চট্টগ্রাম বুধবার, ২৪ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে কর্জে হাসানার গুরুত্ব ও ফজিলত

এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী

১৪ জানুয়ারি, ২০২২ | ১২:৪৪ অপরাহ্ণ

ইসলাম শান্তি ও সহানুভূতির ধর্ম। পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা প্রদর্শন এবং সহযোগিতার মনোভাব ইসলামের অন্যতম আদর্শিক বিষয়। এ জীবন শুধু নিজের ভোগ-বিলাসিতার জন্য নয়; বরং গোটা সৃষ্টির উপকার সাধন এবং কল্যাণকামিতা প্রত্যেক মানুষের অন্তরে জাগ্রত থাকবে, এটাই ইসলামের বিধান।

মহান আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের আশায়, সওয়াবের নিয়তে বিনা শর্তে কাউকে কোনো কিছু ঋণ দিলে তাকে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ বলে। ইসলামী আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় কর্জে হাসানার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। কর্জ অর্থ ঋণ বা ধার আর হাসানা অর্থ উত্তম। উভয়ে মিলে ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ।

মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে মানুষকে উত্তম ঋণ প্রদানের প্রতি উৎসাহ দিয়েছেন। উত্তম ঋণের বহুগুণ বিনিময় ঘোষণা করেছেন। যাতে করে মানুষ পরস্পরের বিপদে এগিয়ে আসে এবং একে অপরকে সহযোগিতা প্রদান করে। আর্থিক ইবাদতের মধ্যে অন্যতম হলো ‘কর্জে হাসানা’ বা উত্তম ঋণ। কর্জে হাসানা বা উত্তম ঋণ প্রদান প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা আল ইমরানের ৯২ আয়াতে এরশাদ করেন- ‘কখনও তোমরা কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তু (আল্লাহতায়ালার রাস্তায়) ব্যয় না করবে।’ অন্যত্র সুরা বাকারার ২৪৫ আয়াতে এরশাদ হয়েছে- ‘কে সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করবে? ফলে আল্লাহ তাকে দ্বিগুণ, বহুগুণ বৃদ্ধি করে দেবেন। আর আল্লাহতায়ালাই রিজিক সংকুচিত করেন ও বৃদ্ধি করেন। তোমাদেরকে  তার কাছেই ফিরে যেতে হবে।’

কর্জে হাসানা আদান-প্রদানে রয়েছে অনেক ফজিলত। এ কথা যেমন ঠিক, আবার ঋণ নিয়ে যদি তা পরিশোধ করা না হয়, সে সম্পর্কেও রয়েছে কঠিন সতর্কতা। এ সম্পর্কেও পবিত্র কোরআন ও হাদিসে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা- ঋণ গ্রহণ সম্পর্কে সতর্কতা অবলম্বনে মহান আল্লাহতায়ালা সুরা বাকারার ২৮২ আয়াতে এরশাদ করেন- ‘হে মুমিনগণ, তোমরা যখন পরস্পরে নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ঋণের আদান-প্রদান করো, তখন তা লিখে রাখ। ‘আবার যদি কেউ ঋণ গ্রহণ করার পর তা দিতে অপারগ হয় বা কষ্টে পতিত হয়, সে সময় ঋণদাতার করণীয় বিষয়েও মহান আল্লাহতায়ালা নির্দেশনা দিয়েছেন- ‘আর ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি অভাবী হয়, তাহলে তাকে সচ্ছল হওয়া পর্যন্ত অবকাশ দাও। আর যদি ঋণ মাফ করে দাও, তাহলে সেটা তোমাদের জন্য আরও উত্তম, যদি তোমরা তা জানতে।’ হজরত মুহাম্মদ (সা.) মানুষকে তাদের ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে অনেক সতর্ক করেছেন।

ঋণ পরিশোধের গুরুত্ব সম্পর্কে রয়েছে অসংখ্য হাদিস। যেমন-হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, ‘কোনো ব্যক্তি ঋণ রেখে মারা গেলে রাসুল (সা.) ওই ব্যক্তির জানাজা পড়াতেন না বরং অন্যকে পড়াতে নির্দেশ দিতেন’। বুখারির এক বর্ণনায় এসেছে, রাসুল (সা.) এরশাদ করেন- ‘যে ব্যক্তি কারও কাছে কর্জ নেয় এবং তা আদায় করার নিয়ত রাখে না, আল্লাহ তাকে ধ্বংস করে দেবেন।’ হজরত ছোহায়েব (রা.) বর্ণনা করেন, ‘যে ব্যক্তি ঋণ গ্রহণ করেছে কিন্তু তা পরিশোধ করার ইচ্ছা পোষণ করেনি, সে ব্যক্তি চোর সাব্যস্ত হয়ে আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে’ (ইবনে মাজাহ, তারগিব)। হজরত বারা ইবনে আজে (রা.) বর্ণনা করেন, ‘ঋণী ব্যক্তি ঋণের কারণে নিঃসঙ্গ-বন্দি জীবনযাপন করবে এবং তা অশান্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে থাকবে।

ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির জন্য ঋণ পরিশোধ করা অত্যন্ত জরুরি। এ কারণেই কোনো ব্যক্তির মৃত্যুর পর যদি সে ঋণগ্রস্ত হয়ে থাকে, তবে তার সম্পদ থেকে প্রথমে ঋণ পরিশোধ করা জরুরি। অতঃপর বাকি সম্পদ অংশীদারদের জন্য প্রযোজ্য। ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি যদি ইসলামের জন্য শাহাদাতকারীও হয়, তবু তাকে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ সম্পর্কে নবীর (সা.) একটি গুরুত্বপূর্ণ হাদিস রয়েছে। হজরত কাতাদাহ (রা.) বর্ণনা করেন, একবার রাসুল (সা.) লোকদের সমাবেশে দাঁড়ালেন এবং এ আলোচনা করলেন যে, আল্লাহর দ্বীনের জন্য জিহাদ ও আল্লাহর প্রতি ইমান সর্বোত্তম আমল বটে। এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, আমি আল্লাহর দ্বীনের জন্য জিহাদে যদি নিহত হই, তবে আল্লাহ আমার জীবনের সব গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন কি? রাসুলুল্লাহ (সা.) উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, যদি তুমি রণাঙ্গনে স্থিতিশীল থাক, সওয়াব লাভের নিয়ত করে থাক, সম্মুখদিকে থাক, পলায়নের দিকে না থাক; কিন্তু ঋণ ব্যতীত (ইসলামের জন্য শহীদ হওয়ার দ্বারা ঋণ মাফ হবে না)। এই মাত্র জিবরিল আমাকে এ কথা বললেন’ (মুসলিম)। সুতরাং কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত হলে সে ঋণ আদায়ে যথাসম্ভব চেষ্টা করা উচিত। ঋণ আদায়ের সামর্থ্য না থাকলেও ঋণ আদায়ের প্রবল ইচ্ছা পোষণ ও চেষ্টা করা জরুরি।

ইসলামি অর্থনীতিতে দারিদ্র্যবিমোচনে কর্জে হাসানা একটি শক্তিশালী মাধ্যম। কর্জে হাসানা দেওয়া আল্লাহকে ঋণ দেওয়ার শামিল। আল্লাহকে ঋণ দিয়ে একজন মুসলমান তার ইমানি দায়িত্ব পালন করতে পারে। জাকাতের ক্ষেত্রে সময় ও পরিমাণ নির্দিষ্ট, কিন্তু ‘কর্জে হাসানার ক্ষেত্রে তেমনটি নেই। একজন ব্যক্তি যেকোনো সময়ে যেকোনো পরিমাণ কর্জে হাসানা প্রদান করতে পারে। এ জন্য ব্যক্তির ইচ্ছাই যথেষ্ট। কর্জে হাসানার মাধ্যমে অভাবী মানুষরা তাদের কঠিন সময়কে মোকাবিলা করে উন্নতি ও অগ্রগতির পথে ধাবিত হতে পারে। এ জন্য কল্যাণমূলক অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কর্জে হাসানার বিস্তার ও প্রচলন অত্যন্ত জরুরি।

কিয়ামতের ময়দানে আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা লাভ করার অন্যতম উপায় হলো অভাবী ও দরিদ্র  ঋণগ্রস্তদের ঋণ মাফ করে দেওয়া। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের পূর্ববর্তী লোকদের মধ্যে এক লোকের হিসাব গ্রহণ করা হয়, কিন্তু তার মধ্যে কোনো ধরনের ভালো আমল পাওয়া যায়নি। কিন্তু সে মানুষের সঙ্গে লেনদেন করত এবং সে ছিল সচ্ছল।তাই দরিদ্র লোকদের মাফ করে দেওয়ার জন্য সে তার কর্মচারীদের নির্দেশ দিত। রাসুল (সা.) বলেন, আল্লাহ (ফেরেশতাদের) বলেন, ‘এ ব্যাপারে (অর্থাৎ তাকে ক্ষমা করার ব্যাপারে) আমি তার চেয়ে অধিক যোগ্য। একে ক্ষমা করে দাও।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৬১;  তিরমিজি, হাদিস : ১৩০৭)। অন্য এক বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি এটা চায় যে আল্লাহ তাকে কিয়ামত দিবসের দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দিক, সে যেন অক্ষম ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির সহজ ব্যবস্থা করে কিংবা ঋণ মওকুফ করে দেয়।’ (মুসলিম, হাদিস: ১৫৬৩)

ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়িয়ে দিলে আল্লাহ তাআলা দান-সদকার সমতুল্য সওয়াব দান করেন। রাসুল (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি (ঋণগ্রস্ত) অভাবী ব্যক্তিকে অবকাশ দেবে, সে দান-খয়রাত করার সওয়াব পাবে। (ইবনে মাজাহ, হাদিস ২৪১৮)। মহান আল্লাহ আমাদের আর্থিক সংকটের এ সময়ে অভাবী, গরিব ও ঋণগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর, মুসলিম উম্মাহকে উত্তম ঋণ গ্রহণ করা আবার সে ঋণ যথাসময়ে আদায় করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: এস এম ফখরুল ইসলাম নোমানী (মোরশেদ) ইসলামি চিন্তক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট