়ে দিচ্ছে অবলীলাক্রমে। শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে যে নিবিড় সম্পর্ক থাকা দরকার, সেটা আজ অনুপস্থিত। যার ফলে সমাজে বাড়ছে অস্থিরতা, নানাবিধ অযাচিত দুর্ঘটনা।
আমরা হয়তো আর কোন কালাম স্যারকে পাব না, কালাম স্যারদের আদর্শকে ধারণ করা নতুন প্রজন্ম কি সমাজকে উপহার দিতে পারব না? এই তো সেদিন মরহুম আবু তাহের চৌধুরী ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে শেষ দেখা হয়েছিল কালাম স্যারের সাথে-সম্ভবত এ বছরের ইফতার মাহফিলে। আমাকে তিনি তাঁর মেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানের কার্ড দিয়ে বলেছিলেন, ‘ফারুক তোমাকে অবশ্যই আসতে হবে’। এই ছিল তাঁর সাথে আমার শেষ পংক্তিমালা। কালাম স্যার চলে গেছেন কিন্তু সমাজকে করে গেছেন আলোকিত। আলোকময় ছাত্র-সমাজ গড়ে তুলেছেন অত্যন্ত নিবিড়ভাবে। তাঁর অবদান সমাজ কোনদিন ভুলবে না। রাউজানবাসী তাঁর কাছে ঋণী হয়ে থাকবে। তাঁর একমাত্র ছেলে সদ্য এমবিবিএস পাশ করা চিকিৎসক-সমাজে যেন পিতার মতন আলোকবর্তিকা ছড়াতে পারেন, সে আশা-ই রাখি। বড় ও মেঝ মেয়ে বাবার মতন শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। ছোট মেয়ে চুয়েট থেকে সম্প্রতি মেকানিক্যাল গ্রুপে বিএসসি পাশ করেছেন। মহান আল্লাহ্তায়ালা তাঁকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসিব করুন।

লেখক : সভাপতি, রাউজান ক্লাব জুনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),জেনারেল হাসপাতাল, রাঙ্গামাটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট