চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

৮ ঘণ্টা কর্মদিবস স্বীকৃতির শতবর্ষ

পাহাড়ী ভট্টাচার্য

৩১ জুলাই, ২০১৯ | ১:০৫ পূর্বাহ্ণ

শোভন কাজের মানদ- নির্ধারণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্বব্যাপী কর্মরত শ্রমজীবী মানুষের জন্য সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা ও শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি তথা সে অধিকার ভোগের সামগ্রিক নিশ্চয়তা বিধানের এক সু-মহান প্রত্যয় থেকে ১৯১৯ সালে আর্ন্তজাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) প্রতিষ্ঠিত হয়। মোটাদাগে, আইএলও প্রধানত: সরকার-মালিক-শ্রমিকের সমন্বয়ে ত্রিপক্ষীয় একটি বৈশ্বিক প্লাটফর্ম, যার ঘোষিত লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী নারী-পুরূষের জন্য উৎপাদনশীল ও শোভন কাজের সুযোগ ও বাতাবরণ সৃষ্টি, কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনতা-সাম্য-মৈত্রী-ন্যায় ও মানবিক মর্যাদার মত গুরুত্বপূর্ণ দিকসমূহের সুরক্ষা সাধন। এ বছর আইএলও প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। একই সাথে আইএলও-র ১ম কনভেনশন বিশ্বব্যাপী ‘৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টাকে শ্রমঘণ্টা’ বিবেচনার যে আন্তর্জাতিক প্রবিধান ও মানদ-, সেটিরও শতবর্ষ। স্মর্তব্য, দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের বিষয়টি ২৮ নভেম্বর ১৯১৯ সালে আমেরিকার ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আইএলসি কংগ্রেসে প্রস্তাবিত হয়। ১৩ জুন ১৯২১ সাল হতে সদস্য রাষ্ট্রসমূহ কর্তৃক তা চূড়ান্তকৃত, অনুসমর্থীত ও স্বীকৃত হয়ে আসছে। ২০১৯ সাল, সে অর্থে, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ঘোষণারও শতবর্ষ ।
এক শতাব্দিকাল দীর্ঘ সময়। এ সময়ের মধ্যে শ্রমজীবী মানুষসহ বিশ্ববাসীকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে দুু’দ্ুটি মহাযুদ্ধ, নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বহুমাত্রিক মানবিক বিপর্যয়। বিগত একশ’ বছরে আমাদের মানবসভ্যতা অগ্রসর হয়েছে নিয়ত সংঘাত-সংঘর্ষ-পরিবর্তনের নানান মাত্রিকতা অতিক্রমণ-এর মধ্য দিয়ে। আইএলও প্রতিষ্ঠা ও বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস স্বীকৃতির শতবর্ষে উপনীত হয়ে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, যে লক্ষ্য থেকে আইএলও’র প্রতিষ্ঠা, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে কিংবা বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী ৮ ঘণ্টা দৈনিক শ্রমের বিষয়টিই বা আজ কতটুকু নিশ্চিত করা গেছে? এ কথা অনস্বীকার্য যে, বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রাতিষ্ঠানিক শ্রম সেক্টর নির্বিশেষে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস-এর বিষয়টি অদ্যাবধি সর্বোতভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। কেবলমাত্র সরকারী কর্মপ্রতিষ্ঠান ও বহুজাতিক গুটিকয়েক সংস্থায় তা অনুসৃত হলেও বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষ প্রত্যহ ৮ ঘণ্টার অধিক শ্রমদানে যুক্ত। আমাদের দেশের শ্রমজীবী মানুষ গড়ে ১২-১৪ এমনকি ১৬ ঘণ্টাও কায়িক ও বুদ্ধিবৃত্তিক-উভয়বিধ শ্রমদানের সাথে সম্পৃক্ত। ব্যাপারটির সাথে কেবল মালিক-কন্ট্রাকটর-নিয়োগকর্তার ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, জবরদস্তি কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছার মনস্তত্তই সম্পৃক্ত নয়, যুক্ত সমাজ-রাষ্ট্রের সামগ্রীক মানস ও সদিচ্ছা।
আমাদের দেশে উপনিবেশিক ও উত্তর-উপনিবেশিক কালের শিল্পায়নের ধারাবাহিকতায় কৃষি-নির্ভর শ্রমজীবী মানুষদের একাংশ নগরায়ণজনিত পরিবর্তন প্রক্রিয়ার অনিবার্য অংশিদার রূপে শিল্প-প্রতিষ্ঠানে, কল-কারখানায় ও অনুরূপ বিবিধ কর্মক্ষেত্রে দক্ষ-অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে শ্রম দিয়ে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছে।
আমাদের দেশের সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিয়োগ ও পরিচয়পত্র, সার্ভিসবুক এমনকি ন্যুনতম পারসোনাল রেকর্ডস বিহীন অবস্থায়, মৌখিক চুক্তিতে নিযুক্ত হয়ে নারী ও পুরূষ শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত নিয়োগকর্তা কিংবা উর্ধতন কর্তৃপক্ষের হাতে লাঞ্চিত হতে, সহকর্মীদের দ্বারা অশোভন ও অন্যায় আচরণের শিকার হতে, মজুরী-ওভারটাইম-বোনাস-ছুটিসহ শ্রমআইন-স্বীকৃত পাওনাদি হতে শ্রমিকদের নানাভাবে বঞ্চিত হতে দেখা যায়। অধিকার-বঞ্চিত ও ন্যূনতম মানবিক মর্যাদাহীন অবস্থায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই কর্মক্ষেত্রে সিংহভাগ শ্রমিককে কাজ করতে দেখা যায়। শ্রম-শোষণ ও দাসত্বের এ যেন এক আধুনিক স্বরূপ! ফলে, যেখানে জীবন ধারণের উপযোগী মজুরী ও আইন-স্বীকৃত পাওনাদি পেতেই শ্রমিককে সড়ক অবরোধ করতে হয়, প্রায়শ: রাজপথে অনশনে-প্রতিবাদে শামিল হতে হয়, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোন শ্রমিক নেতা, আইনজীবী কিংবা এনজিও-র সহায়তায় আদালতের দ্বারস্থ হতে হয়, সেখানে ৮ ঘণ্টার কর্মঘণ্টার নিশ্চয়তা, অতিরিক্ত কাজের জন্য যথাযথ ওভারটাইম ভাতা, পর্যাপ্ত খাবার ও বিশ্রাম, সাপ্তাহিক ছুটি, অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় চিকিৎসা ও প্রয়োজনে পর্যাপ্ত ক্ষতিপুরণ প্রাপ্তির বিষয়াবলি অনেকাংশে ‘অকল্পনীয়’-ই বটে!
এ সামগ্রিক দুরাবস্থাকে হটানো ও অচলায়তন ভাঙ্গার কাজটি ধারাবাহিক, যৌথ ও দীর্ঘমেয়াদী। একদিকে তার জন্য যেমন ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন-সংগ্রাম-সংগঠনের রয়েছে দায়, তেমনি অন্যদিকে রাষ্ট্র-সরকার-রাজনীতি ও প্রশাসনেরও রয়েছে সবিশেষ ভূমিকা।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট