কলেজের গেইটে অনেক পরীক্ষার্থী দাঁড়িয়ে আছে। এদের সাথে গার্ডিয়ানেরাও অপেক্ষা করছে। কারো সঙ্গে মা এসেছে, কারো সঙ্গে বাবা এসেছে।
আবার অনেকের সঙ্গে মা-বাবা দু’জনই এসেছে। এগারটায় পরীক্ষা শুরু হবে, সাড়ে দশটায় গেইট খুলবে। গেইটের কাছে ভীড় জমে গিয়েছে। রাস্তায়ও অনেকে দাঁড়িয়ে আছে। ট্রাফিক পুলিশ রাস্তায় যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু মোড় থেকে যানজট লেগে আছে। গাড়ি ছেড়ে অনেকে পায়ে হেঁটে চলে আসছে। পরীক্ষার্থীর চেয়ে অবিভাবকের সংখ্যা বেশি। কোন কোন অভিভাবক ছেলে মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে আশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পরীক্ষার হলে না ঢুকা পর্যন্ত তারা সন্তানের দিকে তাকিয়ে আছে।
ভীড় আর সামাল দিতে না পেরে কর্তৃপক্ষ পাশের ছোট গেইটটি খুলে দেয়। একজন একজন করে প্রবেশপত্র দেখে পরীক্ষার্থীদের ঢুকাতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যে অনেকে ভিতরে ঢুকে যায়। তাদের গার্ডিয়ানেরাও সরে যায়। তারপরও ভীড় কমে না। আরো পরীক্ষার্থী এসে প্রবেশ করতে থাকে। সাথে মা বাবারাও আসে। এসব ছেলে মেয়েরা এসএসসি পাশ করেছে দুই বছরেরও আগে। এখন এইচএসসি পরীক্ষা দিতে এসেছে। ঠিক সময়ে পরীক্ষা হলে এপ্রিলে হয়ে যেতো। এবার পরীক্ষা নভেম্বরে শুরু হয়ে ডিসেম্বরে শেষ হবে। তাদের কারো বয়স সতের আঠারোর কম নয়। এরা পঞ্চম শ্রেণিতে পিএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, অষ্টম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে এবং দশম শ্রেণিতে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। তিনটি পাবলিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে।
পাবলিক পরীক্ষার ভীতি আর তাদের থাকার কথা নয়। দশ বছর স্কুলের পাঠ শেষ করে দুই বছর কলেজে লেখাপড়া করে একজন শিক্ষার্থী অনায়সে পরীক্ষা কেন্দ্রে আসতে পারে। শহরের মধ্যেই এসব কলেজের সেন্টার পড়ে। যেমন চট্টগ্রাম কলেজের সেন্টার সিটি কলেজে, মহসিন কলেজের সেন্টার গার্লস কলেজে কিংবা সিটি কলেজের সেন্টার চট্টগ্রাম কলেজে বা কর্মাস কলেজে পড়ে থাকে। শহরের স্কুল কলেজে লেখাপড়া করে এত বড় হয়েও ছেলেমেয়েরা কেন একাকি পরীক্ষা হলে আসতে পারছে না। এইচএসসি পাশ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবে। সেখানেও কি বাবা-মাকে সঙ্গে যেতে হবে?
এখানে গার্ডিয়ানদেরও ভাবার বিষয় আছে যে তারা কখনো ছেলে মেয়েদের একা ছাড়তে চায় না। তাদের ধারণা ছেয়ে মেয়েরা আবার কোথায় থেকে কোথায় চলে যায়। এখনকার ছেলে মেয়েদের পিছে পিছে থাকতে হয়। ছেলে মেয়ের সাথে বাবা মাকেও লেখাপড়া করতে হয়। কোচিং সেন্টার থেকে শুরু করে সবখানে মা-বাবাকে সাথে যেতে হয়। এরকম কেন হলো? এসব ছেলে মেয়েরা স্বাবলম্বী হবে কি করে? এরাতো একাএকি কিছু করতে পারে না। না নিজের বই খাতা কিনে আনতে পারে, না ছোট খাট কাজ করতে পারে। এরা শুধু পড়া মুখস্ত করে। আর পরীক্ষায় খাতায় লিখে দিয়ে আসে। অনেক ভাল ফলাফল করে। এতেই মা বাবা আত্মীয় স্বজন সবাই খুশী। ছেলে মেয়েতো ভাল রেজাল্ট করছে। আর কি চাই? সবার ভাবনা এখন একই রকম। সচেতন মা বাবারা আরো বেশি ছেলেমেয়েকে আগলে রাখতে চায়।
অনেক ছেলেমেয়ে আছে কারো সঙ্গে মেশারও সুযোগ পায় না। এমনকি সহপাঠিদের সাথেও। এসব ছেলেমেয়েরা একেবারে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে বড় হতে থাকে। এরা সহজে অন্যের সঙ্গে মিশতে পারে না। এমনকি আত্মীয় স্বজনের কাছেও যেতে চায় না। সবকিছু থেকে দূরে দূরে থাকতে চায়। একসময়ে মোবাইলটা তাদের একমাত্র সঙ্গি হয়ে দাড়াঁয়। মোবাইলে তারা সময় কাটায়। লেখাপড়া চিন্তাভাবনা সবকিছু মোবাইলে ঢুকে যায়। ক্লাস, কোচিং, সহপাঠিদের সাথে যোগাযোগ সবকিছু মোবাইল নির্ভর হয়ে পড়ে। মোবাইলের জগৎটা তাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে। অনেকের ধারণা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এভাবে চলতে হবে। এখন ডিজিটাল যুগ। মোবাইল ছাড়া এক মুহূর্তও চলে না। সবাইতো এভাবে চলতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। মা-বাবা কখনো এর বাইরে ভাবতে পারে না। তাদের সময়টা কিভাবে কেটেছে তা একবারও ভাবতে চায়না।
এসএসসি পরীক্ষা দেয়ার সময় তাদের মা-বাবা পরীক্ষার হলে গিয়েছে কিনা কেউ বলতে পারবেনা। হাই স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ছেলেরা নিজেরাই স্কুলে গিয়েছে। মেয়েরাও একাএকা রিক্সা করে স্কুলে গিয়েছে। লেখাপড়া করেছে। স্কুলের সহপাঠিদের সাথে খেলাধুলা গল্পগুজব করে কত আনন্দেই দিন কাটিয়েছে। তখন কোন কোচিং সেন্টার ছিল না। ক্লাসে টিচারেরা যা পড়াতেন তা মনযোগ দিয়ে শুনে রাত্রে বাসায় আবার পড়ে নিলে হয়ে যেতো। প্রায় টিচারেরা তখন ক্লাসে পড়া আদায় করতেন। না পারলে খবর হতো। কোন অজুহাত শুনতেন না। বার্ষিক পরীক্ষায় পাশ না করলে উপরের ক্লাসে প্রমোশন হতো না। তখন বাবাকে বা মাকে স্কুলে গিয়ে দেখা করতে হতো। তা না হলে বাবা মা কেউ কখনো স্কুলে যেতেন না। হেড টিচারকে সবাই ভয় পেতো। কোন দুষ্টুমি করে নালিশ হলে আর রক্ষা পাওয়া যেতো না। কোন না কোন শাস্তি ভোগ করতে হতো। স্কুলের সেই নিয়ম কানুন এখন আর নেই। ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে আগের সোহার্দ্যপূর্ণ আন্তরিক পরিবেশ আর দেখা যায় না।
পৌনে এগারটার মধ্যে সব শিক্ষার্থীরা ভেতরে ঢুকে যায়। গার্ডিয়ানেরা কেউ কেউ চলে যায়। আবার অনেকে থেকে যায়। এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে বসে অপেক্ষা করে। দুই ঘণ্টা পরীক্ষা। বাসায় চলে গেলে আবার ফিরে আসা যাবে না। কারো কারো বাসা অনেক দূরে। মা-বাবার এ এক বিড়ম্বনা। এসময়ে কোথাও বসার জায়গা নেই। ফুটপাতে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়? আশেপাশে ঘুরাঘুরিরও তেমন জায়গা পাওয়া যায় না। কেউ মার্কেটে গিয়ে ঘুরে। সময় কাটায়।
কেউ কেউ কোথাও বসে দোয়া দরূদ পড়তে চেষ্টা করে। ছেলেমেয়ের পরীক্ষা চলছে। এসময়ে দোয়া দরূদ পড়লে, তাদের প্রশ্নোত্তর সহজ হয়ে যাবে। এরকম ধারণা অনেকেরই আছে। এক একটা ঘণ্টা পড়ে। মা-বাবার বুকটাও যেন কেপেঁ উঠে। ছেলেমেয়েরা ঠিকমত সব প্রশ্নের উত্তর লিখতে পারছে কিনা। এখনতো সবাই অনেক ভাল রেজাল্ট করে। ‘এ’ প্লাস আশা করে সবাই। আগে এত ভাল রেজাল্ট ছেলেমেয়েরা করতে পারতো না। ফাস্ট ডিভিশন পেলে তখন অনেক খুশি হতো। বেশির ভাগ সেকেন্ড ডিভিশনে পাস করতো। এখনতো ‘এ’ প্লাসের ছড়াছড়ি। ‘এ’ প্লাস না পেলে ভাল জায়গায় ভর্তি হওয়া যায় না। এজন্য সবাই ‘এ’ প্লাসের দিকে ছুটে।
পরীক্ষা শেষ হওয়ার দশ পনের মিনিট আগে থেকে গার্ডিয়ানেরা গেইটের সামনে এসে জড়ো হয়। ট্রাফিক রাস্তার পাশে কোন গাড়ি দাঁড়াতে দেয়না। তারপরও কিছু কিছু গাড়ি সারি করে দাঁড়িয়ে যায়। ঘণ্টা পড়ার আগে আগে অনেক মা-বাবা গেইটের সামনে ভীড় করে। সবার চোখে মুখে উৎকণ্ঠা ছেলেমেয়েরা কেমন করেছে। পরীক্ষা শেষেও একই অবস্থা, দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়। রাস্তায় টেম্পু টেক্সি যত ধরনের যানবাহন আছে সবটাতেই যাত্রী ভর্তি। কিন্তু কোন গাড়ি সামনের দিকে এগুতে পারছে না। দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে অনেক যাত্রী নেমে পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে শুরু করে। এরকম একটা অসহনীয় অবস্থা কেউ চায় না।
এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কি? এমনিতে স্বাভাবিক সময়েও রাস্তায় যানজট লেগে থাকে। এটা যেন নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার। এর প্রতিকার এত সহজ নয়। এর কারণও বহুবিধ। এ যানজটকে সহনীয় উপায়ে রাখতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। এ সমন্বিত উদ্যোগের প্রায়োগিক দিকগুলো কার্যকর করতে পারলে যানজট ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। রাস্তা গাড়ি যানজট এক সময় না এক সময়ে একটি সমন্বিত রূপ লাভ করবে। এরকম পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে থাকতে পারে না। একটা না একটা বিকল্প ব্যবস্থা বের হবে। এভাবে বছরের পর বছর দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে না। ফ্লাইওভার, এলিভেটেড ওয়ে, এক্সপ্রেস রোড, মেট্রো রেল নানাভাবে যানজট কমানোর চেষ্টা চলছে।
কিন্তু ছেলেমেয়েরা যারা নতুন প্রজন্ম ভবিষ্যতের নাগরিক হয়ে গড়ে উঠছে তাদের ব্যাপারে চিন্তা ভাবনার প্রয়োজন আছে। যেসব ছেলেমেয়েরা ষোল সতের বছর বয়সেও মা বাবার বাহুবন্ধন থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না তারা কিভাবে স্বাবলম্বি হয়ে উঠবে। এব্যাপারে মা-বাবাকেও কিছুটা ছাড় দিতে হবে। তাদের কাজ তাদেরকে করতে সুযোগ দিতে হবে। ছেলেমেয়েদের এভাবে আকড়ে ধরে থাকলে তারা কিছুই করতে পারবে না। লেখাপড়া যাতে তারা ঠিকভাবে করে তাতে লক্ষ্য রাখার প্রয়োজন।
কিন্তু তাদের স্বাচ্ছন্দে চলাফেরা করার পথে মা-বাবা যেন অন্তরায় না হয়। তবে তারা ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর রাখবে এবং কোথায় যায় তার নজরদারিও করবে। একেবারে ছেড়ে দিলে তারা আবার বিপথে চলে যেতে পারে। তাই স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে কলেজে যাওয়ার পর ছেলেমেয়েদেরকে ওদের মত করে চলাফেরা করার সুযোগ দেয়া প্রয়োজন। এতে করে সন্তানেরা ভবিষ্যতে নিজের পায়ের উপর নিজে দাঁড়াতে শিখবে এবং স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে উঠতে পারবে।
লেখক: নাসের রহমান কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংকার
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ