চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

কোরবানির ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট গুরুত্ব ও শিক্ষা

ফখরুল ইসলাম নোমানী

৮ জুলাই, ২০২২ | ১১:৩২ অপরাহ্ণ

কোরবানি হলো মুসলিমদের একটি ইবাদত, যা প্রতিবছর বিত্তবানদের ওপর আরোপিত হয় নির্দিষ্ট সময়ে। এই ইবাদাতের মাধ্যমে মুসলিম মহান আল্লাহ তা’আলার নৈকট্য লাভ করে থাকেন।

মানব সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে কুরবানির রেওয়াজ চলে আসছে। হযরত আদম (আ.)এর দু’সন্তান হাবিল ও কাবিল কুরবানি করেছিলেন। হাবিল ঐকান্তিক আগ্রহ ও নিষ্ঠার সাথে উৎকৃষ্ট জিনিস কুরবানি করলে তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হয়। পক্ষান্তরে কাবিল অনাগ্রহ ও নিকৃষ্ট জিনিস উৎসর্গ করলে তা প্রত্যাখ্যাত হয়। কুরবানি মানবসমাজে সবসময়ই কোন না কোনভাবে চালু ছিল। বর্তমান মুসলিম সমাজে চালুকৃত কুরবানি মূলত হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তাঁর পরিবারের চরম আত্মত্যাগের স্মরণ হিসেবেই চলে আসছে।

আমরা যে পশু কুরবানি করি তা মূলত প্রতিকী। আজ থেকে সাড়ে চার হাজার বছর পূর্বে বর্তমান ইরাকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। তিনি এক পুরোহিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করে চতুর্দিকে মূর্তিপূজার সয়লাব লক্ষ্য করেন এবং তাঁর পিতা স্বৈরশাসক নমরুদের প্রধান পুরোহিত ছিলেন। মূর্তির অসারতা প্রমাণের জন্য একদিন তিনি মন্দিরে প্রবেশ করে মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলেন। যেহেতু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় মূর্তিপূজা তাই ইবরাহীম (আ.)-এর এ আচরণকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিবেচনা করে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ভবিষ্যতে কেউ যাতে এ জাতীয় আচরণ করার দুঃসাহস দেখাতে না পারে তজ্জন্য প্রকাশ্যে আগুনে পুড়িয়ে এ দন্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

সেখান থেকে রক্ষা পাওয়ার পর তাঁর জাতির মধ্যে হেদায়াত প্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা না দেখে দ্বীনের দাওয়াতের লক্ষ্যে দেশ ত্যাগ করে তিনি অজানা পথে রওয়ানা হন। নিজের রুটি-রুজির কোন চিন্তা ছিল না ছিল না কোন আশ্রয়ের; কেবল আল্লাহরই ওপর ভরসা করে তাঁরই সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই তাঁর এ যাত্রা। এরপর আল্লাহরই নির্দেশে বৃদ্ধ বয়সে পাওয়া দুগ্ধপোষ্য শিশু ও স্ত্রীকে নির্জন স্থানে রেখে আসেন। পরীক্ষার পর পরীক্ষা। ছেলে দৌড়াদৌড়ি করার বয়সে উপনীত হলে সে সময় আল্লাহপাক নির্দেশ দেন প্রিয় জিনিসকে কুরবানি করতে। তিনি পশু কুরবানি করেন কিন্তু একই স্বপ্নের পুনরাবৃত্তি। তাঁর সবচেয়ে প্রিয় বস্তু তাঁর ছেলে। তাই তাঁর স্বপ্নের কথা স্ত্রী ও সন্তানকে জানান। তাঁরাও ছিলেন ইবরাহীম (আ.)-এর মত মুসলিম। ছেলে বললেন- আব্বা আপনি তাই করুন যা করতে আদিষ্ট হয়েছেন। আছ ছাফফাত: ১০২। আল্লাহপাক এক বড় কুরবানির বিনিময়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে নেন এবং পরবর্তীকালে স্মরণ হিসেবে ঘোষণা করে দেন। আল্লাহর প্রতি ভালোবাসা এবং তাঁর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে নিজের জীবন, ধন-সম্পদ ও রুটি-রুজির চিন্তা পরিহার, মাতৃভূমি, স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততির মায়া সবকিছু ত্যাগের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন হযরত ইবরাহীম (আ.)। ত্যাগ ও কুরবানি যত বড়, পুরস্কারও তত বড়। তাঁকে ইমাম ও মুসলিম জাতির পিতা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। হজের অনুষ্ঠানাবলীর মধ্যে ইবরাহীম (আ.)-এর পরিবারের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে।

যেমন-মাকামে ইবরাহীমে সালাত আদায়, সাফা-মারওয়া সায়ী করা, জমজম কূপের পানি পান ও মিনায় কুরবানি করা এবং কিয়ামত পর্যন্ত মুসলিম উম্মাহ; এখান থেকে প্রেরণা লাভ করবে। কুরবানির গুরুত্ব বর্ণনা করতে যেয়ে রসূল (সা.) বলেন ঈদের দিন রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে উত্তম কাজ আর নেই, সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কুরবানি করবে না সে যেন আমার ঈদগাহে না আসে কুরবানিদাতাকে তার পশুর শরীরের পশমের সমপরিমাণ সওয়াব দেয়া হবে এবং রক্ত যমিনে পড়ার পূর্বেই তা আল্লাহর দরবারে গৃহীত হবে।

কুরবানি নিজ হাতে দেয়াটাই উত্তম। একান্ত সম্ভব না হলে কুরবানিদাতা যেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। মূলত কুরবানি হলো রক্ত প্রবাহিত করা ও রক্ত দর্শন করা। কুরবানির পশু জবেহ করার সময় কুরবানিদাতা এ ঘোষণাই দিয়ে থাকে-নিশ্চয়ই আমার নামায, আমার যাবতীয় ইবাদত অনুষ্ঠান এবং আমার জীবন ও মৃত্যু কেবল আল্লাহরই জন্য-আল আনয়াম ১৬২। অর্থাৎ-আমি আমার নই,আমার পরিবার ও জাতিরও নই। আমি একান্তভাবে আল্লাহর। আমার বেঁচে থাকাটা হবে আল্লাহর জন্য এবং আমার মৃত্যুও হবে আল্লাহরই জন্য। আমি এ পৃথিবীতে আমার, আমার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও দেশবাসীর জন্য যা কিছু করি তা আল্লাহরই নির্দেশক্রমে।

আল্লাহর পথে ত্যাগ ও কুরবানির নজির শুধু ইবরাহীম (আ.) নয় বরং আল্লাহর পক্ষ থেকে আসা সকল নবী-রসূল ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জীবনে ঘটেছিল। হযরত মুসা (আ.) ইসা (আ.), জাকারিয়া (আ.), ইউসুফ (আ.), আইয়ুব (আ.) নূহ (আ.), ইউনুস (আ.) এবং আমাদের প্রিয়তম নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাথীদেরসহ অতীতকালের সকল ঈমানদারদের জীবনেই ঘটেছিল। কুরআন মজিদে ঈমানদারদের নিপীড়ন-নির্যাতনের কথা বেশি উল্লেখ রয়েছে এবং লক্ষণীয় হলো, যিনি যত বেশি আল্লাহর প্রিয়ভাজন ও নৈকট্য প্রাপ্ত তিনি তত বেশি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন।

এদিক দিয়ে আম্বিয়ায়ে কেরাম প্রথম কাতারে- আল্লাহর পক্ষ থেকে কখনো আবার জালেমদের পক্ষ থেকেও পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। বিপরীতভাবে জালেমদের করুণ পরিণতির কথা কমই উল্লেখ রয়েছে; যেমন-নমরুদ, ফেরাউন, শাদ্দাদ, কেনান, আবু লাহাবসহ কয়েকজন। কুরআনের ভাষায়- এই কাফিররা বলে তোমরা কখনই কুরআন শুনবে না আর যখনই কুরআন শোনানো হয় তখনই শোরগোল করবে, হয়তো তোমরা জয়ী হবে। আমি অবশ্যই এ কাফিরদের কঠিন আযাবের স্বাদ আস্বাদন করাবো এবং নিশ্চয়ই সে কাজের প্রতিফল দেব যে আচরণ তারা করে এসেছে। এ জাহান্নামই হচ্ছে আল্লাহ তা’য়ালার শত্রুদের পাওনা সেখানে তাদের জন্য চিরস্থায়ী আযাবের ঘর থাকবে-হা-মী-ম আস সাজদা ২৬-২৮। আবু জেহেল-আবু লাহাবদের শতমুখে প্রচারণা আর তার মোকাবেলায় রসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে একক প্রচার কাফিররা বরদাশত করতে পারেনি। তাই তিনি গোপনে দাওয়াত দিতে থাকেন এবং টের পেলেই ইসলামের শত্রুরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ চিত্র আজও দৃশ্যমান।

আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্ত অনেকে শুধুই নির্যাতিত হয়েছেন এবং পরম ধৈর্য অবলম্বন করে গেছেন প্রতিপক্ষের প্রতি কোন ক্ষোভ বা অমঙ্গল কামনা ছাড়াই। সূরা ইয়াসিনে এমন একটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি লোকালয়ে হেদায়াতের জন্য আল্লাহপাক তিনজন রসূল প্রেরণ করেন এবং তাঁদের দীর্ঘ চেষ্টা—প্রচেষ্টার পর একজন লোক ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তাঁর জাতির কাছে ছুটে এসে বলেন তোমরা আনুগত্য কর সেই রসূলদের যারা তোমাদের নিকট কোন বিনিময় চান না এবং নিজেরা হেদায়াতের ওপর প্রতিষ্ঠিত-ইয়াসিন ২১।

এ কল্যাণকামী লোকটিকে শেষপর্যন্ত তার জাতির লোকেরা হত্যা করে এবং এর বদলে আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয় দাখিল হও জান্নাতে। লোকটি তখন বলে ওঠেন- আফসোস আমার জাতির লোকদের জন্য  তারা যদি জানতে পারতো কিসের বদৌলতে আমার রব আমাকে ক্ষমা করলেন ও সম্মানিত লোকদের মধ্যে গণ্য করলেন-ইয়াসিন ২৭। আল্লাহ তাঁর নবীকে বলেছেন-ভালো ও মন্দ কখনই এক নয় ; তুমি মন্দকে দূর কর সেই ভালো দ্বারা যা অতীব উত্তম তাহলে দেখবে তোমার জানের দুশমনরা প্রাণের বন্ধু হয়ে গেছে। আর এ গুণ কেবল তারাই লাভ করে যারা ধৈর্য ধারণ করে এবং এ লোক শুধু তারাই হয় যারা সৌভাগ্যের অধিকারী—হা-মী-ম আস সাজদা ৩৪-৩৫।

আসুন, আমরা কুরবানীর ঐতিহাসিক এ ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের পরিবারকে এক আল্লাহর জন্য উৎসর্গ করার মানসিকতা তৈরি করি। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, আল্লাহ তাআলা তোমাদের স্বাস্থ্য-চেহারা এবং ধনসম্পদের প্রতি দৃষ্টিপাত করেন না ; বরং তিনি দৃষ্টি দেন তোমাদের অন্তর এবং আমলের প্রতি। সুতরাং কোরবানির পূর্বেই কোরবানিদাতার নিয়ত বা সংকল্প শুদ্ধ করে নিতে হবে।

লেখক: ফখরুল ইসলাম নোমানী, ইসলামি চিন্তক ও গবেষক

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট