চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী: মৃত্যু যাঁকে বিস্মৃত করতে পারেনি

মুহাম্মদ মুসা খান

১৫ নভেম্বর, ২০২২ | ১০:১০ অপরাহ্ণ

মানুষের সর্বশেষ ও নিশ্চিত গন্তব্য ‘মৃত্যু’। কেউ কখনো মৃত্যু থেকে পালাতে পারে নি। মৃত্যুই সম্ভবত জীবনের অন্যতম সঠিক আবিষ্কার, যার বিষয়ে কারও দ্বিমত করার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। কাকে, কখন, কিভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে হবে, সেটা কারও জানা নেই।

আমরা চাই বা না চাই- মৃত্যু নামক এক মহাসত্য একদিন  উপস্থিত হবেই। এই সত্যের হাত ধরেই আমাদের পিতামাতা পূর্বপুরুষরা পৃথিবী হতে বিদায় নিয়েছেন। একথা আরও স্বীকার্য যে, মৃত্যু হল মানুষের জীবনের এমন এক কঠিন বাস্তবতা, যা অবধারিত- কিন্তু মেনে নেওয়া খুব কষ্টসাধ্য। প্রিয়জনের বিয়োগজনিত ব্যথা থেকে বড় শোক বোধহয় আর কিছুই হয় না। আমরা সকলেই জানি যে, মৃত্যু জীবনের অবিচ্ছেদ্য একটি অংশ তবুও কিছু কিছু মৃত্যু মানুষকে কষ্ট দেয় এবং চূড়ান্তভাবে বিপর্যস্ত করে ফেলে।

 

কাছের মানুষ চিরবিদায় নেওয়ার পর যে শূন্যতা গ্রাস করে, তার ভার স্বাভাবিকভাবে বহন করার শক্তি খুব কম মানুষেরই থাকে। মুজিববর্ষে আঞ্চলিকে দেশসেরা পত্রিকা দৈনিক পূর্বকোণের সাবেক সম্পাদক, সজ্জন ব্যক্তিত্ব, স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীও (৬৪) আজ থেকে পাঁচ বছর আগে (১৫ নভেম্বর ’১৭) পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে, আত্মীয় স্বজনদের কাঁদিয়ে আমাদেরকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। সুদীর্ঘ প্রায় ২৪ বছর দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভূগে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তিকাল করেন তিনি। আজ তিনি নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম তাঁকে জাগরুক রেখেছে আমাদের কাছে।

স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীর চিন্তা-চেতনা, কর্মকাণ্ড ও ধ্যান-ধারণা নিয়ে অনেকেই স্মৃতিচারণ করেছেন। ক্যাডেট কলেজের কঠোর শৃঙ্খলা ও বুয়েটে পড়াশোনা করা একজন স্থপতি হয়েও তিনি নিজেকে সমাজ ও জনদরদী মানুষ হিসেবে পরিণত করতে পেরেছিলেন, যা ছিল একটি বিরল ঘটনা। পিতা চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একজন স্বপ্রতিষ্ঠিত অমায়িক ও দূরদর্শী মানুষ।

 

তসলিমউদ্দিন চৌধুরী তাঁর পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে ছিলেন অবিচল। স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী মনে করতেন, সংবাদপত্র একটি দেশ ও সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য দায়িত্ব পালনের অবিচ্ছেদ্য প্রতিষ্ঠান। তাই সে ভাবেই সংবাদপত্রকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তিনি পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চট্টগ্রামের আর্থ-সামাজিক-শিক্ষা প্রভৃতির অগ্রগতি জন্য সংবাদপত্রকে অন্যতম মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন। তিনি পত্রিকাকে দেশের উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার মনে করতেন। লেখালেখির সুবাদে প্রায়শই দৈনিক পূর্বকোণে যাতায়াত করতাম (আমি অনেক বছর ‘চোখ মেলে দেখুন’ শিরোনামে  নিয়মিত অষ্টম কলামে ও পাশাপাশি নিয়মিত উপসম্পাদকীয় কলামে লিখেছি)।

১৯৮৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি দৈনিক পূর্বকোণের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর উনার সাথে দেখা করেছিলাম এবং বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। পরে ২০০৭ সালে তিনি পূর্বকোণ গ্রুপের চেয়ারম্যান মনোনীত হওয়ার পরও  কয়েকবার আলাপ হয়েছে। তখন বুঝেছি যে, টেকনিক্যাল বিষয়ে পড়াশোনা করা একজন স্থপতি হয়েও তিনি জ্ঞানের সর্ববিষয়ে ধারণা রাখতেন। পিতার মতো তাঁরও চিন্তা ছিল- কীভাবে চট্টগ্রামের বিরাজমান সমস্যাগুলোর সমাধান করা যায়। কিভাবে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সাইন্স ইউনিভার্সিটিকে দেশের কৃষি ও গবাদি পশুর উন্নয়নে কাজে লাগানো যায়। তিনি মনে করতেন, দেশের উন্নয়নের জন্য শিল্প উন্নয়নের পাশাপাশি কৃষি সেক্টরেরও উন্নয়ন করতে হবে।

 

আজকে যখন আমরা দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করি, তখন কৃষি উন্নয়নে তাঁর ভাবনা-চিন্তা আমাদেরকে নতুনভাবে ভাবতে শেখায়। কারণ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য কৃষিসেক্টরের উন্নয়নের কোন বিকল্প নেই। তাঁর ব্যবহার ছিল অমায়িক। বাইরে রাশভারি মনে হলেও ভিতরে ছিলেন একজন কোমল মানুষ, যা সাক্ষাৎকার প্রার্থীদের সম্মোহিত করতো। তিনি একজন সৎ মানুষ ছিলেন।

তাঁর সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতা ছিল অসাধারণ। তিনি মনে করতেন- একটি প্রতিষ্ঠানের সফলতার জন্য সময়ানুবর্তিতার বিকল্প নাই। কেউ অনিয়ম করলে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করতেন। তিনি জার্নালিজম নিয়ে প্রচুর পড়াশোনা করতেন। ফলে একজন স্থপতি হয়েও তিনি পুরোদস্তুর সাংবাদিক হয়ে উঠতে পেরেছিলেন এবং দৈনিক পূর্বকোণকে পাঠকপ্রিয়তা দিতে পেরেছিলেন। তিনি ক্যান্সারের রোগী হিসেবে ক্যান্সার বিষয়েও প্রচুর পড়ালেখা করেছেন। ফলে একজন ক্যান্সার রোগীকে তিনি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করতে পারতেন। তিনি বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক, বাণিজ্যিক সংগঠনের সাথেও জড়িত ছিলেন। তিনি বহু ব্যক্তি ও সংস্থাকে সাহায্য-সহযোগিতা ও পরামর্শ দিতেন।

 

আমরা জানি যে, জীবনের দৈর্ঘ্যই শেষকথা নয়, জীবনের গভীরতাই হলো আসল মাপকাঠি। স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী জীবনকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন এবং কাজের মাধ্যমে জীবনকে পূর্ণতা দান করতে পেরেছিলেন। পবিত্র কোরআনের সূরা হাজ্জ এর ৬৬ নং আয়াতে উল্লেখ রয়েছে, ‘আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন।’ সেক্সপিয়ার বলেছিলেন, ‘জীবনাবর্তে ঘূর্ণায়মান উচ্চ-নীচ, ধনী-দরিদ্র, সবল-দুর্বল সকলেই পরিণামে একই ধুলায় পর্যবসিত হবে।’  কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মৃত্যুর ডাক আর কিছুই নহে, বাসা বদলের ডাক। জীবনকে কোনো মতেই সে কোনো সনাতন প্রাচীরের মধ্যে বন্ধ হইয়া থাকিতে দিবে না। জীবনকে সেই জীবনের পথে অগ্রসর করিবে বলিয়াই মৃত্যু।’

মৃত্যু ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে জীবনের যে অনাবিল আনন্দ ও সুখ আছে, তার আস্বাদন আমরা গ্রহণ করতে পারবো না। তাই যত দিন আমরা বেঁচে আছি- সেই সময়টুকু যদি আমরা সমাজের জন্য সদ্ব্যবহার করতে পারি, মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ইতিবাচক কিছু করে যেতে পারি- তাহলে মৃত্যুর পরেও সবার স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকবে গোটা জীবন। যেমনটি করে গেছেন, স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরী। তিনি জীবনের প্রতিটি ক্ষণকে অসুস্থতা সত্ত্বেও কাজে লাগিয়েছেন। মৃত্যুর ভয় তাঁকে ঘরে বন্দী করে রাখতে পারেনি।

 

তিনি দৈনিক পূর্বকোণকে যেমন সামনে এগিয়ে নিয়েছেন, তেমনি সমাজের জন্য কাজ করেছেন নিরবচ্ছিন্নভাবে। তিনি বিস্মৃত হোন নি, কাজের মাধ্যমে আমাদের কাছে বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন অনাদিকাল। আগামী প্রজন্মও তাঁকে স্মরণ করবে শ্রদ্ধাভরে। কারণ, ‘মানুষের মৃত্যু হয়, কিন্তু অবদান ও স্মৃতির মৃত্যু হয় না’। অবদান ও স্মৃতি বারবার ফিরে আসে। তাই মন থেকে বলতে ইচ্ছে হয়- ‘আজ তুমি কতদূরে, মুছে গেছ মরণে।/নেই কাছে তবু আছো, ব্যথাভরা স্মরণে।’

প্রার্থনা করি, আল্লাহপাক, স্থপতি তসলিমউদ্দিন চৌধুরীকে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চমকাম দান করুন। আমিন।

লেখক: মুহাম্মদ মুসা খান, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট