চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

একজন কালজয়ী মানুষ

জহিরুদ্দীন মো. ইমরুল কায়েস

৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ | ১২:৪৮ পূর্বাহ্ণ

আ ল হাজ মো হা ম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। কিংবদন্তিতুল্য একটি নাম। একটি ইতিহাস। ইহকালের কর্মগুণ যদি থাকে, তাহলে সে কর্মফলের বদৌলতে মানুষ পরকালেও অমর হয়ে থাকে। মরহুম ইউসুফ চৌধুরীও সেরকম একজন অমর ব্যক্তিত্ব। জন্মলগ্ন থেকেই যিনি ছিলেন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী ও সদালাপী। অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিক না হয়েও শুধূ পরিশ্রম আর কর্মগুণের কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ভূখন্ডে তিনি অবিনাশী নাম রূপে আবির্ভুত হয়েছেন। চট্টগ্রামের আধুনিকতা এবং উন্নয়নের কথা উঠলে সেখানে মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর নাম উচ্চারিত হয়। তাঁর উত্থানটি ধূমকেতুর মতোও নয়। অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে তিনি এ পর্যায়ে আসতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত ঘাঁটলে দেখা যায় তিনি আজন্মই ছিলেন জ্ঞান আহরণের এক অদম্য অভিযাত্রী। শৈশবকাল থেকে মৃত্যু অবধি তিনি জ্ঞানের আহরণ ও শিক্ষার আলো ছড়ানোর মতো মহৎ কর্মটি স¤পাদন করে গেছেন অবলীলায় অকুন্ঠচিত্তে। মানুষ টাকা পয়সা হাতে পেলে গতানুগতিক ব্যবসাপাতির চিন্তা ভাবনা করে। কিন্তু তিনি ছিলেন এর বিপরীত। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময়েই তিনি রাউজানে ছাত্রবন্ধু নামে একটি লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন। লাইব্রেরি দিয়ে হয়তো তিনি লাভের মুখ দেখেননি। কিন্তু গ্রামে লাইব্রেরি দিয়ে জ্ঞানের আলো ছড়ানোর মতো মহৎ কাজটির গোড়াপত্তন করেছিলেন। গ্রামের মানুষের চক্ষু মেলে দিতে পেরেছিলেন জ্ঞানজগতের এক নতুন দিগন্তে। এতো অল্প সময়ে তিনি দমে যাওয়ার পাত্রও ছিলেন না। তাইতো এক নবচেতনায় তিনি ঢেউয়া, রাউজান থেকে চট্টগ্রাম শহরে পা রাখলেন। জ্ঞানের পরিধিকে যদি আরো মেলে ধরা যায়। সে অভিপ্রায়ে জুবিলী রোডে ছোট্ট একটি দোকান নিয়ে সেখানে তিনি বিভিন্ন জ্ঞানমূলক ম্যাগাজিন বিক্রি শুরু করেন। তিনি তৎকালীন ডন পত্রিকার এজেন্ট ছিলেন। করাচীর প্যারাডাইজ বুকসের সাথে মিলে ব্যবসার পরিধিকে আরো প্রসারিত করেন। সে ধারাবাহিকতায় তিনি চট্টগ্রামের নিউ মার্কেটে নিউজ ফ্রন্ট নামে একটি অভিজাত বইয়ের দোকান খুলেন। যেখানে বিভিন্ন বইয়ের সাথে দেশি-বিদেশী বিভিন্ন পত্রিকা আর ম্যাগাজিন থাকতো। রিডার ডাইজেস্টের মতো আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন এই ম্যাগাজিনটি তাঁর শিল্পশালায় স্থান পেতো। নিউজ ফ্রন্ট দোকানকে ঘিরে একটা পাঠকশ্রেণি সৃষ্টি হয়েছিল। ছোটবেলায় আমরা এ দোকানের সামনে সারি সারি মানুষকে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন বই ম্যাগাজিন নিয়ে মশগুল থাকতে দেখতাম। নিউজ ফ্রন্টকে ঘিরে বহু মানুষের সমাগম থাকলেও সেখানে ছিল পিনপতন নীরবতা। বই পড়ে যেন সবাই জ্ঞানের খিদে মিটাচ্ছেন। চট্টগ্রামের পন্ডিতশ্রেণি তৈরির ক্ষেত্রে নিউজ ফ্রন্টের ভূমিকা অনেক। তারই ধারিবাহিকতায় ১৯৮৬ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি এ অঞ্চলের অত্যাধুনিক সংবাদপত্র দৈনিক পূর্বকোণের যাত্রা। মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর চিন্তা-ভাবনার স্বার্থক প্রকাশ দৈনিক পূর্বকোণ। এই প্রথমবারের মতো চট্টগ্রামবাসী দেখল জাতীয় পত্রিকার মতো একটি আধুনিক দৈনিক। যে দৈনিকটি চট্টগ্রামের কথা বলে, জাতীয় রাজনীতির কথা বলে, গ্রাম গঞ্জের নিপীড়িত নিস্পেষিত মানুষের কথা বলে, সর্বোপরি চাঁটগার উন্নতির কথা বলে। সেই জন্মলগ্ন থেকে আজ অবধি দৈনিক পূর্বকোণ চট্টগ্রামবাসীর আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে উঠেছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে দৈনিক পূর্বকোণ না দেখলে কী যেন আমরা মিস করি। দৈনিক পূর্বকোণ আঞ্চলিক পত্রিকা হলেও এর গুরুত্ব এবং প্রভাব দেশের প্রধান প্রধান জাতীয় দৈনিকগুলোর মতোই। তাঁর আজন্ম লালিত স্বপ্নগুলো দৈনিক পূর্বকোণকে দিয়ে বাস্তাবায়িত হচ্ছে। তিনি শুধু জ্ঞান প্রসারিত করার ক্ষেত্রেই নয়, চট্টগ্রামের সামগ্রিক উন্নয়নের জন্যেও অসামান্য অবদান রেখেছেন। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সংগ্রামেরই ফসল। পোল্ট্রি ফার্মের বিস্তৃতিতেও তিনি নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। আজন্ম নজরুলপ্রেমী ইউসুফ চৌধুরীর গ্রামের বাড়ি ঢেউয়া, রাউজান হাজীবাড়িতে জাতীয় কবির আগমন ঘটেছিল। কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁদের বাড়ীতে দুইদিন অবস্থান করেছিলেন। বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যের বড় মিলনমেলা সেখানে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দৈনিক পূর্বকোণের পৃষ্ঠপোষকতায় ঢেউয়া গ্রামে নজরুল জন্মজয়ন্তী উদযাপিত হতো। মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর সার্বিক তত্ত্বাবধানে এ অনুষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠিত হতো। তিনি এখন জৈবিকভাবে বেঁচে না থাকলেও কর্মগুণে তিনি আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন, থাকবেন অনন্তকাল ধরে। কারণ কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।

লেখক : কলামিষ্ট, পরিবেশকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট