চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

যে শহর জলে ভাসে, মানুষ হারিয়ে যায় ভূতলে

মাহফুজ পারভেজ

২ অক্টোবর, ২০২১ | ৯:৩০ অপরাহ্ণ

বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রাম আর স্বাভাবিক থাকে না। জলাবদ্ধতা পুরো নগরকে বিপজ্জনক ভূগোলে পরিণত করে। শহর ভাসে জলে। তখন চরম দুর্ভোগের পাশাপাশি নালা-নর্দমায় পতিত হয় অনেক মানুষ। এমনকি, অনেকেই ভূতলে হারিয়েও যায়। যাদের কোনও খোঁজ পর্যন্ত পাওয়া যায় না।

সাধারণত প্রতিদিন হেঁটে কিংবা যানবাহনে কর্মস্থলে যান মানুষ। কিন্তু বৃষ্টি হলে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। অনেকে তখন মন্তব্য করেন, ‘সাগর পেরিয়ে কাজে আসলাম’! সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আরও মারাত্মক নাগরিক মন্তব্য তখন দেখা যায়।

অল্প বৃষ্টিতেই চট্টগ্রাম শহরের মুরাদপুর থেকে নাসিরাবাদ পর্যন্ত পুরো রাস্তাই জলমগ্ন হয়। থৈ থৈ পানিতে রাস্তা আর ড্রেন একাকার হয়ে যায়। তারমধ্যেই কায়ক্লেশে কাজে যান লোকজন।

একপশলা বৃষ্টি হলেই চট্টগ্রামের ভূগোল বদলে যায়। পুরো শহরই রূপ নেয় সাগরে। কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট, যেমন মুরাদপুর, নাসিরাবাদ, জিইসি, ওয়াশা, বহদ্দারহাট কোমর পানির নিচে তলিয়ে যায়। পাহাড়-ঘেরা শহরকে তখন মনে হয় জলবেষ্টিত দ্বীপ। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদ, সিডিএ, হালিশহরের পরিস্থিতি আরও নাজুক আকার ধারণ করে বৃষ্টিতে। সেখানে ঘরবাড়িতে পানি ঢুকে যায়। কোথাও কোথাও সাঁতার কাটার অবস্থা তৈরি হয়। ভয়াবহ জলাবদ্ধতা চট্টগ্রামে শুধু নাগরিক বিপদই বাড়ায় না, প্রাণঘাতী পরিস্থিতি তৈরি করে। সড়ক আর পার্শ্ববর্তী ড্রেন একাকার হয়ে যাওয়ায় মানুষে চিনতে পারে না কোনটি রাস্তা আর কোনটি নালা। তখন ঘটে মারাত্মক বিপর্যয়।

সাম্প্রতিক সময়ে হাঁটতে হাঁটতে জলমগ্ন ড্রেনে চলে গিয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। নিমেষে তলিয়ে যান তিনি। তার লাশও পাওয়া যায় নি। কিছুদিন আগেও জলমগ্ন নাসিরাবাদ ২নং রেলগেটের পাশে অতল ড্রেনে পড়ে যায় এক চলন্ত সিএনজি আর তাতে মৃত্যু ঘটে দুজন আরোহীর। বহু রিকশার চালক রাস্তা আর ড্রেনের পার্থক্য বুঝতে পারেন না জলের কারণে। চলতে চলতে একটু অসতর্ক হলেই বৃষ্টির পানিবাহিত ড্রেনের তীব্র স্রোতে ভেসে যান অনেক মানুষ, ভেসে যায় যানবাহন। অনেকেই আহত হয়ে রক্ষা পেলেও মারা যান অনেকেই। তাদের লাশও পাওয়া যায় না। বৃষ্টি আর বিভীষিকা চট্টগ্রামে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায় প্রায়ই। বিশেষত, বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের অধিকাংশ এলাকাই চলে যায় জলের তলায়। এক-দুই ঘণ্টার বৃষ্টিতেই ভেসে যায় নগরের প্রধান প্রধান সড়ক ও অভিজাত এলাকা। দুর্যোগের সঙ্গে এসে যুক্ত হয় প্রাণ হারানোর বিপদ।

গত ২৫শে আগস্ট চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুর এলাকায় নালায় পানিতে পড়ে তলিয়ে যান সালেহ আহমদ নামে এক দোকানি। একমাসেও তার কোন হদিস মেলেনি। ঠিক এক মাস ব্যবধানে নগরীতে আবার নালায় পড়ে সেহরিন মাহবুব সাদিয়া (২০) নামে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী নিখোঁজ হন। তবে এবার প্রায় ৫ ঘণ্টা পর তল্লাশি শেষে নালা থেকে ওই শিক্ষার্থীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সেই উদ্ধারের বিবরণ ছিল ভয়াবহ। তাতে জানা যায়, আগ্রাবাদের বাদামতলী মোড়ে রাত ১০টার দিকে হাঁটতে গিয়ে নালায় পড়ে যান ওই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী। এরপর ব্যাপক তল্লাশি শেষে রাত ৩টা ১০ মিনিটে ওই ছাত্রীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ঘটনাস্থলে যাওয়া ফায়ার সার্ভিসের চট্টগ্রামের সহকারী পরিচালক ফারুক হোসেন সিকদার মিডিয়াকে জানান, ফুটপাত ঘেঁষে সড়কে যেখানে দুর্ঘটনা ঘটেছে, এর নিচে বড় নালা। কিন্তু নালার ওপর কোনো স্ল্যাব ছিল না। চলমান এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ কাজের কারণে ওই সড়কে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে পানি জমে নালার আকার ধারণ করেছে। স্ল্যাব না থাকায় বোঝার কোনো উপায় নেই যে, নালা নাকি গর্ত। সড়কেই প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত নালা কোনো ধরনের স্ল্যাব ছাড়া আছে।

সড়কের নিচে একটা নালা, প্রায় ১০ ফুট প্রশস্ত। আবার এর ভেতরে আরেকটা নালা পাওয়া যায়, সেটাও ৮ থেকে ১০ ফুট প্রশস্ত। সম্ভবত ৫০-৬০ বছর আগে সড়ক উঁচু করার সময় অপরিকল্পিতভাবে সেই নালা রেখেই আরেকটি নালা করা হয়। আগের সেই নালা ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ। কমপক্ষে সেখানে তিন টন আবর্জনা জমে আছে। অনেক চেষ্টা করেও ডুবুরি সেখানে যেতে পারেনি। সেটা আবার টার্ন নিয়েছে কর্ণফুলী নদীর দিকে দক্ষিণে। এরপর দুই ক্রেন মিলে সেই নালার স্ল্যাব উঠিয়ে এক টনের মতো আবর্জনা-মাটি অপসারণ করা হয়। তখন আগের সেই নালার মধ্যে, কমপক্ষে সড়ক থেকে ৭০ ফুট গভীরে হবে, সেখানে আবর্জনায় আটকে আছে। সব মিলিয়ে প্রায় চার ঘণ্টা চেষ্টার পর লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়।

এর আগে, গত ২৫ আগস্ট বৃষ্টির মধ্যে নগরীর মুরাদপুরে নালায় পড়ে নিখোঁজ হন সালেহ আহমদ নামে এক সবজি বিক্রেতা। গত এক মাসেও তার হদিস মেলেনি। মুঘল-পূর্ব আমল থেকেই চট্টগ্রাম নগরের পত্তন হয়েছে। উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন এই নগরী ১৮৬৩ সালের ২২শে জুন মিউনিসিপ্যালিটি রূপে যাত্রা শুরু করে। প্রশাসন ও কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৮ জন কমিশনার সমন্বয়ে পরিষদ গঠিত হয়। ঐ সময়ে চট্টগ্রাম শহরের সাড়ে চার বর্গমাইল এলাকা মিউনিসিপ্যালিটির আওতাধীন ছিল। প্রথমে ৪টি ওয়ার্ড থাকলেও ১৯১১ সালে ৫টি ওয়ার্ড সৃষ্টি করা হয়। চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৮২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর সিটি কর্পোরেশনে রূপান্তরিত হয়। বর্তমানে ওয়ার্ড সংখ্যা ৪১টি। চট্টগ্রাম শহর এলাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন-এর অধীনস্থ।

প্রাচীন গ্রিক ও মিসরীয় ভৌগোলিকদের বর্ণনায় চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের কিছু কিছু উল্লেখ পাওয়া যায়। খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের গ্রিক ভৌগোলিক প্লিনির লিখিত ‘পেরিপ্লাসে’ ক্রিস’ বলে যে স্থানটির বর্ণনা আছে খ্যাতনামা ঐতিহাসিক স্যার ড. নলিনীকান্ত ভট্টশালীর মতে তা সন্দ্বীপে সঙ্গে অভিন্ন। ল্যাসেনের মতে, পেন্টাপোলিস চট্টগ্রামেরই ক্লাসিক্যাল নাম। আরব ভৌগোলিকদের বিবরণে ‘সমন্দর’ বলে যে বন্দরটির উল্লেখ আছে তা চট্টগ্রাম। সমন্দর বন্দরটি পালবংশীয় দিগ্বিজয়ী রাজা ধর্মপালের অধীনে ছিল।

এ থেকে মনে হয়, ধর্মপালের রাজ্যের বিস্তৃতি চট্টগ্রাম পর্যন্ত ঘটেছিল। প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের কয়েকটি শিলালিপি চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশে আবিষ্কৃত হওয়ায় পণ্ডিতরা মনে করেন, চট্টগ্রাম জেলার উত্তরাংশ প্রাচীন হরিকেল রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। চট্টগ্রামের পুরাকীর্তির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় মোগল ঐতিহাসিক শিহাব উদ্দীনের তালিশের বিবরণে তিনি চট্টগ্রামের দুর্গ এবং দুর্গের আঙিনায় পীর বদরের আস্তানার কথা উল্লেখ করেন। তালিশের সূত্রে আরও জানা যায় যে, ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ চট্টগ্রাম জয় করে চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত একটি বাঁধ নির্মাণ করেছিলেন। এই সুলতানের রাজত্বকালে চট্টগ্রামে নির্মিত মসজিদ এবং সমাধিসৌধ সম্পর্কেও তালিশে উল্লেখ আছে। তিনি এখানে কিছু পুরাকীর্তির খোঁজ পান।

মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্যের শহর চট্টগ্রামের বর্ণনায় পুরাকীর্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। আনুমানিক ১৬০০-১৬০৭ খ্রিস্টাব্দে রচিত দৌলত উজির বাহরাম খানের লায়লী-মজনু কাব্যে এই বিবরণ রয়েছে। তা থেকে জানা যায় যে, এ সময়ের মনোরম চট্টগ্রাম নগরে অনেক সাধু-সজ্জনের নিবাস ছিল। উঁচু-উঁচু পর্বতে দুর্গের সীমানার মধ্যে ‘বদর আলম’-এর সমাধিসৌধের উপস্থিতির বিষয়টিও কবির নজর এড়ায়নি। শত শত বছরে চট্টগ্রামের অবয়ব ও পরিধি বৃদ্ধি পেয়েছে।

‘বন্দর নগরী’, ‘বাণিজ্য নগরী’ ইত্যাদি বহু উপমা ও উপাধি পেয়েছে চট্টগ্রাম। পাশাপাশি পাহাড়-কর্তন ও পরিবেশ হানির মারাত্মক প্রকোপ বেড়েই চলেছে চট্টগ্রামে। যার ফলে তীব্র জলাবদ্ধতা ও নানা প্রাকৃতিক বিপদ নাগরিক সমাজকে নিত্য বিপর্যস্ত করছে। এমনকি, সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী নগরে সৃষ্টি হয়েছে নানা মৃত্যুকূপের। চট্টগ্রাম নামের পাহাড়-সমুদ্রঘেরা নান্দনিক শহর এখন অল্প বৃষ্টিতেই জলে ভাসে। মানুষ হারিয়ে যায় ভূতলে। জীবন ও বসবাস সেখানে বিপদ সঙ্কুলতার সম্মুখীন। এর অবসান কবে হবে?

লেখক: মাহফুজ পারভেজ কবি ও কথাশিল্পী

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট