চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

খাদ্যে ভেজাল: কিছু প্রাসঙ্গিক কথা

সৈয়দা সারওয়ার জাহান

৭ নভেম্বর, ২০২১ | ১২:৪৯ পূর্বাহ্ণ

পোল্ট্রি খাদ্যে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হলে (যেমন: ট্যানারী বর্জ্য দ্বারা তৈরি খাবার) হেভি মেটাল (ক্রোমিয়াম, লেড ইত্যাদি) মানুষের শরীরে অনুপ্রবেশ করে। বৃদ্ধি প্রবর্ধক, এন্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হলে শারীরিক বিপত্তি ও এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হতে পারে।

প্রাণীরোগ চিকিৎসায় এন্টিবায়োটিকস ব্যবহৃত হলে উইথড্রয়াল পিরিয়ড মেনে চলতে হবে। তা না হলে এন্টিবায়োটিক দুধ বা মাংসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করবে এবং এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি করবে।

সময়ের সাথে সাথে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশের মধ্যে মিথস্ক্রিয়া বৃদ্ধি পাচ্ছে। সংগতকারণেই রোগের প্রাদুর্ভাব ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। খাদ্য ও দূষণ এর ঘনিষ্ঠ অনুষঙ্গ। ফলে One Health ধারণাটির ক্রমবিকাশ হচ্ছে। এতে মানুষ, প্রাণী ও পরিবেশ রক্ষায় সমন্বিত দায়িত্ব গ্রহণ করা দরকার। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি করা, তাদেরকে সতর্ক করা এবং প্রয়োজনে শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। পরিবেশের দূষণ নানাভাবে হতে পারে। ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র ফেলা, ব্যাটারি এবং অবশিষ্টাংশ ফেলা, ইন্ডাস্ট্রিগুলোতে ইটিপি ব্যবহার না করার ফলে রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি ড্রেনে এবং ড্রেন থেকে নদীতে চলে যায়। নদীর পানি সেচের মাধ্যমে জমিতে আসে। ফলে রাসায়নিক দ্রব্য এবং হেভি মেটাল ফুড চেইনে চলে আসে। সেক্ষেত্রে ইন্ডাস্ট্রির ইটিপি ব্যবহারের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা আছে এবং পরিবেশ অধিদপ্তরও অভিযান পরিচালনা করছে কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করছেন না।

শিল্পোদ্যক্তাদের দেশের স্বার্থে এটুকু দায়িত্ব পালন করতে হবে। সবচেয়ে বড় সত্য হলো ইটিপি থাকলেও অনেক সময় শিল্পপতিরা তাদের ব্যয় বেড়ে যাওয়ার আশংকায় ইটিপি চালান না। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান থাকাকালীন গাজীপুরে জেলা পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মশালা পরিচালনা করতে গিয়ে এ সত্যটি চরমভাবে উপলব্ধি করেছি। আলোচনায় এ বিষয়টা উঠে এসেছে।

হেভি মেটাল পশু ও মাছের মধ্যেও আসতে পারে, মাটি ও পানি থেকে। মাঠের ঘাস থেকে এবং ধানের শুকনা খড় থেকে গরু-ছাগলের মধ্যে এবং পানি ও মাটি থেকে মাছের মধ্যে হেভি মেটাল আসতে পারে। দেশের সব জায়গায় মাটি ও পানিতে দূষণ আছে একথা আমি বলছি না। আমি বলছি যেসব জায়গার দূষণের উৎসগুলো রয়েছে এবং উৎসস্থলের সাথে সংশ্লিষ্টরা যেখানে জেনে, বুঝে বা না জেনে না বুঝে দূষণের কারণ তৈরি করছেন সেসব জায়গার কথা, এখানে আমাদের করণীয় হলো উৎস ধ্বংস করা।

কৃষকেরা শস্য, সবজি ও ফল উৎপাদনে যাতে ক্ষতিকারক রাসায়নিক ব্যবহার না করে প্রাকৃতিক উপাদান ও জৈব সার ব্যবহার করেন সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রাণিসম্পদের ক্ষেত্রে নিরাপদ পশু খাদ্য ও পোল্ট্রি খাদ্য ব্যবহার করা, এন্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হলে নিরাপদ সময়ে মাংস ও দুধ বাজারজাত করা, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আওতাধীণ অধিদপ্তর গুলোর মাধ্যমে GAP GLP, GAQP, GHP, GMP যদি চালু করা যায় তাহলে উৎস হতে নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করা যাবে। অতঃপর সংরক্ষণ, মজুদ, সরবরাহ, বিপণন পর্যায়ের নিরাপদ রক্ষার্থে সচেতনতা, প্রশিক্ষণ সর্বোপরি আইনের প্রয়োগ জরুরি।

সিটি কর্পোরেশন গুলো নিরাপদ খাদ্য বিশেষ করে নিরাপদ সবজি, ফলমূল, মাছ-মাংস বিক্রয় করার জন্য আউটলেট খোলার  উদ্যোগ নিতে পারে। ট্যানারি বর্জ্য যাতে পশুখাদ্য ও মৎস্যখাদ্যে মিশিয়ে বিক্রি করতে না পারে সে ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পদক্ষেপ নেওয়া যায়। অনিবন্ধিত ফিডমিলগুলোতে অভিযান পরিচালনা করে ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।

হোটেল রেস্টুরেন্ট গুলো যেমন: খোলা খাবার না রাখা, পোড়া তেল ও রং ব্যবহার না করা, কাঁচা ও রান্না করা খাবার পৃথকভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা, ফ্রিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে খাবার সংরক্ষণ করা, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, নিয়ম মাফিক হাত ধোয়া, অসুস্থ কর্মচারীর মাধ্যমে খাবার তৈরি না করা সহ এসমস্ত বিষয়গুলোগুলো মনিটরিং করা ম্যানেজার ও মালিকের উপরে বর্তায়। অতঃপর সরকারি মনিটরিং ফলপ্রসূ হবে। তা না হলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিয়েও আশানুরুপ সুফল লাভ করা যায় না।

আইসিডিডিআরবি এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির যৌথ গবেষণায় মানুষের রক্তে বিশেষ করে গর্ভবতী নারীদের রক্তে লেডের উপস্থিতি ধরা পড়ে। তাদের যৌথ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর বাংলাদেশের হলুদের গুড়োয় লেড ক্রোমেটের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। লেড ক্রোমেট মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এর ফলে শারীরিক, মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে, প্রাপ্ত বয়স্কদের স্মৃতিভ্রম, মাথাব্যাথা, বিষণ্নতা, মনো-স্নায়ুবিক বৈকল্য সৃষ্টি করে, দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস করে, রক্তশূণ্যতা, উচ্চ রক্তচাপ বৃদ্ধি করে, লিভার ও কিডনি ধ্বংস করে।

গবেষণার সূত্রপাত হয় বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত হলুদে লেড ক্রোমেটের উপস্থিতি লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র হতে বাংলাদেশ হতে হলুদ আমদানি না করার ঘোষনা দেয়ার প্রেক্ষিতে। গবেষণায় হলুদে লেড ক্রোমেট পাওয়া যায় যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। উৎপাদনস্থলে যাতে লেড ক্রোমেট মিশ্রিত করা না হয় বা দেশের যে কোন স্থানের পাইকারী ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সতর্ক করে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। উৎপাদক ও ভোক্তা উভয়কে যত্নবান হতে হবে। ভেজালের আরেকটি জায়গা জর্দা, খয়ের, গুল। ল্যাব পরীক্ষায় এগুলোতে লেড, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়াম পাওয়া যাচ্ছে।  লেড, ক্রোমিয়াম ও ক্যাডমিয়ামের মত ভারি ধাতুর কারণে শ্বাসনালীর গুরুতর সমস্যা, কিডনি ও লিভার ড্যামেজসহ ক্যান্সার ইত্যাদি হতে পারে।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কর্তৃক আমি চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে মানবদেহের জন্য অন্যতম ক্ষতিকর অসংক্রামক রোগের অন্যতম উৎস ট্রান্স ফ্যাটি এসিডযুক্ত খাদ্য তালিকা এবং খাদ্যের অনুসঙ্গ সমূহ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট বা Industrially-produced trans fatty acids (ITFA) এর ব্যাপারে সতর্কতামূলক প্রচার এবং প্রযোজ্যক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট করা হয়। উচ্চমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণ হার্ট এটাকসহ হৃদরোগজনিত মৃত্যু ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। WHO এর হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ব প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ মানুষ শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাট গ্রহণের কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়।

ট্রান্স ফ্যাট বা ট্রান্স ফ্যাটি এসিডের উৎস মূলত দুইটি। প্রাকৃতিক, গবাদি পশু-প্রাণীর অন্ত্রে এটি প্রাকৃতিক ভাবে তৈরি হয়, যার ফলে গরু-ছাগলের মাংস, দুধ এবং দুগ্ধজাত খাবার যেমন, ঘি, মাখন ইত্যাদিতে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্স ফ্যাট পাওয়া যায়। কৃত্রিম, আংশিক জারিত তেল (partially Hydrogenated Oil- PHO) অর্থাৎ ভেজিটেবল অয়েল বা উদ্ভিজ্জ তেলের (পাম, সয়াবিন ইত্যাদি) সাথে হাইড্রোজেন যুক্ত (হাইড্রোজেনেশন) করলে তেল জমে যায় এবং ট্রান্স ফ্যাট উৎপন্ন হয়। এই আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেলই (PHO) শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটের প্রধান উৎস, যা ডালডা বা বনস্পতি ঘি নামেও পরিচিত। এতে ২৫-৪৫ শতাংশ পর্যন্ত ট্রান্স ফ্যাট থাকে।

খাদ্য প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো খাবার সংরক্ষণের সুবিধার্থে এবং বিভিন্ন ভাজা পোড়া ও বেকারি খাদ্য পণ্যের স্বাদ, ঘ্রাণ এবং স্থায়ীত্ব বাড়ানোর জন্য আংশিক হাইড্রোজেনেটেড তেল ব্যবহার করে থাকে। এছাড়া ভাজা পোড়া খাদ্যে একই ভোজ্য তেল উচ্চ তাপমাত্রায় বারবার ব্যবহারের কারণেও খাদ্যে ট্রান্স ফ্যাট সৃষ্টি হয়। সাধারণত খরচ কমানোর জন্য হোটেল-রেস্তোরাঁয় সিঙ্গারা, সমুচা, পুরি, জিলাপি, চিকেন ফ্রাইসহ বিভিন্ন ধরনের ভাজা পোড়া খাবার তৈরির সময় একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয়। এ কারণে এসব খাবারে ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে যায়।

শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নির্মূল ক্রমেই বিশ্বজুড়ে একটি অগ্রাধিকার হয়ে উঠছে। ট্রান্স ফ্যাট নির্মূলে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটি সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ গ্রহণের সুপারিশ করেছে, যেখানে কোনো খাবারে শিল্পোৎপাদিত ট্রান্স ফ্যাটের সর্বোচ্চ পরিমাণ মোট ফ্যাট বা তেলের ২ শতাংশ (২ম/১০০ম) পর্যন্ত সীমিত রাখা অথবা খাদ্য উপকরণ হিসেবে আংশিক হাইড্রোজেনেটেড অয়েল বা PHO এর উৎপাদন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।

আমাদের দেশে এব্যাপারে অদ্যাবধি কোন নির্দেশনা জারি করা হয়নি।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্দ্যোগে খুব সহসা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলে মানুষের মধ্যে উপলব্ধি আসতে পারে। অন্যথায় স্ব উদ্যোগে কেউ ব্যবস্থা নেওয়ার আশা করা অমূলক। ভেজালমুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা প্রদান করা কারো একক দায়িত্বের মধ্যে বর্তায় না। খাদ্য শৃঙ্খলের সাথে জড়িত প্রত্যেক স্টেকহোল্ডারের ভূমিকা এতে রয়েছে। এর জন্য প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধা, সচেতনতা ও সততা। প্রত্যেকে নাগরিক যদি সততার সাথে নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে এবং আইন মেনে চলে শুধু খাদ্যে নয় অন্য কোনক্ষেত্রেও ভেজাল এর অস্তিত্ব থাকতে পারে না।

লেখক: সৈয়দা সারওয়ার জাহান চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) বাংলাদেশ রাবার বোর্ড

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট