চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

আমাদের শিক্ষক এফ করিম স্যার ও পিনপতন নীরবতা

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন

১৯ নভেম্বর, ২০২২ | ৩:৪১ পূর্বাহ্ণ

আমাদের সময়কার সবচেয়ে আলোচিত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সার্জারির শিক্ষক ছিলেন করিম স্যার। অনেকেই আড়ালে উনার নামের আগে জুড়ে দিতেন টাইগার অথবা বাংলার বাঘ। স্যারের উপস্থিতি ছিল কলেজের করিডোর, লেকচার গ্যালারি, হাসপাতালের ওয়ার্ড ও অপারেশন থিয়েটারে। যখনই স্যার আসতেন সাথে সাথে চারিদিকে কেমন যেন একটা পিনপতন নীরবতা সৃস্টি হয়ে যেত। এই পিনপতন নীরবতার একটি ক্লিনিক্যাল ভ্যালু ছিল। স্যারের প্রয়াণে কোন এক সিনিয়র ভাইয়ের কাছে শুনা একটি গল্প শেয়ার করার লোভ সামলাতে পারছি না।
করিম স্যার ছিলেন রাশভারী টাইপের মানুষ। একদিন সিএমসির অপারেশন থিয়েটারে একজন আন্ত্রিক প্রতিবন্ধকতা (Intestinal Obstruction) এর রোগীকে সার্জারি করার জন্য নিয়ে আসা হল। যথারীতি এনেস্থেসিয়া দেওয়ার পর স্যারের সিএ রোগীকে ড্রাপিং করেন। তখন করিম স্যার হ্যান্ড ওয়াশ নিয়ে অপারেশন থিয়েটারে ঢুকে গাউন পড়ছেন। স্যার রুমে ঢুকার সাথে সাথে সবাই নিশ্চুপ। চারিদিকে পিনপতন নীরবতা। স্যার গ্লাভস পড়লেন। রোগীর পাশে দাঁড়ালেন। হাতে স্কালপেল নিলেন ইনসিশন দেওয়ার জন্য। চারিদিকে সুনসান নীরবতার মাঝে হঠাৎ ‘পিঁপ’ করে একটা শব্দ হলো। স্যার স্কালপেল নার্সকে দিয়ে দিলেন, গ্লাভস খুলে ফেললেন। রুমের সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। স্যার বললেন, অপারেশন ক্যানসেল। অবস্ট্রাকশন রিলিজিড। রোগীকে ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দাও। আমরা সবাই ডাক্তারদের ঈষরহরপধষ আই এর গল্প শুনেছি। কিন্তু ঈষরহরপধষ ইয়ার থাকলে যে ডায়াগনোসিস করা যায় সেটা করিম স্যারের এই ঘটনা থেকে প্রমাণিত হয়। পিনপতন নীরবতায় ডায়াগনোসিস বদলে গেল, রোগী মেজর অপারেশন থেকে বাঁচল। এই কিংবদন্তী সার্জন চলে গেলেন সুনসান নীরবতার জগতে, এই নভেম্বর মাসের দুই তারিখে। আল্লাহ উনাকে বেহেস্ত নসীব করুক। আমীন।
স্যার কর্মজীবনে চট্টগ্রামের জনগণকে নিরলস চিকিৎসাসেবা দিয়েছেন, অনেক অনেক ডাক্তারদেরকে প্রশিক্ষিত করেছেন এবং হাজার হাজার মেডিকেল ছাত্রদের পড়িয়েছেন। উনার অনেক ছাত্র-ছাত্রী দেশে-বিদেশে সুনামের সাথে এখনো চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করিম স্যার সরকারী চাকুরী থেকে অবসরের পর চট্টগ্রামের মানুষের সেবার জন্য নিজের সময় ব্যায় করেছেন। চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করার জন্য, এই হাসপাতালের জন্মলগ্ন থেকেই স্যার কাজ করে গেছেন। আজকের মা ও শিশু হাসপাতাল একটি বিশাল ইনস্টিটিউটে পরিণত হয়েছে। এখানে একটি মেডিক্যাল কলেজ ও পরিপূর্ণ হাসপাতাল হয়েছে। সম্প্রতি মা ও শিশু হাসপাতালে ক্যানসার বিভাগের কাজও শুরু হয়েছে পুরোদমে। অচিরেই এখানে অত্যাধুনিক রেডিয়েশন মেশিন লিনিয়র এক্সেলেটর চালু হবে। একই সময়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল চত্ত্বরেও ডিভিশনাল ক্যানসার সেন্টারের কাজ চলছে। এখানেও অত্যাধুনিক রেডিয়েশন মেশিন বসানো হবে অতিসত্তর। আমরা জানি ইদানীং স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত মহিলার সংখ্যা সারাদেশে ও চট্টগ্রামে দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বিভাগের লোকসংখ্যা অনুযায়ী ব্রেস্ট সার্জন (ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি এবং সেন্টিনাল নোড বায়অপসি যিনি করতে পারেন) এর সংখ্যা খুবই কম। এই সার্জিক্যাল টেকনিকের মাধ্যমে পুরো স্তন না কেটে শুধুমাত্র টিউমার আক্রান্ত অংশটুকু ফেলে দেওয়া হয়।
যার ফলে স্তনের বেশীরভাগ অংশ রক্ষা করা যায়। এই মুহূর্তে চট্টগ্রামে অন্তত ৪-৫ জন ব্রেস্ট সার্জন দরকার। কিন্তু দুঃখজনক হলো কোন ‘ব্রেস্ট সার্জারি ফেলোশীপ’ এখনো আমাদের দেশে শুরু হয়নি। করিম স্যারের স্মৃতিকে চিরজাগরুক করে রাখতে আমি ‘Professor Dr. F Karim Breast Surgery Fellowship’ শুরু করার প্রস্তাব করছি। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের অনেক সেন্টারেই ‘ব্রেস্ট সার্জারি ফেলোশীপ’ প্রোগ্রাম চলমান আছে। আমাদের তরুণ সার্জনদেরকে কমপক্ষে ৩ মাস থেকে ৬ মাসের প্রশিক্ষণের জন্য ভারত অথবা অন্য কোন দেশে পাঠাতে পারলে ভাল হয়। এই জন্য আমাদের সবার সম্মিলিত কন্ট্রিবিউশনের মাধ্যমে একটি ট্রাস্ট তহবিল বা এনডাউমেন্ট ফান্ড গঠন করা যেতে পারে। এই ধরনের ফান্ড গঠনের উদ্যোগটা সাধারণত পরিবারের পক্ষ থেকে করতে পারলে ভাল হয়। পরবর্তীতে যে যার সাধ্যমতো ডেনেশন ফান্ডে দিতে পারেন। ফান্ডের পরিমাণ এমন হতে হবে, যার লভ্যাংশ দিয়ে ৪-৫ জন সার্জনকে প্রতি ২-৩ বছর পর পর ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি জন্য ফেলোশীপ দেওয়া যায়। বাংলাদেশে এনডাউমেন্ট ফান্ড (ঊহফড়সিবহঃ ঋঁহফ) কিভাবে সেটআপ করা যায় সেটা চট্টগ্রামের ইনভেস্টমেন্ট এক্সপার্টরা ভালো বলতে পারবেন। সবাই সম্মত হলে একটি সমাধান আশা করি বের হয়ে আসবে। তবে আমি মনে করি এই ব্যাপারে সবার আগে উদ্যোগ নিতে পারেন স্যার এর সুযোগ্য সন্তানেরা। এই ব্যাপারে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ এ্যালমনাই ও চট্টগ্রামের বিজিনেস কমিউনিটির দৃস্টি আকর্ষণ করছি। ব্রেস্ট কনজারভিং সার্জারি চট্টগ্রামে পুরোদমে শুরু হলে, চট্টগ্রাম বিভাগীয় ক্যানসার সেন্টার এবং মা ও শিশু হাসপাতালের লিনিয়র এক্সেলেরেটর মেশিনগুলো স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদেরকে রেডিয়েশন থেরাপি দিয়ে চিকিৎসা করতে পারবে। আসুন সবাই মিলে করিম স্যারের কাজকে স্মরণীয় করে রাখি এবং স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের সম্পূর্ণ চিকিৎসাসেবা যেন চট্টগ্রামের মাটিতে দেয়া সম্ভব হয় সেই ব্যাবস্থা করি।

ডা. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন
রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট,
এসিস্টেন্ট প্রফেসর, ডালহাউসী ইউনিভার্সিটি,
হ্যালিফ্যাক্স, কানাডা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট