চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

পবিত্র শবে বরাতের আমল ও মর্যাদা প্রসঙ্গে

অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান  

৬ মার্চ, ২০২৩ | ৯:৩২ অপরাহ্ণ

আরবি বর্ষপঞ্জির অষ্টম মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতকে বলা হয় ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য রাত্রি। যার আরো চারটি নাম রয়েছে, যেমন -লাইলাতুর রহমত, লাইলাতুল বরাত, লাইলাতুল মোবারাকা ও লাইলাতু শাক। (তাফসীরে জালালাইন সুরা দোখানের ব্যাখ্যা, মেশকাত শরীফ পাদটীকা)।

 

লাইলাতুল বরাত (সৌভাগ্যের রজনী) আরবি ভাষার শব্দ, যা আমাদের কাছে শবে বরাত (ফারসি ভাষার শব্দ শব অর্থ রজনী) নামে পরিচিত। ইসলামের প্রারম্ভিক কাল থেকে গোটা মুসলিমবিশ্বে এ রাত অত্যন্ত মর্যাদার সাথে মহিমান্বিত রজনী হিসেবে পালিত হয়ে আসছে, যার অস্তিত্ব কোরআন হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।

 

দলিল দুই প্রকার। এক) দলিলে আক্বলি বা বুদ্ধিদীপ্ত প্রমাণাদি। দুই) দলিলে নকলী, বা সূত্র ও তথ্যগত প্রমাণাদি। উভয় প্রকার দলিলই শরীয়তস্বীকৃত। শবে বরাত এই দুই প্রকার দলিল দ্বারা প্রমাণিত। ১ম প্রকারের উদাহরণ হচ্ছে, প্রায় চতুর্দশ শতাব্দি ধরে শবেবরাত পুরো মুসলিমবিশ্বে পালিত হয়ে আসছে, যাকে তাআম্মুলুন্নাস (মানুষের প্রচলিত ধর্মীয় রীতি) বলা হয়। এটা শরীয়তের বড় দলিল। কারণ প্রিয় রসূল পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন- ‘লা তাজমায়ু উম্মতি আলাদ দোয়ালালাহ, এত্তাবেয়ু আস সওয়াদাল আজম।’ (অর্থাৎ আমার উম্মত গোমরাহির উপর ঐক্যবদ্ধ হবে না, ফিতনার সময় তোমরা বড় দলকে অনুসরণ কর।) আল্লামা ইবনে হাজর আসকালানী (রহ) বলেন-কোন বিষয় যখন প্রসিদ্ধি লাভ করে, সকলে আমল (পালন) করে, তখন ইহা হাদীসে মশহুরের স্থান লাভ করে, যদিও এর সমর্থনে কোনো দলিল না থাকে  (শরহে নোখবা)। আর দ্বিতীয় প্রকার বা দলিলে নকলী হল- কোরআনের সূরা দুখানের ৩ নম্বর আয়াতে আল্লাহ পাক বলেন,’ নিশ্চয়ই আমি বরকতময় রাত্রিতে কোরআন অবতরণ করেছি। অবশ্যই আমি সতর্ককারী।’এ রাত্রে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় ফয়সালা করা হয়।

 

‘ইমাম জালালুদ্দীন সুয়ূূতী (রহ.) তাঁর তাফসীরে জালালাইন গ্রন্থে এ আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, এ রাত হলো লাইলাতুল কদর কিংবা শাবান মাসের মধ্য রাত। (পৃষ্ঠা ৪১০) প্রখ্যাত মুফাসসির তাবেঈ হযরত ইকরামা (র.) এ রাতকে শাবান মাসের মধ্য রাত্রি অর্থ গ্রহণ করেছেন। তাছাড়া হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হযরত কাতাদা (রা.), ইবনে জুবায়ের (রা.), ইমাম হাসান বসরী (র.) সহ অধিকাংশ মুফাসসিরগণ এই মত পোষণ করেছেন। (তাফসীরে রুহুল মাআনী, ২৫ নং খন্ড, পৃষ্ঠা নম্বর ১১০-১১১)।

 

হাদিস-১, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, রাসুল পাক সাল্লাল্লাহু ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেছেন, শাবান মাসের মধ্য রাত্রিতে আল্লাহপাক রহমতের ভান্ডার নিয়ে সকল সৃষ্টির প্রতি এক বিশেষ ভূমিকায় আবির্ভূত হন এবং ওই রাত্রিতে মুশরিক এবং হিংসুক ব্যক্তি ছাড়া সকলকে ক্ষমা করে দেন। (তাবারানী, আল আওসাত, বায়হাকী, শুয়াবুল ঈমান, পৃ-৩৮২)।

 

হাদিস-২, হযরত আয়েশা (র.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি একদা এক রাত্রিতে রসূল (সা.) কে হারিয়ে ফেললাম এবং তাঁকে তালাশ করার জন্য বেরিয়ে পড়লাম। একপর্যায়ে জান্নাতুল বাকিতে গিয়ে তাঁকে পেলাম। আমাকে দেখে তিনি বললেন, হে আয়েশা তুমি কি মনে করছো, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার উপর জুলুম করবেন? হযরত আয়েশা বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমি মনে করেছি হয়তো আপনি আপনার অন্য কোন স্ত্রীর নিকট গমন করেছেন। অতঃপর আল্লাহর রাসূল বললেন, নিশ্চয়ই মহান আল্লাহ শাবান মাসের মধ্য রাত্রিতে প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বনুক্বালবের এর ছাগলের লোম এর চেয়ে ও  অধিক সংখ্যক লোককে ক্ষমা করে দেন। (তিরমিজি, প্রথম খন্ড, পৃষ্ঠা ১৫৬)।

 

হাদিস-৩, হযরত উসমান বিন আবিল আস (র.) হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি এরশাদ ফরমান, যখন শাবান মাসের মধ্য রাত্রির আগমন ঘটে, তখন আল্লাহপাক  এই মর্মে ঘোষণা দেন-কোন ক্ষমাপ্রার্থী কি আছো? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোন সাওয়াল কারী আছো? আমি তাকে দান করব। কেউ কোন কিছু চাইলে তাকে তা দান করা হবে, তবে কোন ব্যভিচারি ও মুশরিক ব্যক্তিকে ক্ষমা করা হবে না। (বাইহাকী, শুয়াবুল ঈমান, তৃতীয় খন্ড, হাদিস নম্বর ৩৮৩)।

 

হাদিস-৪, হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন হুজুর আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এরশাদ করেছেন- যখন শাবান মাসের মধ্য রাত্রির আগমন ঘটে তখন তোমরা সে রাত্রে জাগরন থেকে আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকো, দিনের বেলায় রোজা পালন করো, মহান আল্লাহ সেদিন সূর্যাস্তের পর প্রথম আকাশে অবতরণ করেন এবং বলেন-কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী কি আছো? আমি তাকে ক্ষমা করে দেব। কোন রিযক  তালাশকারী আছো? আমি তাকে রিযিক দান করব। বিপদগ্রস্ত ব্যক্তি আছো? আমি তাকে বিপদমুক্ত করব। এভাবে ভোর হওয়া পর্যন্ত আল্লাহর পক্ষ থেকে ঘোষণা আসতে থাকে। (ইবনে মাজা, পৃষ্ঠা ১০০, হাদিস নম্বর ১৩৮৮) এরূপ বিভিন্ন হাদীসগ্রন্থে এ বিষয়ে আরো অনেক বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণিত রয়েছে।

 

ফয়জুল বারী কিতাব প্রণেতা আনোয়ার শাহ কাশ্মিরী বলেন, লাইলাতুল বরাত রাত্রের মর্যাদা সম্পর্কিত বর্ণনাসমূহ সহিহ অর্থাৎ বিশুদ্ধ। এ রাত্রির মর্যাদা সম্পর্কিত বর্ণিত হাদিসগুলোকে যারা দুর্বল ও বানোয়াট  বলেছেন, তাদের বক্তব্যের কোনো ভিত্তি নেই (আল আরফুশ শাযী ফি শরহি জামে তিরমিজী, পৃ. ১৫৬)।

 

আহলে হাদিসদের ইমাম নাসির উদ্দিন আলবানী বলেন, সারকথা হলো নিসফে শাবান এর রাত্রির মর্যাদার উপর বর্ণিত হাদিসগুলো বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে নিঃসন্দেহে সহি হাদিস হিসেবে বিবেচিত। (সিলসিলাতুল আহাদীসুস সহীহাহ, ৩য় খন্ড, ১৩৮ পৃষ্ঠা) ওয়াহাবীদের শেখ মুফতি শফি লিখেন- সাহাবাগণ ও তাবেয়ীগণ শবে বরাতের রাত্রে জাগরন থাকতেন এবং সুন্নত মোতাবেক আমল করতেন। এ রাত্রের মর্যাদা নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। (দরসে তিরমিজি, দ্বিতীয় খন্ড, পৃষ্ঠা ৫৮০)  মোদ্দা কথা হল, কোরআন-হাদিস দ্বারা অকাট্যভাবে প্রমাণিত এই বরাতের রজনীতে মুমিনদের জন্য আল্লাহর ইবাদতের মাধ্যমে তাঁর নৈকট্য অর্জনের একটি মোক্ষম সুযোগ। এই ইবাদতে যারা মানুষকে নিরুৎসাহিত ও বিভ্রান্ত করে, তারা নিশ্চয়ই কপট মুসলমান।

 

আল্লাহপাক কোরআনে পাকে এরশাদ করেন- মুনাফিকরা একথলের, একই বস্তু যারা অসৎ কর্মের নির্দেশ দেয় এবং সৎকর্মের নিষেধ করে। (সূরা তওবা, আয়াত ১৮৪)। ভালো কাজে প্রবল বাধা প্রদানকারী, তারা সীমালংঘনকারী, পাপিষ্ট। (মান্নায়ীল লীলখাইরি, মুতাদিন আসিম। সূরা ৬৮, আয়াত ১২) বর্তমানে কিছু মিডিয়ামোল্লা বিভিন্নভাবে লাইলাতুল বরাত নিয়ে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন, তারা কোন প্রকৃতির লোক? কোরআন হাদিসের দৃষ্টিতে তাদের মূল্যায়ন করা এখন সময়ের দাবি।

 

লেখক: মোহাম্মদ শাহজাহান, সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ছোবহানিয়া আলিয়া কামিল মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট