চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

২৫ মার্চের ভয়াল কালরাত, স্বাধীনতা দিবস ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

২৫ মার্চ, ২০২২ | ৮:৪৮ অপরাহ্ণ

এম ইব্রাহীম আখতারী

কালের ধারাবাহিকতায় বাঙালির জাতীয় জীবনে সমাগত ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, যা আমাদের মহান স্বাধীনতা দিবস। এটি একটি ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত দিন। যার নেপথ্যে রয়েছে, ৩০ লক্ষ বাংলা মায়ের অকুতোভয় মর্দে মুজাহিদদের অমূল্য প্রাণ বলিদানের মত কীর্তিগাথা।

কেবলই তা নয়, এটি হচ্ছে ২ লক্ষ মুক্তিকামী মা-বোনের সম্ভ্রমহানির মত এক ট্রাজেডি। এটি বাঙালির রক্তমূল্যে কেনা মহা অর্জন। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে বাংলা ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়েই মূলত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয় পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে। ফলশ্রুতিতে ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন ও ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়েই এ ক্ষোভ চূড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।

আর এ পটভূমিতে অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের গণনির্বাচন। এ নির্বাচনে গোটা পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে সক্ষম হয়। পাকিস্তানের সংবিধান মোতাবেক বিজয়ী দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর বাধ্যতামূলক থাকলেও এ নিয়ে শুরু হয় গভীর ষড়যন্ত্র। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো আওয়ামী লীগ এর নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করতে সংবিধান বিরোধী নানাবিধ চক্রান্তে লিপ্ত হয়। অতঃপর ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে লেলিয়ে দেয় বাঙালির বিরুদ্ধে। পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী পূর্ববাংলার ঘুমন্ত নিরীহ-নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর হামলে পড়ে। অপারেশন সার্চলাইট নাম দিয়ে অতর্কিতভাবে নির্বিচারে চালাতে থাকে লোমহর্ষক ও নৃশংস হত্যাযজ্ঞ।

সেদিন গোলা-বারুদের ঝাঁঝালো গন্ধে ভিন্ন চেহারায় দৃশ্যমান হয় তাবৎ পূর্ববাংলার জনপদ। এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে – কেবল এ রাতে ঢাকা মহানগরীতেই প্রায় ৫০ হাজার নর-নারীর প্রাণহানি ঘটেছে। যেজন্য এটিকে কালো রাত হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। অতঃপর এ দিনে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতিস্বত্বার স্রষ্টা, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মহান স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। অতঃপর শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা দেশমাতৃকার টানে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে এ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সর্বত্র গড়ে তোলে তীব্র প্রতিরোধ। আর বিক্ষিপ্ত এ প্রতিরোধ পরিণত হয় সশস্ত্র জনযুদ্ধে।

যে যুদ্ধে প্রাণহানি ঘটে ৩০ লক্ষ মানুষের। সম্ভ্রমহানি ঘটে প্রায় ২ লক্ষ নিরপরাধ  মা-বোনের। দীর্ঘ ৯ মাস এ রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয় ও অবিচল আস্থা নিয়ে লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যায় বাঙালি। কোনপ্রকার প্রশিক্ষণ ব্যতিরেকে এবং কোন রণকৌশল এর প্রাক অভিজ্ঞতা না থাকার পরও শুধুমাত্র গেরিলা ট্রেনিং করে পাকিস্তানের সুসজ্জিত, প্রশিক্ষিত ও চৌকস একটি সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি ছিনিয়ে আনে কাঙ্খিত স্বাধীনতা। ২৫ বছরের শোষন-বঞ্চনা, নিপীড়ন-নির্যাতন, জুলুম-অত্যাচার ও বৈষম্য-দুঃশাসনের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে বাঙালি জাতি।

বিজয়ী হয় লাল-সবুজের পতাকা। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান করে নেয় একটি দেশ, বাংলাদেশ। পূর্বপাকিস্তান রূপান্তরিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে। বিশ্ব অঙ্গনে বাঙালি জাতি গৌরবময় একটি স্বকীয় অবস্থান সৃষ্টিতে সক্ষমতা অর্জন করে। সুতরাং জাতীয় জীবনে অপরিসীম তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে এ মহান স্বাধীনতা দিবস। এটি বাঙালি জাতির গৌরব-অহংকার তথা অনুপ্রেরণার দিন। যেথায় রয়েছে অনেক কিছু হারানোর কষ্ট ছাড়াও সীমাহীন সুখানুভূতি। এ দিবসের পদধ্বনি বাঙালির হৃদয়ে সৃষ্টি করে বৈপ্লবিক জাগরণ। এমনকি অধিকতর শাণিত হয় চেতনাবোধ। যেটি সঞ্জীবনী শক্তি যোগায় অন্যায়-অসংগতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে। উপরন্তু নব-উদ্যমে উদ্দীপ্ত ও উজ্জীবিত হয় বাঙালি। অনস্বীকার্য বাস্তবতা হলো, মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে বাঙালির বীরত্বগাথা। গৌরব ও অহংকারের প্রতীক। যেটির নেপথ্য হাকিকত কেবলই একটি ভূখণ্ডের মালিকানা অর্জনের লড়াই ছিল না। বরং এটি ছিল জাতিগত বৈষম্য আর বঞ্চনার অশুভ শিকারে পরিণত একটি জাতির সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিসহ ভাষা-সংস্কৃতি, কৃষ্টি-সভ্যতা এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সুরক্ষার জেহাদ। আর এটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শ।

যেজন্য ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার এর জারিকৃত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদনপূর্বক বলা হয়- বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিতকরণে ‘সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম’। অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার তথা  Equality, Human dignity and social Justice এ তিনটি বিষয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের আদর্শ ও রাষ্ট্রীয় দর্শন। একটি মৌলিক চেতনা ও আদর্শকে প্রকাশের জন্য ৩টি শব্দের ব্যবহার হয়েছে ফরাসী বিপ্লবের মাধ্যমে। ৩টি শব্দের সমন্বয়ে আদর্শ প্রকাশের রীতি অনেক পুরনো।

ইংরেজ দার্শনিক জনলক উদ্ভাবিত Life, Liberty and Property. অর্থাৎ জীবন, মুক্তি ও সম্পদ। পরবর্তীতে টমাস জেফারসন আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে Life, Liberty and Pursuit of Happiness এ তিন আদর্শ ঘোষণা করেন। রুশবিপ্লবের ঘোষণায় ছিল Peace, Land, Bread. অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রীয় আদর্শ হচ্ছে Peace, Order and good Government. ভিয়েতনাম রাষ্ট্রের আদর্শ হচ্ছে Democracy, Justice and Civilization. ফ্রান্স বিপ্লবের মূলমন্ত্র ছিল Liberty, Equality and Fraternity. ফ্রান্সের ঘোষণাপত্রে বর্ণিত এটিকে তাদের সংবিধানে বলা হয়েছে- The Maxim of the Republic shall be Liberty, equality and Fraternity. The Principal of thr Republic shall be Government of the people, by the people and for the people.

ফ্রান্সের ঘোষণাপত্রে এ আদর্শকে রাষ্ট্রীয় দর্শন হিসেবে নির্দেশনা দিয়েছে এবং সংবিধানে এ তিন আদর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ঘোষণা করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের ঘোষণাপত্রে বর্ণিত সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার- এ তিন আদর্শকে এযাবতকাল কোথাও রাষ্ট্রের আদর্শিক ভিত্তি হিসেবে গুরুত্ব দেয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের এ তিন আদর্শ উল্লেখ না করে রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি ঘোষণার ফলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্র বিনির্মাণ না হয়ে রাষ্ট্র ভয়াবহ বিপজ্জনক পথেই ধাবিত হচ্ছে এবং রাষ্ট্র থেকে আত্মিক , নৈতিক ও উচ্চতম আদর্শের রাষ্ট্রচিন্তা নির্বাসিত হয়েছে।

বর্তমানে বেশকিছু অবাক করা সাফল্যে দেশের অর্জনের তালিকা আজ অধিকতর সমৃদ্ধ। যেমন- ২০১৫ সালের জুলাই মাসে নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পা রাখার সক্ষমতা অর্জন করে এদেশ। উপরন্তু ইতোমধ্যে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রাথমিক স্বীকৃতিও লাভ করে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৮.১৫ এ উন্নীত হয়েছে। শুধু তাই নয়, উন্নয়ন-অগ্রগতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় অনেক সূচকে ভারত-পাকিস্তান থেকেও এগিয়ে আছে এ দেশ। বাংলাদেশ এর জাতীয় বাজেট এখন ৬ লাখ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এছাড়া রয়েছে আরও অনেক কিছু।

বাংলাদেশের এ অর্জন নিঃসন্দেহে মহাগৌরবের। এ অর্জনকে সুদৃঢ় ও সুসংহত করতে হবে। যেজন্য কিছু আবশ্যকীয় বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা বাঞ্ছনীয় বৈ কি। যেমন- সর্বাগ্রে দুর্নীতির মূলোৎপাটন করতে হবে। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনয়ন করতে হবে। অর্থ-সম্পদ আহরণে মানুষের অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার লাগাম টানতে হবে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে আমলা, বিচার ব্যবস্থা, আইন-শৃংখলা বাহিনী, শিক্ষাব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক নেতাকর্মীসহ সর্বক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তের কবল থেকে মুক্ত করতে হবে। শ্রমজীবী মানুষের জীবনমানের উন্নয়নে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।

কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কর্মসংস্থান খাত বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প, বিনিয়োগ কিংবা অর্থনৈতিক খাতের সম্প্রসারণ ঘটানোর দিকে মনোযোগী হতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির উপর যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য শ্রমিক গড়ে তুলতে হবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা রোধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণসহ সুশাসন নিশ্চিত করতে হবে। সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ নির্মূলে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অটুট রেখে উন্নত রাষ্ট্র হওয়ার লক্ষ্যার্জনে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণের অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশমান ধারা অব্যাহত রাখাসহ একটি সচ্ছ জবাবদিহিমূলক, পেশাদারী ও দক্ষ জনপ্রশাসন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার মতো এহেন Extraordinary নেয়ামতের কদরদানী হওয়া ছাড়াও সকলের জন্য স্বাধীনতার প্রকৃত স্বাদ উপভোগ্য হবে।

উপরন্তু রক্তমূল্যে অর্জিত স্বাধীনতার মূল্যবোধ যাতে ভূলুন্ঠিত না হয়, তজ্জন্য সকলেরই সজাগ দৃষ্টি রাখা বাঞ্ছনীয়। অতএব, স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় সকলের চৈতন্যবোধ অধিকতর শাণিত হওয়াই হোক এবারকারের স্বাধীনতা দিবস পালনের মূল লক্ষ্য।

লেখক: অধ্যক্ষ, কলামিস্ট, রাজনীতিবিদ ও পরিবেশ-মানবাধিকারকর্মী

 

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট