চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

প্রাণের ভাষায় মনের কথা

স্মৃতিতে প্রেসিডেন্ট এরশাদ

হৃদয় হাসান বাবু

১৫ জুলাই, ২০১৯ | ১:১৬ পূর্বাহ্ণ

১৯৮৫ খ্রিস্টাব্দ, আমি তখন ঐতিহ্যবাহী চট্টগ্রামস্থ নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বালক বিদ্যালয়ের ছাত্র। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও সশস্ত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ চট্টগ্রাম সফরে আসবেন বলে পূর্বদিন বিভিন্ন পত্রিকায় খবরে প্রকাশ। মাননীয় প্রেসিডেন্ট যেদিকেই যান সেখানেই নিরাপত্তার চাদরে মুড়িয়ে ফেলা হয়। তাঁর নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে। প্রথম ঘণ্টার ক্লাস করে একজন সহপাঠিকে নিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলাম। আমরা স্কুলের গেটের ভেতর দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, কখন মহামান্য রাষ্ট্রপতি আসবেন।
আমাদের প্রিয় নাসিরাবাদ স্কুলটি চট্টগ্রামের অভিজাত এলাকা জিইসি মোড় ও ষোল শহর ২ নং গেইট এর মাঝামাঝি এশিয়ান হাইওয়ে রোডের সীমানা ঘেষেই অবস্থিত। স্কুল গেইট থেকে পা বাড়ালেই বিশ্ব রোড। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি যাবেন, তাই পথে পথে বিভিন্ন বাহিনীর কয়েক স্তরের নিরাপত্তা চাদরে ঘিরে ফেলা হয়েছে। রাস্তার সব গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। স্কুল গেটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ি আসছে দেখতে পেয়েই নিরাপত্তারক্ষীদের ফাঁকি দিয়ে ছোট্ট একটা দৌঁড় দিয়ে রোডে উঠে যাই এবং প্রেসিডেন্টের আগের ষ্টেনগান তাক করা আর্মিদের গাড়িটা আমাকে পাস করতেই চোখের পলকে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে প্রেসিডেন্টের গাড়ির সামনে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যাই। খুব স্পীডে চলা গাড়ির চালকের ততোধিক দক্ষতায় ঘ্যাচাঙ করে আমার হাটু বরাবর এসে থেমে পড়ে। তখন আমি প্রেসিডেন্ট সাহেবের গাড়ির সামনে এক পা রেখে হাত দিয়ে গ্লাসে বারি মারতে থাকি। ইশারা করতে থাকি মি. প্রেসিডেন্ট আপনি নেমে আসুন। আমাদের স্কুলে চলুন।
এর মধ্যেই বিশেষ নিরাপত্তায় নিয়োজিত আর্মি সদস্যরা বিভিন্ন গাড়ি থেকে নেমে প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা বিধানে তৎপর হয়। বারবার আমার অনুরোধ ও আমি নাছোড়বান্দা বুঝতে পেরে নিরুপায় হয়ে মি. প্রেসিডেন্ট আমার কথা শোনার জন্য গাড়ির গ্লাস খুলেন। তখন আর যায় কোথায়? আমি আমার ডান হাতটা গাড়ির ভিতর ঢুকিয়ে দিয়ে মি. প্রেসিডেন্টের বাম হাতের বগলের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে টানতে থাকি। তখন দরজা খুলে প্রেসিডেন্ট রাস্তায় নেমে আসেন। একদিকে প্রেসিডেন্টকে দেখার জন্য অপেক্ষারত মানুষগুলোর হল্লা বাড়ছেই অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনী তা সামাল দিতে গলদগর্ম। এই ফাঁকে আমি প্রেসিডেন্ট সাহেবকে টেনে নিয়ে প্রধান শিক্ষকের দরজায় দাঁড়াই। শিক্ষার্থীরা খবর পেয়ে ছুটে আসে আর সেকি ক্রাউড, সেই দিনটির কথা ভুলার মতো নয়। প্রেসিডেন্ট প্রেসিডেন্ট চিৎকারের স্কুল ছাদ যেন কয়েকবার উড়ে উড়ে বসে। প্রেসিডেন্ট উপস্থিত ছাত্র-শিক্ষকদের উদ্দেশে কয়েক মিনিট কথা বলেন। আমরা বিভিন্ন দাবীতে চিৎকার করতে থাকি। প্রেসিডেন্ট ছাত্রদের জন্য একটি বাস এবং ১ লক্ষ টাকা দেয়ার ঘোষণা দেন।
আমরা খুশিতে যেন আত্মহারা হয়ে পড়ি। মুহুর্মুহু শ্লোগানে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠে। কয়েক মিনিটের এই স্বপ্নময় ঘটনা আমার কাছে আজো এক অপার বিষ্ময়। স্কুলপড়–য়া ওইটুকুন একটি ছেলে দোর্দ- প্রতাপশালী একজন প্রেসিডেন্টকে এভাবেই বিনা নোটিশে কাবু করবে তা হয়তো আমি শুধু নয় নিরাপত্তায় নিয়োজিত কর্মিরাও ভাবতে পারেননি।
আবার মাঝে মাঝে যখন ওই ঘটনায় নষ্টালজিক হই ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠি। কি দুঃসাহসিক কাজটাই না করেছি সেদিন। পান থেকে চুন খসার মতো যদি মি. প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা রক্ষীর মনে বিন্দুমাত্র ধারণা জন্মাতো যে ১৩/১৪ বছরের এই বালক সুইসাইড বম্বার হতে পারে তাহলে প্রেসিডেন্টের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা রক্ষীদের নিপুণ হাতের স্টেনগানের ব্র্রাশ ফায়ারে আমার সারা শরীর ঝাঝঁরা হয়ে যেতো। আবার অন্য আরেকটি আশংকাও ছিলো, তাহলো খুব দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসা প্রেসিডেন্টের গাড়ির সামনে চোখের পলকে গিয়ে দুই হাত প্রসারিত করে দাঁড়াই, তেমনিভাবে খুব কড়া ব্রেক কষে দক্ষ ড্রাইভার যদি দক্ষতার সাথে গাড়ি না থামাতেন তাহলে হয়তো গাড়ির চাকার নীচে আমার সলিল সমাধি হতো। এখনো এই আশংকাগুলো আমায় তাড়িত করে। তারপরেও আমার একক নেতৃত্বেই সেদিন প্রেসিডেন্ট এরশাদ প্রিয় নাসিরাবাদ স্কুলে প্রবেশ করেছিলেন। যা আজো আমাকে পুলকিত করে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট