চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

লকডাউন ছাড়াই করোনার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে চাই সুপরিকল্পনা

ডা. হাসান শহীদুল আলম

২৯ জুন, ২০২২ | ৬:৫৬ অপরাহ্ণ

লকডাউন বা অবরুদ্ধকরণ বলতে একধরনের জরুরি অবস্থাকালীন ব্যবস্থাবিধিকে বুঝায়, যাতে কোন আসন্ন বিপদের হুমকিরর প্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে কোন নির্দিষ্ট এলাকা বা ভবনের ভেতরে বাইরের মানুষ প্রবেশ এবং ঐ এলাকা বা ভবন থেকে মানুষ বের হওয়ার ওপরে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ করার জন্য স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে সাময়িকভাবে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রজ্ঞাপিত ব্যতিক্রম বাদে ভবনের ভেতরে বাইরের মানুষ প্রবেশ এবং ভবন থেকে মানুষ বের হবার ওপরে একাধিকবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল।

বাংলাদেশে যে কারণে লকডাউন ঝুঁকিপূর্ণ:

ক) সামাজিক সংক্রমণ বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে লকডাউন সুফল দেয় না। জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক বলেছেন যে, যখন একটি এলাকায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে তখন যার করোনা শনাক্ত হয়েছে তিনি কার কার সংস্পর্শে এসেছিলেন তাদের কনটাক্ট ট্রেসিং করে এলাকাটিকে লকডাউন করা একটি কার্যকর পদ্ধতি। এই লকডাউনের মাধ্যমে ঐ এলাকায় সামাজিক সংক্রমণ ঠেকানো যায়। কিন্তু সামাজিক সংক্রমণ যদি বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে লকডাউন কোন সুফল দেবে না। এই গবেষণার ভিত্তিতে বাংলাদেশের কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলেছেন যে, বাংলাদেশে এখন লকডাউন কোন কাজে আসবে না।

খ) লকডাউনের ফলে বড়ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনসটিটিউটের গবেষকরা দাবি করেছেন যে, লকডাউনে প্রতিদিন প্রায় ৩৩০০ কোটি টাকা হারাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যে হিসাবে ৪০ দিনের লকডাউনে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকায়।অন্যদিকে এশিয়ান ডেভেলাপমেন্ট ব্যাংক বা এডিবি এর সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী লকডাউনের কারণে বাংলাদেশের আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ অনুমান করা হচ্ছে প্রায় ১৩৩০ কোটি মার্কিন ডলার যা প্রায় ১লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার সমান [বিডিনিউজ২৪ ডট কম, ১০-০৫-২০]।

গ) বস্তিবাসীদের জন্য লকডাউন বাস্তবসম্মত নয়: নগরবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, সরকারী হিসাবে শহরের জনসংখ্যা প্রায় চার কোটিরও বেশি। এর ২০ শতাংশ দরিদ্র হলে প্রায় ৮০ লাখ দরিদ্র মানুষ শহরের বস্তিতে বাস করে। বস্তিবাসী পরিবারগুলি মাসিক গড় আয় মাত্র ৮০০০ টাকা যার প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় করতে হয় তিন বেলা খাদ্যের যোগান দিতে। এক রুমে ৫ বা ততোধিক লোক একসংগে বাস করে। তারা নাগরিক জীবনের ন্যূনতম সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য সামাজিক দূরত্ব বা সেনিটাইজেশন কতটুকু বাস্তবতা? [বাংলা ইনসাইডার, ০৫-০৬-২০]।

ঘ) কৃষিশ্রমিক ও আদিবাসীদের জন্য লকডাউন অকার্যকর: দেশে প্রায় ৩ কোটির অধিক কৃষিশ্রমিক রয়েছেন যাদের নিকট প্রতিদিনের কৃষিশ্রম ও মজুরী হচ্ছে তাদের প্রাথমিকতা। কৃষিশ্রমিকগণ জানেন যে দেশে করোনা সংক্রমণ ঘটছে। কিন্তু বাড়িতে থাকা কিংবা শতভাগ সামাজিক দূরত্ব রেখে কৃষিকাজে অংশগ্রহণ না করা তাদের ভাষ্যমতে বিলাসিতা। দেশের প্রায় ১৫ লক্ষ আদিবাসী জনগোষ্ঠিী রয়েছেন যাদের নিকট প্রতিদিনের শ্রম হচ্ছে রুটি-রুজির অন্যতম উপায়। এই ধরনের জনগোষ্ঠীকে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পড়া কিংবা শতভাগ সেনিটাইজার ব্যবহার করে নিজেদের সংক্রমণ থেকে মুক্ত রাখার বিষয়টিও এক দুরূহ কাজ [বাংলা ইনসাইডার, ০৫-০৬-২০]।

ঙ) সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রতিকূল শ্রমবাজারে লকডাউন ক্ষতিকারক: বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের ৮৫ শতাংশই অনানুষ্ঠানিক খাতের যাদের কাজের কোন নিশ্চয়তা নেই। আনুষ্ঠানিক কোন নিরাপত্তা জাল বা ক্ষতিপূরণের কোন ব্যবস্থা নেই। এর মধ্যে কৃষিখাতে অনানুষ্ঠানিক শ্রমের অংশ ৯৫.৪, শিল্পে ৮৯.৩, নির্মাণে ৯১.৯, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৯২.৫ শতাংশ। মোট কর্মীদের ৩৪.৫ শতাংশ দৈনিক ভিত্তিতে এবং ৭.৩ শতাংশ সাপ্তাহিক ভিত্তিতে নিয়োজিত যাদের কাজের কোন স্থায়িত্ব নেই এবং কাজ না থাকলে তাদের কোন আয় থাকে না। আর বাংলাদেশে মোট কর্মসংস্থানের মাত্র ১০ শতাংশ কাজ ঘরে বসে করা সম্ভব। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের জন্য প্রতিকূল একটি শ্রমবাজারে যখন করোনার আঘাত এবং লকডাউনের প্রয়োগ হয়, তখন পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে বাধ্য [সর্বজনকথা, ১৯-০৪-২২]।

চ) দারিদ্রের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা করোনা মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যার সমানুপাতিক হয়ে যাওয়া: বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন বজায় থাকলে এমন এক পরিস্থিতি সামনে আসতে পারে যেখানে দারিদ্র্যের কারণে মৃত্যুর সংখ্যা করোনা মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যার সমানুপাতিক হয়ে যেতে পারে।

ছ) স্বল্প ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে লকডাউন বজায় রাখা কঠিন: ধনী দেশগুলোর তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম আয়ের দেশগুলোতে লকডাউন বজায় রাখা কঠিন। উদাহরণ হিসাবে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে দেখা যায়, প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ কাজ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে এবং মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষের মাথাপিছু দৈনিক গড় আয় ৫০০ টাকার কম। তাই জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ তাদের পরিবার চালাতে দৈনিক মজুরীর ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় লকডাউনের মতো কঠোর পদক্ষেপ ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে আরও বিপর্যয় বয়ে নিয়ে আসতে পারে।

জ) প্রণোদনাবঞ্চিত থাকায় অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকরা লকডাউনের ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারে না

১. অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকদের সংখ্যা বিপুল: বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৬ সালের জরিপ অনুসারে দেশে মোট শ্রমিকের সংখ্যা ছিল ছয় কোটি। যারমধ্যে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ৮৫.১ শতাংশ অর্থাৎ পাঁচ কোটিরও বেশি শ্রমিক [সর্বজনকথা, ১৯-০৪-২২]।

২. শ্রমিকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন, রেশন ইত্যাদির কোন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকা।

৩. সরকারের কোন প্রতিষ্ঠানের কাছে শ্রমিকদের কোন তালিকা বা ডাটাবেজ না থাকা।

৪. তাদেরকে চিহ্নিত করে অল্পসময়ের মধ্যে তাদের কাছে নগদ অর্থ ও খাদ্য সহায়তা পৌছে দেয়ার যথাযথ প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না থাকা।

ঝ) লকডাউনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি ও শিক্ষাখাত।

ঞ) লকডাউন অকার্যকর হওয়া: বিশেষজ্ঞদের মতে, কমপক্ষে ৭০ শতাংশ লকডাউন কার্যকর করা না গেলে সেই লকডাউন কোন কাজে আসবে না। তার মানে কোটি কোটি মানুষের ঘরবন্দী থাকার ফলাফল কিছু মানুষের কারণে অকার্যকর হয়ে পড়ে   [ইনকেলাব, ০৩-০৫-২১]।

লকডাউনের বিকল্প হচ্ছে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মানা:

ক) করোনা প্রতিরোধে লকডাউন নয়, বরং স্বাস্থ্যসচেতনতার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন বিশিষ্ট অনুজীববিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. বিজন কুমার শীল  [প্রতিদিনের সংবাদ, ০৩-০৫-২১ ]।

খ) সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, গ) মাস্ক ব্যবহার: অনুমিত ধারণা যে, ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ মানুষ সঠিকভাবে মাস্ক পরেন না। গ্রামে এ সংখ্যাটি আরও বেশি [সমকাল, ২৫-১১-২০]।

ঘ) সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা।

উপসংহার: এ পর্যন্ত যেটুকু আলোচনা হলো তার সারমর্ম হিসাবে বলতে চাই যে, বাংলাদেশে যেখানে শ্রমজীবীদের প্রায় ৮৫ শতাংশই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে এবং দেশের আগে থেকে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত ২০ শতাংশ দরিদ্র পরিবারের সাথে উপার্জন হারিয়ে নতুন করে দারিদ্রের মুখোমুখি হওয়া পরিবারের সংখ্যাও বিশাল সেখানে অর্থনীতি বাঁচাতে ও মানুষের জীবিকা বাঁচাতে লকডাউন এর ব্যবহার না করার চিন্তাই যুক্তিযুক্ত।

লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম, ডায়াবেটিস ও চর্মযৌনরোগে  স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত চিকিৎসক

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট