চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

কিশোর অপরাধ ও সমাজ দূষণ

কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম

২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৫১ পূর্বাহ্ণ

বর্তমান সমাজে নানা অপরাধ সংঘটনের পাশাপাশি কিশোর অপরাধের মাত্রা বাড়ছে। সাম্প্রতিককালে কিশোর অপরাধীরা ‘গ্যাং’ বা গ্রুপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে প্রশাসনও এ অপরাধের বিরুদ্ধে কঠোর হয়েছেন। এর আগে নিকট অতীতের বেশ কিছু ঘটনা (কিশোর অপরাধ) তোলপাড় করেছে সারা জনপদে। প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার উৎসবে মেতে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। গত বছরের জানুয়ারিতে চট্টগ্রামে এক কলেজিয়েট স্কুলছাত্রকে প্রকাশ্যে হত্যার ঘটনা তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ। এই ঘটনাটি তখন সারা দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করেছিল। ক্ষেত্রবিশেষে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে অপরাধীরা। ধরা পড়লেও শাস্তি কতটুকু হবে তা নিয়ে শংকিত ভুক্তভোগী মানুষ ও তাদের পরিবার। নানা ধরনের অপরাধ করার কৌশল রপ্ত করছে এইসব কিশোর অপরাধীরা। হেন অপরাধ নেই যা তারা করছে না।

সেদিন ঢাকার একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রামে ৩০০ স্পটে সক্রিয় রয়েছে প্রায় ৫৫০ কিশোর অপরাধী। দেশের অন্যান্য স্থানেও যার কমতি নেই। কিশোর অপরাধীরা আবার বিভিন্ন গ্যাং এর মাধ্যমে তথাকথিত ‘বড় ভাইদের’ আষ্কারা পেয়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে।

সাধারণ মানুষের অসহায় এ অবস্থা থেকে মুক্তি না মিললে সমাজে বাস করাও দায় হবে। বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, অনেক ভালো স্কুলের মেধাবি শিক্ষার্থীরাও এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িয়েছে। স্কুল ফাঁকি দিয়ে গ্রুপের আস্তানায় যোগ দেয়। সেখানে তথাকথিত বড় ভাইরা তাদের নানা অপরাধের অপকৌশল শিখিয়ে দেয় বলে বিভিন্ন তথ্যে উঠে এসেছে। এসব তথ্য প্রশাসনের হাতে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে পড়ছেন, অপরাধের সাথে স্কুল ছাত্রদের জড়িত থাকার তথ্যে চমকে উঠেন। এ নিয়ে মা, বাবা, অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।

চুরি, সন্ত্রাস এবং খুনের মত ঘটনাগুলো আমাদের সমাজকে বিষিয়ে তুলছে। মাদকের ছড়াছড়ি আর সন্ত্রাসের উপাদানগুলো হাতের কাছে পাওয়ায় কিশোর অপরাধীরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে। দ্বিধা করছে না কোন অপরাধ করতে। ‘বড় ভাইদের’ সহযোগিতা পেয়ে তারা দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। কে কোন সময় খুন, গুম কিংবা অপ্রীতিকর ঘটনার মুখোমুখি হবে তা বলার কোন উপায় নেই। অনলাইনে নানা পর্ণ সাইট ও অশ্লীলতায়ও আসক্ত হচ্ছে কিশোররা। দিনরাত ফেসবুক, ইন্টারনেট ঘাঁটাঘাঁটির মধ্য দিয়ে সময় ব্যয় করার কারণে পড়ালেখাও লাটে উঠছে। ফলে মাথায় আর সুবুদ্ধি আসে না। জড়িয়ে পড়ে নানা অপরাধে। এসব বিষয়ে মা, বাবা, অভিভাবককে খোঁজ খবর রাখতে হবে, বিপথে পা বাড়ানো আঁচ করতে পারলেই শুরুতে যেভাবেই হোক তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে। শুরুর দিকে যদি শোধরানোর ব্যবস্থা করা যায় তাহলে অপরাধের সাথে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে আসে। আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধ থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
আমাদের নেতাদের উচিত হবে না কোন অপরাধীকে প্রশ্রয় দেয়া। তাদের উচিত হবে, কীভাবে শিশু-কিশোরদের অপরাধ থেকে মুক্ত রাখা যাবে তার জন্য কর্মসূচি তৈরি করা। সমাজের সচেতন ব্যক্তিবর্গকেও এগিয়ে আসতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকা। মা-বাবা, অভিভাবকদেরকে নিজেদের সন্তানদের ব্যাপারে নিয়মিত খবরা খবর রাখতে হবে। কার কার সাথে তার বন্ধুত্ব করছে, কোথায় কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের চেষ্টার কমতি থাকতে পারবে না। ছোটবেলা থেকে শিশুদের সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে, দিতে হবে চরিত্র গঠন উপযোগী নৈতিক শিক্ষা। যেসব কারণে কিশোররা অপরাধে জড়াচ্ছে তার মূলে পৌঁছাতে হবে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক গুলোতেও শিক্ষামূলক, নৈতিক বিষয়বস্তু সংযোজন করতে হবে। নীতিহীন শিক্ষা থেকে শিশু-কিশোরদের বাঁচাতে এর কোন বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে অপরাধীর কঠোর শাস্তির নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্টদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। কিশোর অপরাধকে কোনোভাবেই বাড়তে দেয়া যাবে না।তারাই জাতির ভবিষ্যৎ। তাদের মাঝেই লুকিয়ে আছে আগামীর নেতৃত্ব। নির্মূল হোক কিশোর অপরাধ, গড়ে উঠুক সুন্দর একটি দেশ।

লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট