চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পোস্ট গ্রাজুয়েট সার্জারি একাডেমিয়া : উজ্জ্বল স্মৃতিময় দুদিন

২১ মার্চ, ২০২৩ | ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ঘড়ির কাঁটা সবেমাত্র সকাল আটটা ত্রিশের ঘর ছুঁয়েছে অমনি চিটাগাং ক্লাবের মিলনায়তনের মাইকে সবাইকে সচকিত করে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের শুভ সূচনার ঘোষণা এলো। ১৬-১৭ মার্চ ২০২৩, মেডিকেল উচ্চশিক্ষা আর প্রশিক্ষণের জন্য নিবেদিত Post Graduate Academia Surger’র প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিতে আসা ডেলিগেটদের সবাই তখনও এসে পৌঁছেনি কিন্তু সময়নিষ্ঠ এই প্রতিষ্ঠানের অপেক্ষার সংস্কৃতি নেই, আর নেই অযৌক্তিক সময়ক্ষেপণের লম্বা উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, নেই চোখধাঁধানো মঞ্চসজ্জা, নেই রঙ্গিন তোরণ-ব্যানার ফেস্টেুনের ছড়াছড়ি। রাতের বেলায় আলোকসজ্জার বাহুল্যও সযত্নে অনুপস্থিত। নেই পুষ্পমাল্য, ক্রেস্ট কিংবা তোষামদীর আতিশয্য।
ঘড়ির কাঁটা বক্তাদের সময় নিয়ন্ত্রণ করবে, কোন ব্যক্তি নয়। অনাড়ম্বর রেজিস্ট্রেশন কিট এর সবচেয়ে বড় সম্পদ বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনায় ঠাসা অনুষ্ঠানসূচি সমৃদ্ধ এক নজরকারা ব্রসিউর, যার শীর্ষে রয়েছে ডা. ম. রমিজউদ্দিন চৌধুরীর সুনিপুণ হাতেগড়া একাডেমিয়ার অভিজাত ‘লোগো’, যা একনজরে সংগঠনের রুচি আর প্রত্যয়ের কথা বলে একইসাথে। বাংলাদেশ, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তিন শতাধিক বিশেষজ্ঞ সমবেত এই মহা আয়োজনে। দেশের বরেণ্য শল্যবিদ, ক্যান্সার, অ্যানেসথেসিয়া, রেডিওলজি, স্ত্রীরোগ-বিশেষজ্ঞদের মহামিলনমেলা এই ঐতিহ্যনগরীতে। মহামূল্যবান সময়ের প্রতিটি মুহূর্তের যথাযথ সদ্ব্যবহারের জন্য সারাটা দিনে ছিল বৈচিত্র্যময় আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ভিত্তিক বৈজ্ঞানিক অধিবেশনের সমাহার।
সকালের সূচনা ছিল পাকস্থলী, বৃহদান্ত্র, মলদ্বারের ক্যান্সার নিয়ে মৌলিক গবেষণাপত্রের উপস্থাপনা। তরুণ গবেষকদের বুদ্ধিদীপ্ত উপস্থাপনা আরো শানিত হয়েছে অভিজ্ঞদের প্রশ্নোত্তর আর মতামতের সংযোজনীতে। তারপর একে একে উপস্থাপিত হয়েছে চিকিৎসাশিক্ষা-প্রশিক্ষণ আর গবেষণায় নীতি-শৃঙ্খলা, পরিকল্পনা আর কর্মজীবনের বাস্তব অভিজ্ঞতার সুষম উপস্থাপনা, বাদ যায়নি চিকিৎসক-রোগীর পারস্পরিক আস্থা অর্জনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল পর্যালোচনাও। আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে রোগীদের বিদেশ গমনের প্রবণতা হ্রাসের বিষয়টিও ছিল আলোচ্যসূচির তালিকায়।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিল একাডেমিয়ার বিগত দিনের পথযাত্রা আর ভাবনা নিয়ে এক অসামান্য পরিবেশনা। তরুণ সহযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে অধ্যাপক খন্দকার একে আজাদের প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় প্রতিধ্বনিত হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের একাগ্র দৃঢ়তায় জন্ম নেয়া আশাবাদ, যা আগামীর স্বাস্থ্যব্যবস্থায় এক আশাবাদী প্রত্যয়ের শুভ সূচনার নিশ্চয়তার কথাই বলেছে বারবার। ক্যান্সার-চিকিৎসার সাম্প্রতিকতম স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘টিউমার বোর্ড’ অর্থাৎ যথাযথভাবে সফলতার লক্ষ্যে ক্যানসার-চিকিৎসার সিদ্ধান্ত এখন আর একক নয়, বরং প্যাথলজিস্ট, সার্জন, রেডিওথেরাপি বিশেষজ্ঞ, মনোবিদ এদের সমন্বয়ে কিভাবে সর্বোত্তম ক্যান্সার-চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়, সে সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে একাধিক অধিবেশনে। বাদ যায়নি ক্যানসার বিজয়ীদের বিজয়গাঁথার হৃদয়স্পর্শী অভিজ্ঞতা আর পথযাত্রার বিবরণী। নতুনত্বের আস্বাদভরা পরিবেশনা ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভিন্নমত- ভিন্নপথের যৌক্তিক উপস্থাপনা নিয়ে চৌকস তার্কিকদের প্রাণবন্ত বিতর্ক। তারুণ্যকে উৎসাহিত করতে তরুণ সার্জনদের অপারেশন দক্ষতার প্রদর্শনীও ছিল অনুষ্ঠানসূচিতে, অভিজ্ঞদের বিচক্ষণ দৃষ্টি সেগুলো মূল্যায়ন করে পুরষ্কৃত করেছে নিখুঁত আর পারদর্শীদের। সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাফি, প্যাথলজি, এমআরআই, সিটি স্ক্যানের গুরুত্ব কতটা সেটার অসাধারণ উপস্থাপনা হয়েছে সুদীর্ঘ আর প্রাণবন্ত প্রশ্নোত্তরে।
শেষ বিকালের ক্লান্তি আর জড়তা নিমিষেই কেটে গেছে দিনের শেষ অনুষ্ঠান- তরুণ চিকিৎসকদের জন্য চিকিৎসাবিজ্ঞানের আধুনিকতম বিষয়াবলী নিয়ে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কুইজ প্রতিযোগিতায়। শীতোষ্ণ সন্ধ্যায় ছিল চিকিৎসক আর ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব পরিবেশনায় কণ্ঠ, যন্ত্র আর নৃত্যের এক নিটোল আর অনবদ্য সাংস্কৃতিক আয়োজন। অপসংস্কৃতিকে সযত্নে পাশ কাটানো এই মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা ছিল এককথায় অসাধারণ।
দ্বিতীয় দিনের সকাল শুরু হয়েছে আরেক অনন্য আয়োজনে। সিএসআরএস এর তিনটি অপারেশন থিয়েটারে যুগপৎ সম্পন্ন হওয়া স্তন, পাকস্থলী ও মলদ্বার ক্যান্সারের তিনটি অপারেশন সরাসরি পর্দায় পরিবেশিত হয়েছে চিটাগাং ক্লাবের মিলনায়তনে। দেশবরেণ্য শল্যবিদদের এই শল্যশিল্প প্রদর্শনী বর্ণনা আর প্রশ্নোত্তরে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের তরুণ চিকিৎসকদের।
সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী শিক্ষনীয় আর পেশাদারিত্বের অপূর্ব সমন্বয়ের এই আয়োজনের আয়োজক দল শুধু অভিনন্দিত হবারই নয় বরং এদেশে চিকিৎসাসেবায় যে ভবিষ্যৎ সম্ভবনার দিগন্ত তারা উন্মোচন করেছে, সেটা নিছক সাদামাটা বিশেষণে আবৃত হবার নয়। সহস্র আশাবাদ তাদের নিয়ে আর সাথে অগণিত শুভকামনা।

মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল
অধ্যাপক, টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ;
সভাপতি, সোসাইটি অব সার্জনস অব বাংলাদেশ (২০১৪-২০১৭)

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট