চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত জৈবপ্রযুক্তি

অমল বড়ুয়া

১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ | ৯:২৫ অপরাহ্ণ

জৈবপ্রযুক্তি এমন একটি জৈবিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মানবকল্যাণকর কোন বস্তু বা উপাদান তৈরি করা সম্ভব। জাতিসংঘের কনভেনশন অন বায়োলোজিক্যাল ডাইভার্সিটি অনুসারে জৈবপ্রযুক্তিকে এভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, ‘যে কোনো প্রকারের প্রায়োগিক প্রাযুক্তিক কাজ যা জৈবিকব্যবস্থা, মৃত জৈবিক বস্তু অথবা এর থেকে প্রাপ্ত কোনো অংশকে ব্যবহার করে কোনো দ্রব্য বা পদ্ধতি উৎপন্ন করে বা পরিবর্তন করে যা বিশেষ ব্যবহারের জন্য ব্যবহৃত হয়।’

জৈবপ্রযুক্তি হলো বৈজ্ঞানিক ও প্রকৌশলগত নীতি অনুসরণ ও প্রয়োগ করে জীবদের ব্যবহার করার মাধ্যমে মানুষের জন্য কল্যাণকর ও ব্যবহারযোগ্য প্রয়োজনীয় মালামাল তৈরির বিশেষ প্রযুক্তি। এটি মূলত জীববিদ্যাভিত্তিক প্রযুক্তি, বিশেষ করে যখন প্রযুক্তি কৃষি, খাদ্য, বিজ্ঞান এবং ঔষধশিল্পে ব্যবহৃত হয়। জৈবপ্রযুক্তি শব্দটি ১৯৭০ সালের শেষার্ধে চালু হয়। যখন আণবিক জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন কলাকৌশল আধুনিক শিল্পব্যবস্থায় ব্যবহৃত হতে থাকে। এই সময় উন্নত আনবিক ও কোষ-জীববিদ্যা তার অগ্রগতিকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন শিল্প উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। জৈবপ্রযুক্তি হল মানুষের পক্ষে কার্যকারী উৎপাদনের জন্য সজীব জীবজগতের ব্যবহার। জীববিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান ও কারিগরি বিজ্ঞানের সুসংহত ব্যবহারে গড়ে উঠেছে এই বিষয়টি।

জীবজগতের প্রতিনিধির প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে জৈবপ্রযুক্তিকে বৃহদার্থে মাইক্রোবিয়াল-জৈবপ্রযুক্তি, উদ্ভিদের জৈবপ্রযুক্তি এবং প্রাণীর জৈবপ্রযুক্তি এই তিনটি শ্রেণিতে বিন্যস্ত করা যায। জেনেটিক প্রকৌশল ডিএনএ-প্রযুক্তি, প্রোটোপ্লাষ্ট সংযোজন, সংরক্ষণ-প্রযুক্তি, জার্মাপ্লাজমের উন্নতি, ভ্রুণ-স্থানান্তর প্রযুক্তি, উৎসেক এবং প্রোটিন কারিগরী, ফার্মেন্টেশন, জৈব-রূপান্তর এবং কোষ ও কোষ উৎপাদিত বস্তুর অচলাবস্থা সংক্রান্ত জ্ঞান এই জৈবপ্রযুক্তির অন্তর্ভূক্ত বিষয়। ১৯১৯ সালে হাঙ্গেরীয় কৃষিপ্রকৌশলী কারোলি এরাকি সর্বপ্রথম জৈবপ্রযুক্তি শব্দটি ব্যবহার করেন। যদিও মানবসভ্যতায় জৈবপ্রযুক্তি তথা ফার্মেন্টেশন বা গাঁজানো প্রক্রিয়ায় অ্যালকোহল তৈরি পদ্ধতি অতি প্রাচীন, প্রায় পাঁচহাজার বছরের পুরাতন। তবে জৈবপ্রযুক্তি কেবলমাত্র সত্তর দশকের পর থেকে অর্থাৎ আণবিক-জীববিজ্ঞানের কলাকৌশল ও আধুনিক শিল্পে তাদের প্রয়োগ প্রসার লাভের ফলে বহুলভাবে প্রচলিত হয়েছে। ১৮৫৭ সালে লুই পাস্তুরের গাঁজনবিষয়ক কাজের মাধ্যমে খাদ্যকে অন্য প্রকার খাদ্যে রূপান্তরকারী জৈবপ্রযুক্তির প্রাথমিক রূপ উন্মোচিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের কার্বোহাইড্রেট ভেঙে অ্যালকোহল উৎপন্ন হয়। হাজার বছর ধরে মানুষ শস্য এবং প্রাণীর উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম-প্রজনন পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। এই পদ্ধতিতে প্রত্যাশিত উন্নত বৈশিষ্ট্যধারী জীবের মিলনে সৃষ্ট সন্তান একই বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বিজ্ঞানীগণ অণুজীব সম্পর্কে অনেক তথ্য লাভ করতে থাকেন এবং পণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। ১৯১৭ সালে চাইম ওয়াইজম্যান বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ডে প্রথম বিশুদ্ধ অণুজীব কালচারের প্রয়োগ করেন। অণুজীব দ্বারা জৈব-পদার্থ প্রক্রিয়াজাতে জৈবপ্রযুক্তির প্রয়োগ হয়। আকরিক থেকে ধাতু নিষ্কাশনে ব্যাকটেরিয়ার ব্যবহারও জৈবপ্রযুক্তির অনন্য অবদান। এছাড়া কোনো জিনিসকে পুনরায় ব্যবহারের উপযোগী করে তোলা, বর্জ্য-শোধন, কলকারখানা দ্বারা দূষিত এলাকা পরিষ্কার এবং জীবাণু অস্ত্র তৈরিতে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। কৃষিকাজে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার বহুকাল আগে থেকে হলেও উদ্ভিদের চাষাবাদে বর্তমানে এর আধুনিকতম প্রয়োগ দেখা যায়। আধুনিককালের কৃষকসমাজ উন্নত বীজ নির্বাচন ও ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ফলনের মাধ্যমে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণ করে চলছে। এই শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এমন কিছু জীব ও অনুজীব এবং তাদের থেকে উৎপন্ন পদার্থের সন্ধান পাওয়া যায়, যেসব জীব মাটির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি করে। তারা নাইট্রোজেন সংবদ্ধকরণ করে এবং ক্ষতিকর কীটপতঙ্গ দমন করে। আবার এও দেখা যায় কৃষক ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন উদ্ভিদের সাথে কোনো উদ্ভিদের প্রজনন ঘটিয়ে উদ্ভিদের জিনে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে জৈবপ্রযুক্তির প্রাথমিক রূপ উন্মোচন করেছেন।

আধুনিক প্রজননবিদ্যার জ্ঞান, জীবজসারের মতো নতুন ধরনের সারের প্রয়োগ ও জৈব-কীটনাশকের মতো নতুন কীটনাশক দ্বারা কৃষি-ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির চিরাচরিত পদ্ধতি, উদ্ভিদের টিস্যু-কালচার ও মাইক্রোপ্রপাগেশন প্রযুক্তি, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি উৎপাদনক্ষম বা বিশেষ জৈব-রাসায়নিক শক্তিধর অণুজীব পৃথকীকরণ ইত্যাদি প্রচলিত জীবপ্রযুক্তির অন্তর্গত, যেখানে ডিএনএ’র কৌশলী প্রয়োগ জড়িত নয়। পুনর্বিন্যস্ত ডিএনএ-ভিত্তিক জীবপ্রযুক্তি, যেমন ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ সৃষ্টি, গবাদি-পশু ও হাঁস-মুরগির টিকা উদ্ভাবন, জীবতাত্ত্বিক চিকিৎসাগত উপযোজনের জন্য ডিএনএ-ভিত্তিক রোগনির্ণায়ক বিকারকের ব্যবহার ইত্যাদিতে ডিএনএ প্রয়োগ জড়িত বিধায় সেগুলি সমকালীন জীবপ্রযুক্তির শ্রেণিভুক্ত।

জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার খুবই বিস্তৃত। গোল্ড-বায়োটেকনোলজি বা স্বর্ণ-জৈবপ্রযুক্তি মূলত বায়োইনফরমেটিকসের ওপরে ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে যা জৈবপ্রযুক্তির একটি আন্তঃবিষয়ক ক্ষেত্র যেখানে জীববিজ্ঞানের সমস্যাগুলো দ্রুত সাজানো যায় এবং তথ্য বিশ্লেষণ করা যায় কম্পিউটারের প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এটি অন্যান্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যা জৈবপ্রযুক্তি ও ওষুধশিল্পের মূল উপাদান তৈরিতে সাহায্য করে।  ব্লু-বায়োটেকনোলজি বা নীল-জৈবপ্রযুক্তি মূলত সামুদ্রিক সম্পদকে কাজে লাগিয়ে শিল্পক্ষেত্রে বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্র। এতে জৈব-জ্বালানি পরিশোধনের ক্ষেত্রে সালোকসংশ্লেষণকারী মাইক্রো-শৈবাল ব্যবহৃত হয়। গ্রিন-বায়োটেকনোলজি বা সবুজ-জৈবপ্রযুক্তিকে কৃষিক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়। যেমন মাইক্রোপ্রোপাগেশনের মাধ্যমে একসাথে অনেক উদ্ভিদ উৎপন্ন করা। নির্দিষ্ট পরিবেশে বেড়ে ওঠার জন্য ট্রান্সজেনিক উদ্ভিদ তৈরি বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী এবং অধিক ফলনশীল উদ্ভিদ উৎপাদন করে। এই জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে সুইডেনের এক বিজ্ঞানী ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ ‘সুপার রাইস’ উদ্ভাবন করেছেন। বন্য উদ্ভিদের উৎকৃষ্ট জিন ফসলি উদ্ভিদে স্থাপন করে অধিক ফলনশীল জাত উদ্ভাবন করা হয়েছে। প্রায় ৬০টি উদ্ভিদ প্রজাতিতে রিকম্বিনেন্ট ডিএনএ কৌশল সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। ফলে এগুলো পতঙ্গ, ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী হবে এবং পরিবেশের প্রতিকূলতা মানিয়ে নিতে পারবে। গৃহপালিত পশু উন্নয়নেও জৈবপ্রযুক্তি কাজ করে যাচ্ছে। ইউরোপীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান এফআইবিএলের গবেষণামতে, গত একদশকে অর্গানিক কৃষিপণ্যের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩০০ শতাংশ। অর্গানিক পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্স। ১৬৪টি দেশে বর্তমানে সার্টিফায়েড অর্গানিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে।

রেড-বায়োটেকনোলজি বা লাল-জৈবপ্রযুক্তি হল চিকিৎসাশাস্ত্র এবং ওষুধশিল্পে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তি। এই শাখার অন্তর্গত কাজগুলো হল টিকা ও অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি, বিভিন্ন থেরাপি, কৃত্রিম-অঙ্গ তৈরি, কৃত্রিম-হরমোন তৈরি, স্টেম-কোষ প্রভৃতি তৈরি।

জৈবপ্রযুক্তি অ্যান্টিবায়োটিকের উন্নতিতেও ব্যবহৃত হয়েছে। অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং ১৯২৮ সালে পেনিসিলিন মোল্ড আবিষ্কার করেন। ১৯৪০ সাল থেকে পেনিসিলিন মানুষের দেহে ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ নিরাময়ে ব্যবহার হয়ে আসছে। করোনার ভ্যাকসিন তৈরিতে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার করা হচ্ছে। জিন-প্রকৌশল প্রযুক্তি প্রয়োগ করে হাম, যক্ষ্মাসহ নানা ধরনের সংক্রামক রোগের প্রতিরোধক তৈরি করা হচ্ছে। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে ডায়াবেটিস রোগের জন্য ইনসুলিন, মানুষের দেহ বৃদ্ধির হরমোনসহ অন্যান্য হরমোন তৈরি করা হচ্ছে; অন্যদিকে কম সময়ে অধিক পরিমাণ অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি করতেও জীবপ্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়। শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তি হচ্ছে হোয়াইট-বায়োটেকনোলজি বা সাদা-জৈবপ্রযুক্তি। বিভিন্ন এনজাইমের সঠিক ব্যবহারের ফলে রাসায়নিক-বিক্রিয়ার গতি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক-পদার্থ তৈরি এবং ক্ষতিকর রাসায়নিক-পদার্থ ধ্বংস করা হয়। খাদ্য-উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তির নাম ইয়োলো-বায়োটেকনোলজি বা হলুদ-জৈবপ্রযুক্তি। বিভিন্ন কীটপতঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তিও এই ‌শাখার আলোচ্য বিষয়। পরিবেশে প্রয়োগকৃত জৈবপ্রযুক্তি হচ্ছে গ্রে বা ধূসর-জৈবপ্রযুক্তি। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা এবং পরিবেশ-দূষণ দূর করাই এর প্রধান লক্ষ্য।

ব্রাউন বা বাদামি-জৈবপ্রযুক্তি হল শুষ্ক বা মরুভূমি এলাকার পরিবেশ-নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জৈবপ্রযুক্তি। এক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বীজ উৎপাদন করা হয় যা কঠিন প্রাকৃতিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করতে সক্ষম। জৈবপ্রযুক্তির আইনি, নৈতিক এবং দার্শনিক দিকগুলোর সাথে সম্পর্কযুক্ত হল ভায়োলেট বা বেগুনি-জৈবপ্রযুক্তি। সন্ত্রাসবাদে জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার, জীবাণু-অস্ত্র তৈরি করার নাম হল ডার্ক বা অন্ধকার-জৈবপ্রযুক্তি। যা অণুজীব বা বিষাক্ত-পদার্থ ব্যবহার করে মানুষ, গবাদি-পশু বা ফসলের রোগ সৃষ্টির মাধ্যমে ক্ষতি সাধন করে। গ্রান্ড ভিউ রিসার্চ’র এক রিপোর্টমতে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী জৈবপ্রযুক্তির বাজারের আকার ৭২৭.১ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে। এ জৈবপ্রযুক্তি শিল্পবাজারের আকার ২০২০ সাল পর্যন্ত ১০০ বিলিয়নেরও বেশি ছিল। বর্তমান পৃথিবীতে জৈবপ্রযুক্তির গুরুত্ব দিনকে দিন বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক অগ্রগতি, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় কার্যকর অবলম্বন হতে যাচ্ছে জৈবপ্রযুক্তি। এই জৈবপ্রযুক্তিই খোলছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

লেখক: অমল বড়ুয়া প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট