চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্মরণ : মাস্টার মুহম্মদ নূর

মুহম্মদ আবু তৈয়ব

২০ আগস্ট, ২০১৯ | ১:০৬ পূর্বাহ্ণ

নূর স্যারের মৃত্যুতে এলাকাবাসী ও পড়–য়ারা শোকাহত। তিনি ছিলেন কর্মে উদ্যমী, স্বপ্নে উজ্জীবিত সমাজ সচেতন মানুষ। সন্তানের অভিভাবক হওয়া সহজ, কিন্তু সকল পড়–য়ার, এলাকাবাসির অভিভাবক হওয়া কঠিন। সেই কঠিন বিষয়টি তিনি করতে পেরেছিলেন। এমন অভিভাবকটি চলে গেল অতি নীরবে গত ১৮ এপ্রিল ২০১৯।
আশির দশকের কথা। অন্ধকারের প্রতাপ বেশি কারণে প্রগতিশীল ও আলোকিত মানুষরা সংখ্যায় নগণ্য হওয়ায় তিমির হনন করে তেমন এগুতে পারছিল না। তখন প্রগতিশীল মানুষদেরকে গ্রাম বাংলায় হাজারো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। সেই সময়কার আলোকিত যে কয়েকজন পশ্চিম পটিয়ায় মানুষ ছিলেন তাদের মধ্যে বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী আলহাজ্ব মাস্টার মোহাম্মদ নূর অন্যতম। তিনি তার অনুসারীদের আলোকাভিসারি করতে সচেতনভাবে সচেষ্টা থাকতেন।
যার জন্য তিনি হয়ে উঠেছিলেন এলাকার অভিভাবক। পড়ুয়াদের তিনি বেশি ভালবাসতেন ও পড়ার ব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিতেন। এলাকায় প্রায় পড়–য়ারা তাঁর ¯েœর্হাদ্র হৃদয়ের ভালবাসা পেতেন। যে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হোক না কেন তাঁর ভালবাসা থেকে কোন শিক্ষার্থী বঞ্চিত হত না।
তিনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। আবার সামাজিক নানা বিষয়েও সক্রিয় থাকতেন। তিনি জানতেন শুধু পাঠদান করলে সার্থক শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষাদানে আন্তরিকতাও লাগে। শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার জন্য অর্থ ও শ্রেণি কক্ষের চেয়ে শিক্ষকের আন্তরিকতা বেশি প্রয়োজন। তা তাঁর মধ্যে ছিল। আমরা নিজেদের মধ্যে কেউ বাকি নেই তাঁর হাত হতে পুরস্কার গ্রহণ করেনি। তিনি দূরের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করলেও আমাদের গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়েও মাঝে মাঝে আসতেন। ‘অভিলাষ’ নামক ছড়াটি বলতে পারায় স্যার আমাকে একটি পেন্সিল ও তখনকার দিনের একটি কাঠের স্কেল পুরস্কার দিয়েছিলেন।
একজন পড়–য়ার বিকাশের তিনটি দিক থাকে। শারীরিক, মানসিক ও আবেগিক। আবেগিক বিষয়গুলো ইতিবাচকভাবে স্পর্শ করতে পারলে আপন হওয়া যায়। বন্ধু হওয়া যায়। কিন্তু অনেক অভিভাবক, শিক্ষক সে আবেগী বিষয়টি গুরুত্ব দেন না। এজন্য অনেক অভিভাবক রাতদিন পরিশ্রম করে সন্তানকে ভাল ভাল খাবার যোগান দিয়ে, শিক্ষক বিদ্যার বহর শেখানোর পরও তাঁরা পড়–য়ার বন্ধু হতে পারে না, আপন হতে পারে না।
রাস্তা, মসজিদ, ফোরকানিয়া, স্কুল সংস্কার বা নিমার্ণে ব্যস্ত থাকতেন। আবার অসহায়, নির্যাতিত মানুষের বিপদ আপদে সাড়া দিতেন। নূর স্যারও তাঁদের পাশে ছুটে যেতেন, সাহায্য করতেন। আর্থিক সংকটগ্রস্থ পরিবারের মেয়ের বিয়েতে অর্থ দিয়ে, পরামর্শ দিয়ে তাদের পাশে থাকতেন। প্রয়োজনে বিত্তবান সুহৃদদের দিকে হাত পাততে কসুর করতেন না।
আমাদের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য এখনও আছে। তখন আরও প্রকট ছিল। আর যেখানে শ্রেণিবৈষম্য সেখানে অন্যায়, অবিচার, জুলুম শোষণ ইত্যাদি চলে। এমন সমাজে তিনি বিত্তবানদের সাথে থাকলেও গ্রাম্য শালিশী বৈঠকে নির্যাতিত ও অসহায়দের পক্ষ নিতেন। যার জন্য তাঁকে নানা হেস্তন্যস্ত হতে হত, নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করতে হত। তবে তিনি সহজে দমে যেতেন না। দমবে বা কেন, তিনি তো কাজ করেন সমাজের জন্য, মানুষের জন্য।
জীবনের শেষ ধাপ পৌঢ়ত্বে এসেও তিনি সজীব ও সক্রিয় ছিলেন। তাইতো তিনি শেষ বয়সে এসেও চমৎকার বুড়া বা অভিজ্ঞ মানুষ হিসাবে থাকতে পারার সম্মান অর্জন করে ছিলেন। কারও ওপর নির্ভরতা পছন্দ করতেন না। সব কিছু নিজে করার চেষ্টা করতেন। নিজেই সবকিছু গুছিয়ে রাখতেন। সেই গুছানো কাজ মৃত্যুর আগ পর্যন্ত করা সম্ভব হয়েছিল। তিনি আশা করতেন কাউকে কষ্ট না দিয়ে হুট করে চলে যাওয়া ভাল। তিনি তাঁর আশা মত দুুনিয়া থেকে বিদায় নিতে পেরেছেন। তিনি ধার্মিক ছিলেন কখনও ধর্মান্ধ ও উগ্রমৌলবাদীদের পছন্দ করতেন না। আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন না।
মাস্টার মোহাম্মদ নূর বুঝতেন শিক্ষাই পারে জৈবিক ব্যক্তিকে নৈতিক ব্যক্তিতে রূপান্তর করতে। শিক্ষাই মানুষের চেতনায় সত্যনিষ্ঠা, সৌন্দর্যবোধ ও মানবিক কল্যাণবোধ জাগিয়ে তোলে। পড়–য়ারা, এলাকাবাসীরা যাতে সেই মানবিক হওয়ার পথে হাঁটে সেই জন্যই তিনি এত ছুটাছুটি করে গেছেন, এই ¯েœহার্দ্র ও হৃদয়বান মানুষটি।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট