চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

শবে কদরের তাৎপর্য ও ফজিলত

২৮ এপ্রিল, ২০২২ | ১০:০৪ অপরাহ্ণ

মুহাম্মদ আবুল হোসাইন 

রহমত, মাগফিরাত ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাস রমজানের মূল উদ্দেশ্য হল, সিয়াম সাধনার মাধ্যমে তাকওয়া বা খোদাভীতি অর্জন করে তদনুযায়ী নিজের জীবনকে পরিচালনা করা। আবার এইমাসের শেষ দশকে এমন একটি রাত্রি রয়েছে যে রাত্রির ইবাদাত হাজার মাসের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম। 

বিত্র কুরআ’নুল কারীমে এই রাত্রিকে ‘লাইলাতুল ক্বদর’ বা ভাগ্যরজনী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এই মাসে সিয়াম সাধনাসহ যতপ্রকারের ইবাদাত করার চেষ্টা করা হয়েছে, তার ভূল-ত্রুটি থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে মহান আল্লাহর দরবারে কবুল করানোর আরযি দেওয়ার এটিই অন্যতম রজনী।

‘ক্বদর’ শব্দটি আরবি। এর অর্থ ভাগ্য, মাহাত্ম্য ও সম্মান। এই রাত্রিতে মানুষের পরবর্তী একবছরের ভাগ্য ফেরেশতাগণের নিকট হস্তান্তর করা হয়, যার মধ্য মানুষের বয়স, মৃত্যু ও রিযিকসহ সবকিছু নিহীত রয়েছে। পবিত্র কুরআ’নুল কারীমের সাতানব্বইতম ‘আল-ক্বাদর’ পূর্ণাঙ্গ সূরাটিতে এই মহিমান্বিত রজনীর মর্যাদা বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন: (নিশ্চয়ই আমি এটা (আল-কুরআ’ন) ক্বাদর রজনীতে অবতীর্ণ করেছি। আর ক্বাদর রজনী সম্পর্কে তুমি কী জান? লাইলাতুল ক্বাদর হাজার মাসের চাইতে উত্তম।

এই রাত্রিতে ফেরেশতাগণ ও রূহ (জিবরাঈল) তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কাজের জন্য অবতীর্ণ হন। শান্তিময়, এই রাত ফজর উদয় পর্যন্ত”। [সূরা আল-ক্বাদর]। সূরা দুখানের আয়াতে বর্ণনা করা হয়েছে: (পবিত্র রজনীতে তাকদীর সংক্রান্ত সব ফয়সালা লিপিবদ্ধ করা হয়)। [সূরা আদ-দুখান: ৪।] এর মর্ম হল, এ বছর যেসব বিষয় প্রয়োগ করা হবে, সেগুলো লাওহে মাহফুজ থেকে নকল করে ফেরেশতাগণের কাছে সোপর্দ করা হবে।

এই রজনীর শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন হাদীসেও বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। এই মাসের শেষ দশকে যেকোন দিন ‘লাইলাতুল ক্বাদর’ হতে পারে, তাই রাসূলুল্লাহ (দ.) শেষ দশককে এত বেশী গুরুত্ব দিতেন যে, তিনি ইবাদাতের জন্য পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি গ্রহণ করতেন এবং পুরো রাত্রি জাগ্রত থেকে নামাজ, কুরআ’ন তেলাওয়াত, দুয়া ও যিকিরের মাধ্যমে অতিবাহিত করতেন। এমনকি তিনি তার পরিবারের সদস্যদেরকেও ইবাদাত করার জন্য ঘুম থেকে জাগিয়ে দিতেন। উম্মুল মূ’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন: “যখন রমযানের শেষ দশক আসত তখন রাসূলুল্লাহ (দ.) তার চাদর কষে নিতেন (অর্থাৎ বেশী বেশী ইবাদাতের জন্য প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাতে জেগে থাকতেন ও পরিবার পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন”। [সহীহ বুখারী: ২০২৪; সহীহ মুসলিম: ১১৭৪]

ইমাম ইবনে খুযায়মা ও বায়হাকী (রহ.) বিশুদ্ধ সনদে বর্ণনা করেন। শা’বান মাসের শেষ দিনে রাসূলুল্লাহ (দ.) রমজান মাসের মর্যাদা বর্ণনা করে দীর্ঘ এক ভাষণ প্রদান করেন এবং উক্ত ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন যে, এই মাসে এমন এক মহিমান্বিত রাত রয়েছে যে রাতের মাহাত্ম্য হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। অন্য হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “রমজান মাসে এমন এক রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। যে ব্যক্তি এ রাতের কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সে যাবতীয় কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হল”। [নাসায়ী ও মুসনাদে আহমাদ] এই রাতে অগণিত ফেরেশতা আল্লাহর বান্দাদের ইবাদাত পর্যবেক্ষণ করার জন্য পৃথিবীতে বিচরণ করে থাকেন এবং ফজর উদিত হওয়ার পর আসমানে আরোহন করে মহান আল্লাহকে বান্দাদের পক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করেন। হাদীসে এসেছে, “ক্বাদর রাত্রিতে পৃথিবীতে ফেরেশতারা এত বেশী অবতরণ করেন যে, তাদের সংখ্যা পাথরকুচির চেয়েও বেশী”। [মুসনাদে তায়ালাসী: ২৫৪৫]

রাসূলুল্লাহ (দ.) এই রাতের নির্দিষ্ট কোন তারিখ উল্লেখ করেননি। শুধুমাত্র রমজানের শেষ দশকের বেজোড় দিনগুলোতে এই রজনী অন্বেষণের নির্দেশনা দিয়েছেন। হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল ক্বাদর অন্বেষণ কর”। [সহীহ বুখারী: ২০২০; সহীহ মুসলিম: ১১৬৯।] অন্য হাদীসে  বর্ণনা করা হয়েছে: “তোমরা রমযানের শেষ দশকের বেজোড় রাতে লাইলাতুল ক্বাদরের সন্ধান কর”। [সহীহ বুখারী: ২০১৭।] তবে এই রাতের নির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে ইসলামিক স্কলারদের বিভিন্ন উক্তি রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় চল্লিশটি বলে ইমাম ইবনে হাজার আল-আসকালানী (রহ.) উল্লেখ করেছেন।

ততমধ্যে উল্লেখযোগ্য উক্তিটি হল, সাহাবীদের মধ্য উমর ইবনুল খাত্তাব, উবাই ইবনে কা’ব, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস ও হুযাইফা (রা.)-সহ একদল সাহাবী ছাব্বিশ তারিখ দিনগত সাতাশ তারিখের রাতকে সম্ভাব্য লাইলাতুল ক্বাদর হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এই উক্তিটিকে অধিকাংশ আলেমগণ গ্রহণযোগ্য হিসেবে মত দিয়েছেন এবং তার আলোকে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সম্ভাব্য হিসেবে উক্ত তারিখে লাইলাতুল ক্বাদর পালন করা হয়। এই রাত্রিতে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাত রয়েছে। ততমধ্যে বিখ্যাত আলেমগণ এই রজনীতে ইবাদাতের পূর্বে গোসল করে নতুন পোশাক পরিধান করে সুগন্ধি লাগানোকে মুস্তাহাব বলেছেন।

এই রাতের আমলের মধ্য উল্লেখযোগ্য হল, ফরজের পর যত বেশী সম্ভব নফল নামায পড়া। কেননা, এই রাতের নফল নামাজের উসিলায় করুণাময় ক্ষমাশীল আল্লাহ বান্দার পূর্ববর্তী অপরাধগুলো ক্ষমা করে দেন। হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (দ.) বলেছেন: “যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সাওয়াব লাভের আশায় নামাজের মাধ্যমে লাইলাতুল ক্বাদর কাটাবেন,তার পূর্ববর্তী গুণাহসমূহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে”। [সহীহ বুখারী: ১৯০১] লাইলাতুল ক্বাদরের অন্যতম আমল হল কুরআ’ন তেলাওয়াত করা। দু’য়া এই রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমলসমূহের মধ্য অন্যতম।

এই রাতে মহান আল্লাহ বান্দার ফরিয়াদ বেশী বেশী কবুল করেন। হাদীসে এসেছে, উম্মুল মূ’মেনীন আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) লাইলাতুল ক্বাদরের আমল সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (দ.)-এর কাছে জানতে চাইলে তিনি আল্লাহর কাছে বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। [সুনানুল কুবরা:৭৬৬৫] যিকিরও এই মহিমান্বিত রজনীর অন্যতম একটি আমল। লাইলাতুল ক্বাদর প্রত্যেক বান্দার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই রাতেই মহান আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের পরবর্তী একবছরের ভাগ্য ফেরেশতাদের নিকট হস্তান্তর করেন। তাই এই রাত্রিতে জাগ্রত থেকে বিভিন্ন প্রকারের ইবাদাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা প্রত্যেক বান্দার কর্তব্য।

মুহাম্মদ আবুল হোসাইন সহকারী অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্বকোণ/সাফা

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট