চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

বাংলাদেশ ক্রিকেটের মরু-বিপর্যয় ও গণ-আদালত

অঘোর মণ্ডল

৫ নভেম্বর, ২০২১ | ১০:০০ অপরাহ্ণ

ক্রিকেট ইতিহাস সব প্রশ্নের উত্তর দ্রুত দাবি করে না। কারণ, ইতিহাস সময়কে বুকে নিয়েই এগিয়ে চলে। কিন্তু বাঙালি উত্তরটা দ্রুত দিতে চায়। দিয়ে ফেলে। এবং খুব দ্রুত। সেটা ক্রিকেটার থেকে ক্রিকেট কর্তা। ক্রিকেট কর্তা থেকে আমজনতা। ক্রিকেট প্রেস থেকে ক্রিকেট বোদ্ধা। সবাই শুরু থেকেই ‘পাওয়ার প্লে’ শুরু করেন। ‘স্লগ ওভার’ বলে দুটো শব্দ আছে, সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতে রাজি নই আমরা কেউ! এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও তার ব্যতিক্রম কিছু না। নিট ফলাফল—বাংলাদেশ ক্রিকেটের স্কোরকার্ডে শূন্য!

হ্যাঁ, শূন্য। কারণ, বাছাইপর্ব দল উতরে গেছে টেনেটুনে। কিন্তু মূল পর্ব বা সুপার টুয়েলভে একটা ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত একটা ম্যাচই জিতেছে। ২০০৭ সালে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। জোহানেসবার্গের ওয়ার্ন্ডারাসে সেই জয়ের নায়ক ছিলেন মোহাম্মদ আশরাফুল। ২৭ বলে ৬১ রানের বিস্ফোরক এক ইনিংস খেলেছিলেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার। তিনিই আবার বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে ঢুকিয়ে দিয়েছেন অনুজ্জ্বল এক হিসাব। ম্যাচ ‘ফিক্সিং’। কিন্তু ম্যাচ ফিক্সিংয়ে বাংলাদেশে তিনিই প্রথম এবং একমাত্র আদম কি না, সেই প্রশ্নের উত্তর আগামীর ইতিহাস বলবে।

তবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ইতিহাসে তার চেয়ে ভালো ইনিংস খেলে ম্যাচ জিতিয়েছেন বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটার, স্কোরকার্ড সেই সাক্ষী দেয় না। তাই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের দায়ে দণ্ডিত মোহাম্মদ আশরাফুলের কাছে ক্রিকেট ইতিহাস একদিন প্রশ্ন করবেই, ‘আশরাফুল, আপনি কি কমিশনের কাছে, মিডিয়ার কাছে সব সত্যি কথা বলেছিলেন? যদি বলে থাকেন, তাহলে আমজনতা কেন জানতে পারল না, কে, কারা আপনাকে ফিক্সিংয়ের ওই অন্ধকার গলি চিনিয়েছিলেন? বা কাদের হাত ধরে আপনি সেই অন্ধকার সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে পড়েছিলেন? আর যদি আপনি নিজে ঢুকে পড়েন, তাহলে মোহাম্মদ আশরাফুল নামটা বাংলাদেশ ক্রিকেটে ’জীবন্ত এক শবদেহ’! আপনার ক্রিকেটীয় সত্তা পচে-গলে নষ্ট হয়ে গেছে। সেখানে ওপরে লেখা আপনার ইনিংসের কথাগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেটের মৃত পুত্রের জন্য শোকগাথা হিসেবে উৎসর্গ করা থাকল পাঠকদের কাছে।’

বাছাইপর্বে স্কটল্যান্ডের কাছে হারের পর লিখেছিলাম: ‘শোকদগ্ধ দলের পক্ষে ঘুরে দাঁড়ানো কঠিন।’ কেন কঠিন, তার একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলাম। বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নিয়েছে। কিন্তু কেউ কি দাবি করবেন, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে! ক্রিকেটারদের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর লোকের অভাব হচ্ছে না এ দেশে! মুণ্ডুপাত হচ্ছে ক্রিকেটারদের। বাদ পড়ছেন না তাদের পরিবারের সদস্যরাও। বাদ যাচ্ছে না জাত-পাতও! করা হচ্ছে নানা ‘অপমানজনক’ মন্তব্য! করছেন কারা? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, গণমাধ্যমে সক্রিয় দর্শক, বিশ্লেষক, ক্রিকেটার, বোর্ড কর্তা, বোর্ড কর্মচারী সবাই।

দর্শক, বাংলাদেশ ক্রিকেটের অংশীজন। আবেগতাড়িত হয়ে অনেক কিছু বলতে পারেন। লিখতে পারেন। সাবেক ক্রিকেটার, তারা খেলাটা ভালোবেসে খেলেছেন। এ দেশের ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে তারা ভূমিকা রেখেছেন। সাংবাদিক, তারা পেশাগত কাজই করছেন। কিন্তু বোর্ডের চুক্তিবদ্ধ ক্রিকেটাররা কীভাবে দলের সমালোচনা করছেন! বোর্ডের পরিচালক, যারা দেশজ ক্রিকেটের অভিভাবকত্ব করছেন, তারা গণমাধ্যমে কীভাবে কথা বলছেন? যারা বিসিবির চাকরি করছেন, তারা গণমাধ্যমে দিনের পর দিন ক্রিকেট দলের সমালোচনা করছেন! ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিতে দেরি করেননি দলের এক সিনিয়র ক্রিকেটার এবং এক সাবেক অধিনায়ক। তিনি বলেছেন: আয়নায় নিজেদের মুখ দেখতে! এ দেশের মানুষ ক্রিকেটটাকে ভালোবাসে হৃদয়ের সমস্ত আবেগ দিয়ে। দলের খারাপ পারফরম্যান্স দেখে তাদের হতাশাকে চৈত্রের শিমুল তুলার মতো হাওয়ায় ভাসিয়ে দিতে পারেন না!

বায়োস্কোপের আয়নাবাজি তাদের অতটা টানে না যতটা টানে ক্রিকেট। তাদের ভেতরও একধরনের যন্ত্রণা-ক্ষোভ-রাগ-হতাশা কাজ করছে। তাই তাদের মুখবইয়ের স্ট্যাটাস দেখে-পড়ে-শুনে মনে হয় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ক্রিকেটারদের পারফরম্যান্স বিচারের জন্য ‘গণ-আদালত’ বসেছে!

তবে ক্রিকেটারদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের আগে আরও তদন্ত দরকার। অধিকতর তদন্ত। আর তা করলে, আরও কিছু বিষয় বেরিয়ে আসতে পারে। তদন্ত হওয়া দরকার। অনেক ওজনদার নামসহ বাড়তি চার্জশিট তৈরি করতে হতে পারে। ২০০৭ সালে প্রথম বিশ্বকাপের পর এতগুলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলল বাংলাদেশ। কিন্তু মূল পূর্বে একটি ম্যাচও জিততে পারল না কেন? গত চৌদ্দ বছরে নিজের মাঠেও টি-টিয়োন্টি বিশ্বকাপ খেলেছে বাংলাদেশ।

প্রতিবার বলা হয়েছে টি-টোয়েন্টিতে আমরা এখনো অত ভালো দল নই! ভুল থেকে আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। এই ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ দল হয় বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, না হয় সব থেকে বাজে শিক্ষার্থী। অথবা তাদের অভিভাবকদের কোনো মনোযোগই নেই ক্রিকেটারদের প্রতি। এই যুক্তিগুলো অবশ্য সন্দেহপ্রবণ তার্কিকদের যুক্তিতে নিমেষে উড়ে যাবে। বাংলাদেশ যদি ভালো দল না হয় তাহলে প্রথম বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারাল কীভাবে? ওই দলের দু-একজন ক্রিকেটার তো এবারও দলে ছিলেন!

ঘরের মাঠে বাজে উইকেট বানিয়ে অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে হারানোর স্থপতি যারা, তারা কি বিশ্বকাপের কথা ভেবেছিলেন? নাকি নির্বাচনের আগে এ রকম দুটো সিরিজ জয় তাদের দরকার ছিল? তাই কিউরেটরকে সে রকম প্রেসক্রিপশন দিয়ে উইকেট বানিয়েছিলেন? অজিদের অবস্থা দেখে যেখানে খেলার জন্য মূল দলই পাঠাল না নিউজিল্যান্ড! কেউ কি জিজ্ঞেস করেছেন কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার দেওয়া বিদেশি কিউরেটরকে, এমন উইকেট হলো কেন? যাকে পাড়ার ক্রিকেটেও স্পোর্টিং উইকেট বলতে লজ্জা পাবেন স্কুলছাত্ররা পর্যন্ত! ঘরোয়া ক্রিকেটের নামে কোন উইকেটে কী খেলা হচ্ছে, তার কোনো প্রতিবেদন কি আছে?

ক্রিকেট বোর্ডের নয়শ কোটি টাকা ফিক্সড ডিফোজিট আছে। এটা বোর্ডের সম্পদ। এটা গর্ব করে বলার কিছু নেই। ক্রিকেটিং নেশনের সবচেয়ে বড় অ্যাসেট তার ক্রিকেটাররা। সেই ক্রিকেটার তুলে আনার জন্য কি পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে? যদি সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হতো তাহলে সাকিব-মুশফিক-মাহমুদউল্লাহদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো না। হয়তো ৯০০ কোটি টাকা ব্যবহার করা হতো আগামী দিনের ৯০০ ক্রিকেটার তুলে আনার জন্য। যারা একজন আরেকজনের কাঁধে গরম নিশ্বাস ফেলতেন জাতীয় দলে একটা জায়গা পাওয়ার জন্য। দলে জায়গা পাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্রতর হতো।

বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে পঁচিশজন পরিচালক আছেন। যারা দেশে বিভিন্ন অঞ্চল এবং ক্লাবের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তারা কি বলতে পারেন, কোন অঞ্চলের কতজন ক্রিকেটার বিভিন্ন স্তরে খেলেছেন। বিসিবির সিইওর টেবিলের কাচের নিচে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন স্তরের খেলা ক্রিকেটারদের সেই সংখ্যাভিত্তিক গ্রাফটাই থাকার কথা আছে? যত দূর দেখেছি নেই?

বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড, বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে সেই ক্যাটাগরি থেকে যিনি বা যারা এত দিন পরিচালক হয়েছেন, তারা ভোট প্রার্থনা ছাড়া আন্তবিশ্ববিদ্যালয়, আন্তবোর্ড কোনো টুর্নামেন্ট আয়োজনের চিন্তা করেছেন? করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এ রকম একটা মর্যাদাপূর্ণ নির্বাচনে কোনো কাউন্সিলরের নামও পাঠাল না কেন! এটা প্রমাণ করে তারা জেনে গেছেন ক্রিকেট নিয়ে নিজেদের মতামত পেশ করার মতো অবস্থা নেই। আসলে খেলাটা ঠিকঠাক পরিচালনা, ক্রিকেটারদের যোগ্য মর্যাদা, শুধু পারিশ্রমিক বাড়িয়ে দেওয়া যায় না, বা ক্রিকেটীয় পরিকাঠামো উন্নয়ন মানে লক্ষাধিক দর্শক ধারণক্ষমতার স্টেডিয়াম নির্মাণের পরিকল্পনা করা নয়। সারা দেশের ক্রিকেটকে নিয়ে ভাবা।

পাশাপাশি আরেকটা র্স্পশকাতর বিষয় চলে আসে। বাংলাদেশ দল একটা ম্যাচ জিতলেই দেশের এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা যেভাবে অভিনন্দনের বন্যায় ভাসান ক্রিকেটারাদের, তাতে ভাসতে ভাসতে তারা ক্লান্ত। কেউ রান খরায় ভুগছেন। কেউ উইকেট খরায়। আর যারা জয়ের কৃতিত্ব ক্রিকেটারদের চেয়ে বেশি নিতে চান, তারা বাংলাদেশ ক্রিকেটের এই ‘মরু-বিপর্যয়ে’ উট পাখির মতো বালুতে মুখ গুঁজে বাঁচতে চাইছেন। সুযোগ বুঝে ‘বলির পাঁঠা’ বানানো হবে অধিনায়কসহ কয়েকজন ক্রিকেটরারকে। টিম ম্যানেজমেন্টের দায়টা যাতে চাপা পড়ে যায়!

পেশাদার ক্রিকেটাররা জান বির্সজন দিতেও রাজি থাকেন। কিন্তু নিজেদের পেশাদার সম্ভ্রমটুকু নয়। কিন্তু বোর্ড কতটুকু পেশাদারত্বের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে বিশ্বকাপ শেষে, কিন্তু সেই প্রশ্নটাও উঁকি দিচ্ছে। পেশাদার বোর্ডের পরিচালক, কর্মকর্তারা বিশ্বকাপ চলার সময় রোজ গণমাধ্যমে এসে কথা বলতে পারেন না! কিন্তু বলছেন। আর তাতেই ফুটে ওঠে, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে ’স্বার্থ-সংঘাত’ বলে কিছু নেই। কিন্তু অন্তর্ঘাত আছে।
সেটা আবার কী! টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে কিছু টক শোর খণ্ড খণ্ড চিত্র নিয়ে একটা কোলাজ করুন, বুঝতে সহজ হবে। তথ্যসূত্রঃ সংবাদপ্রকাশ।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট