চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়-পুরানো সেই দিনের কথা

আবদুল মান্নান

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ | ৫:৫৪ অপরাহ্ণ

আজ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগ তার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে। এই বিভাগের সকল সাবেক শিক্ষার্থী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের জানাই অভিনন্দন।
কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড হতে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাশ করে ১৯৬৭ সালে ভর্তি হয়েছিলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগে। তখন বাণিজ্য বিভাগ ছিলো কলা অনুষদের অধিনে। ১৯৬৯ সত্তরে ছাত্র আন্দোলনের মুখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সৃষ্টি করেন বাণিজ্য অনুষদ। সেই আন্দোলনে আমার বেশ সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। ১৯৭০ সালের শেষের দিকে শুরু হয় অনার্স পরীক্ষা। বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স পরীক্ষার মাঝপথে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শুনে আমরা কয়েক বন্ধু পরদিন দুপুরের গ্রীণ এরো ট্রেন যোগে বিনাটিকেটে ঢাকা ছেড়েছিলাম। সেই দিন কমলাপুর রেল স্টেশনে টিকেট বিক্রি করার কেউ ছিলো না। সে দিনের সকলে পরবর্তিকালে নিজের অবস্থান হতে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। যুদ্ধ শেষ হলে আমাদের বাকি দুই পেপারের পরীক্ষা আর হয় নি। সেবার প্রথম শ্রেণিতে পাশ করেছিলাম। যুদ্ধ শেষে ফিরে গেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৭২ সালের শেষের দিকে শুরু হয় আমাদের শেষ বর্ষের পরীক্ষা। আমরাই হলাম সেই অনুষদের প্রথম স্নাতক। ফলাফল প্রকাশিত হলো ১৯৭৩ সালের মে মাস নাগাদ। ব্যবস্থাপনা বিভাগে তিনজন প্রথম শ্রেণি পেয়েছিল। প্রথম হয়েছিলাম আমি। আমার শিক্ষক ড. আবদুল্লাহ ফারুক ও ড. হাবিবুল্লাহ অনুরোধ করেছিলেন যেনো আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেই। কেন জানি আমার ঢাকা থাকাটা পছন্দ হয়নি। কি করবো তারও কোন সিদ্ধান্ত নেই। ফিরলাম চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামে ফেরার পর অনেকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে সময় কাটছে। বাড়ীতে যখন খাবার আছে চিন্তা কিসের! আমাদের পাড়ায় থাকেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আবুল ফজল। তাঁর দুই ছেলে আবুল মনসুর ও আবুল মোমেন আমার বন্ধু। প্রায় প্রতিদিন তাদের বাসা ‘সাহিত্য নিকেতন‘এ যাই। তাঁর স্ত্রী আমাদের পড়শি সাহিত্যিক মাহবুবুল আলমের বড় মেয়ে বেগম উমরুতুল ফজল।
আমাকে তাঁর পুত্রদের মতো স্নেহ করেন। গেলেই কিছু একটা খেতে দেন। মনসুর মোমেনের সাথে আড্ডা হয়। এরই মধ্যে মনসুর ও মোমেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পাশ করেছে। মোমেন ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়েছে আর মনসুর চারুকলার স্নাতক। একদিন আবুল ফজল সাহেব জানতে চাইলেন আমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে কিনা। শেষ হয়েছে জানালে তিনি বললেন চট্টগ্রামের ছেলের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেয়া উচিত। ১৯৬৬ সালে যাত্রা শুরু করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে কিছু কলেজ শিক্ষক ও কিছু অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিয়ে চলছিল। চারটি বিভাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল। কিন্তু যখন বাণিজ্য বিভাগ চালু হয় তখন প্রায় সব শিক্ষকই আসেন কলেজ হতে। রাজি হই। তিনি তাঁর বিশ্বস্থ গাড়ীচালক ওসমানকে বললেন পরদিন যেনো ও আমাকে আবেদনের এক সেট ফরম এনে দেয়। ওসমান একটু চাপা স্বভাবের। উপাচার্য মহোদয়ের মার্সিডিজ বেন্জ গাড়ী চালান। তখনকার দিনে উপাচার্যদের সম্মানই আলাদা। ওসমান আমার কাছ হতে দশ টাকা ফরম ক্রয় বাবদ চেয়ে নিলেন। পরদিন ও আমাকে ফরম এনে দেয়। দুদিন বাদে তা পূরণ করে আমি ওসমানের হাত দিয়েই তা জমা দিই।
তখন পর্যন্ত অমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় দেখি নি। এর মাসখানেক পর সাক্ষাৎকারে চিঠি আসে। চট্টগ্রামের লালদীঘির পার হতে নাজির হাটের বাসে চেপে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নম্বর রাস্তার মুখে নামি। তখনই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার একমাত্র রাস্তা ছিল এটি। বেশ আঁকা বাঁকা। চারিপাশে ধানক্ষেত। রিকসাভাড়া কাঁঠালতলা পর্যন্ত দশআনা। তারপরে বেশ চড়াই। সেখানে নেমে হেঁটে উপাচার্যের দপ্তরে। জীবনের প্রথম চাকুরির সাক্ষাৎকার। উপাচার্যের আর্দালি বদিউল আলম। বেশ লম্বাচওড়া। পেঠানো শরীর। এর আগের সব উপাচার্যের আর্দালি ছিলেন। আমার সময়ও। এমন দায়িত্বশীল ও সৎ মানুষ কম হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন অনুষ্ঠান হলে সাদা আচকান পেন্টের সাথে পরতেন বেশ মানানসই একটি পাগড়ি। তিনি আমাকে একটি রূমে নিয়ে বসালেন। ডাক পড়লো ভিতরে। গিয়ে দেখি বোর্ডে উপাচার্য ছাড়াও আছেন আরো দুই সদস্য। একজন বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ শামসুজ্জোহা, অন্যজন ড. হাবিবুল্লাহ। দু’জনই আমার শিক্ষক। প্রশ্ন তেমন একটা কিছু করা হলো না। ৫ আগস্ট ১৯৭৩ সালে চিঠির মাধ্যমে আমাকে জানানো হয় আমাকে ব্যবস্থাপনা বিভাগে চারশত পঞ্চাশ টাকা বেতনে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পরদিন বিভাগে গিয়ে যোগ দেই। কিছুদিন পর ক্লাস বন্টন বা বিষয় বন্টন হয়। তখন বাণিজ্য অনুষদ ছিল স্কুল ভবনে।
কয়েকটি কক্ষ নিয়ে অনুষদ। শিক্ষকদের বসার নিজস্ব কোন কক্ষ ছিল না। কেউ বসতে চাইলে বিভাগীয় প্রধানের কক্ষে বসতে হতো। সেইবারই বাণিজ্য অনুষদে অনার্সে ছাত্র ভর্তি করা হয়েছে। প্রথম ব্যাচে মাত্র কুড়িজন। আমাকে দেয়া হলো ইঁংরহবংং ঈড়সসঁহরপধঃরড়হ পড়াতে। এই বিষয়টা কেউ পড়াতে চান না কারণ পড়ানোর মতো কোন বই তখন পাওয়া যেতো না। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারেও নেই। অনেক কষ্টে বৃটিশ কাউন্সিল ও ইউএসআইসে (মার্কিন তথ্যকেন্দ্র) বসে কিছু পড়ানোর বিষয় যোগাড় হলো। নিজের কাছে তা বেশ মূল্যবান। সব হাতে লেখা নোট। তখনো ফটো কপি বলে কোনে প্রযুক্তির আবির্ভাব ঘটেনি। বিভাগের সহকারি শাহ আলম আমার নোটগুলো টাইপ করে দেন। একসময় মোটামুটি একটা ছোটখাট বই হয়ে গেলো। প্রথম অনার্স ক্লাসে যাদের নাম মনে আছে তারা হচ্ছে নূরুন নবী (বর্তমানে লন্ডনে একটি কলেজের বেশ সফল অধ্যক্ষ), প্রদানেন্দু বিকাশ চাকমা (ড. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, রাঙ্গামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বর্তমানে প্রয়াত), মোহাম্মদ ইকবাল।
বছর দুই বিশ্ববিদ্যালয় স্কুলভবনে থাকার পর একসময় অনুষদ কলা ভবনে স্থানান্তর করা হলো। তখন কিছু বাড়তি রুম পাওয়া গেলো। প্রভাষক হিসেবে যোগ দেয়ার পর সরকার বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য একটি নূতন আর্থিক সুবিধা ঘোষণা দিলেন। যারা সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণি পেয়েছে তারা একটি পঞ্চাশ টাকার বাড়তি ইনক্রিমেন্ট পাবেন। আমি এই ইনক্রিমেন্টের জন্য আবেদন করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-হিসাব রক্ষক আবু সুফিয়ান নীচে থেকে নোট দিলেন যেহেতু আমি প্রজ্ঞাপনের আগে যোগ দিয়েছি সেহেতু এই সুবিধা আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। এই ইনক্রিমেন্ট আর আমার পাওয়া হলো না। কোন দেন দরবারেও কাজ হলো না। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। সুফিয়ান সাহেব উপ-হিসাব রক্ষক হতে অবসরে যাওয়ার আগে আমার সাথে দেখা করতে আসলে তাঁকে আমি সেই ইনক্রিমেন্টের কথা স্মরণ করিয়ে দিলে তিনি তাঁর পূর্বের সিদ্ধান্তে অটল রইলেন। খুব ভালো ও সৎ মানুষ ছিলেন আবু সুফিয়ান। নূতন যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশে চারিদিক সবকিছুর দাম চড়া। মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষের দাম। উপাচার্য আবুল ফজল সাহেব বঙ্গবন্ধুর সাথে দেন দরবার করে শিক্ষক, কর্মকর্তাদের জন্য রেশনের ব্যবস্থা করলেন। পনের দিনে দুই কেজি গম আর আধ কেজি চিনি। নির্ধারিত দিনে শিক্ষকরা খালি বস্তা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন আর ফেরার সময় রেশন নিয়ে বাড়ী ফিরতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেয়ার পর পরিচিত হয়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে। তাঁরাই সূচনা করেছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সোনালি যুগ। সব প্রতিথযশা শিক্ষক। এঁদের কেউ কেউ অন্য বিশ্ববিদ্যালয় হতে আসলেও অনেকে এসেছিলেন সরকারি কলেজ হতে। সত্তরের দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল দেশের সেরা প-িত গবেষকদের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিশ্ববিদ্যালয়ে ধারণক্ষমতা সর্বসাকুল্যে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী। নাজিরহাট ট্রেনের পিছনে দু’টি কামরা বাধাঁ থাকতো শহর হতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আনা নেয়ার জন্য। দুই নম্বর রাস্তার মাঝখানে ক্ষণিকের যাত্রাবিরতি। সেখান হতে ভাড়া করা বাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের আনা নেয়া হতো। শিক্ষার্থীর সংখ্যা সীমিত থাকলেও ক্যাম্পাস সব সময় খেলাধূলা আর সংষ্কৃতি কর্মকা-ে মূখরিত থাকতো।
তখন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অনেক শান্ত ছিল। পরিবেশ ছিল মুক্ত। এখনকার মতো অবরোধ, হানাহানি তখনো চালু হয় নি। আমরা বিভাগে যে ক’জন শিক্ষক ছিলাম তাদের মধ্যে সম্পর্ক ছিলো অনেকটা বড় ভাই ছোট ভাইয়ের মতো। সত্তরের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষদের জন্য পেশাগতভাবে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিলো, যা এখন কল্পনাও করা যায় না। ১৯৭৬ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি বৃত্তি নিয়ে সেই দেশে উচ্চশিক্ষার্থে চলে যাই। ফিরে এসে বিভাগে যোগ দেই। ১৯৯৬ সালে অনেকটা গণভবনে ডেকে নিয়ে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী আমাকে উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে বললে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম, কারণ আমার চেয়ে সিনিয়র অনেক শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছিলেন। তাঁকে এই কথা জানালে তিনি সরাসরি জানিয়ে দিলেন যে কারণে তিনি আমাকে এই দায়িত্ব দিতে চান তাঁর বিশ্বাস অন্যরা তা সহজে পারবেন না। কারণটা ছিলো একটি ছাত্র সংগঠনের কাছে অবরুদ্ধ হয়ে থাকা ক্যাম্পাসকে মুক্ত করা। ১৯৯৭ সালের ৬ নভেম্বর উপাচার্যের পদে যোগ দিয়েছিলাম। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছিল আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কর্মক্ষেত্র। প্রাপ্তি অনেক। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আমার ঋণ শোধ হওয়ার নয়।

আবদুল মান্নান
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য

ও বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট