চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

চট্টলদরদী ইউসুফ চৌধুরী এবং আধুনিক চট্টগ্রামের স্বপ্ন

রতন কুমার তুরী

২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১১:৩৬ অপরাহ্ণ

উত্তর চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ঐতিহ্যবাহি হাজীবাড়িতে ১৯২২ সালে জন্মগ্রহণ করেন আধুনিক চট্টগ্রামের স্বপ্নদ্রষ্টা আলহাজ মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী। তিনি ১৯৪৩ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে চট্টগ্রাম শহরে বইয়ের ব্যবসায় নেমে পড়েন। খুব সম্ভব বই বিপণনের মতো একটি সৃজনশীল ব্যবসা বেছে নেয়ার পেছনে তাঁর সৃজনশীল মনমানসিকতায় কাজ করেছিল। সে সময় মূলত কেউ বইয়ের ব্যবসা করে উন্নতির একেবারে শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছাতে পেরেছেন, সে-ধরনের নজির খুব একটা ছিলনা বললেই চলে।

একমাত্র জনাব ইউসুফ চৌধুরীর দৃঢ় মনোবল, পরিশ্রম এবং একনিষ্ঠতাই তাকে শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। ১৯৫৪ সালে তিনি তাঁর বিখ্যাত সিগনেট প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। সেই সময় থেকেই তিনি পেঙ্গুইন এবং পেলিকান প্রকাশিত পেপার ব্যাক বিভিন্ন বিদেশি বইপত্র আমদানি শুরু করেন। প্রকৃতপক্ষে সিগনেট প্রেসটি সেসময় দেশের মুদ্রণশিল্পে যে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল তা সত্যিই বিরল ঘটনা। এই প্রেসটির হাত ধরেই পরবর্তীতে আজকের পাঠকপ্রিয় ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ পত্রিকাটির উত্থান।

বলতে গেলে এই পত্রিকাটির আত্মাপ্রকাশের শুরু থেকেই চট্টগ্রামের মানুষদের মন জয় করে নিয়েছিল। সরাসরি তাঁর তত্ত্বাবধানে পত্রিকাটি একেবারে প্রথম থেকেই মানুষের কাছে অত্যন্ত বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ করে আসছে, যা এখনও অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে এই পাঠকপ্রিয় পত্রিকাটি তিন দশকের বেশি সময় অতিবাহিত করে ৩৬ বছরে পদার্পণ করলো। এই দীর্ঘ পথচলার সমস্ত কলাকৌশল তিনি শিখিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

ইউসুফ চৌধুরী শুধু নিজের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেন নাই, তিনি অসংখ্য মানুষকে তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথ দেখিয়েছেন। প্রকৃতপক্ষে ৫০-এর দশকে পুরো চট্টগ্রাম যেখানে জঙ্গলে ভরা ছিল, ঠিক তখন ইউসুফ চৌধুরী চট্টগ্রামকে উন্নয়নের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলেন এবং তিনি কিছু স্বপ্নবাজ তরুণকে সঙ্গে নিয়ে তার কাজের গতি সঞ্চার করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে ইউসুফ চৌধুরী ছিলেন একেবারে তৃণমূল থেকে ওঠে আসা একজন সফল ব্যবসায়ী, শিল্পপতি এবং সংবাদপত্রশিল্পের অগ্রপথিক, সর্বোপরি মানবিক মানুষ। চট্টগ্রামে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তিনি কঠোর পরিশ্রমও করেছিলেন।

শ্রমসাধনা এবং নিষ্ঠা থাকলে একজন মানুষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে জনাব ইউসুফ চৌধুরী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। চট্টগ্রাম শহরের সমবায় সমিতির সামনে মাসিক ১৮ টাকায় ছনের ঘর ভাড়া নিয়ে ২০০০ টাকা পুঁজি দিয়ে একটি ছোট্ট দোকান দিয়ে তাঁর ব্যবসা জীবন শুরু করেছিলেন তিনি। পর্যায়ক্রমে তিনি বিভিন্ন দেশি বিদেশি বই বিক্রির মাধ্যমে চট্টগ্রাম শহরে পরিচিতি অর্জন করেন।

১৯৬৭ সালে তিনি প্যাকেজিং ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন এবং ১৯৬৯ সালে ৪ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে মেশিনারি আমদানি করে বুক সোসাইটি ভবন ভাড়া নিয়ে প্রেস ও প্যাকেজিং ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৪ সালে ১ কোটি টাকা বিনিয়োগে বিসিক শিল্পনগরীতে সিগনেট বক্স ইন্ডাস্ট্রিজ স্থাপন করেন এবং ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রামের মানুষের পরম পাওয়া ‘দৈনিক পূর্বকোণ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মূলত ইউসুফ চৌধুরীর জীবনে ব্যর্থতার কোনো গল্প নেই। তিনি যা-ই  চিন্তা করেছেন তা বাস্তবায়ন করেছেন, তার মেধা এবং বুদ্ধি দিয়ে। তিনি বেশ নিয়ম নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি জানতেন কোনো কাজ কীভাবে করলে সফলতা আসবে। আর সেই পথেই হাঁটতেন তিনি।

ইউসুফ চৌধুরীর সফলতার মূলমন্ত্রই হচ্ছে পরিশ্রম এবং নিষ্ঠা। আজীবন তিনি সততায় বিশ্বাসী ছিলেন। কোনো মানুষকে ঠকিয়ে তিনি কখনও বড় হতে চাননি আর তাই তিনি রাতদিন পরিশ্রম করতেন। কর্মকৌশল নির্ধারণে ইউসুফ চৌধুরী বেশ পারদর্শী ছিলেন এবং তার প্রতিটি পদক্ষেপে ছিল প্রাজ্ঞতার ছোঁয়া। দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকাটি প্রতিষ্ঠা করেই তিনি এর সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছিলেন দেশখ্যাত বরেণ্য সাংবাদিক জনাব কে জি মোস্তফা সাহেবকে। পূর্বকোণ পত্রিকার মালিক হয়েও জীবদ্দশায় তিনি কখনও পূর্বকোণে নাক গলাননি। পত্রিকাটি চলেছে সাংবাদিকদের স্বাধীনতায়। নিয়মিতই তিনি পত্রিকা অফিসসহ তার বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে বসতেন। তিনি মুদ্রণ ও সংবাদপত্রশিল্পের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও জোড়ালো ভূমিকা পালন করেছিলেন।

তাছাড়া চট্টগ্রামে মৎস্যখাতের উন্নয়নেও তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণে জেলাপ্রসাশনকে সহযোগিতা করেছিলেন। জনাব ইউসুফ চৌধুরী বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাথে সরাসরি জড়িত থেকে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত চেষ্টা করে গেছেন মানুষের সেবা করতে। তাঁর প্রচেষ্টায় এবং জেলাপ্রসাশনের সহায়তায় রাউজান উপজেলায় তার নিজ বাড়ি হাজীবাড়িতে জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তৈরি করেন নজরুল স্মৃতি ফলক। উল্লেখ্য, নজরুল তৃতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম আসলে তিনি রাউজানে ইউসুফ চৌধুরীর হাজী বাড়ীতে যান এবং কয়েকটা দিন কাটান। রাউজান উপজেলার জলিলনগর বাসস্ট্যান্ড থেকে রাউজান তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের সাথে লাগানো রাস্তার পাশেই এখনও সেই নজরুল স্মৃতি ফলকটি রাউজানবাসীর গর্বের স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

প্রকৃতপক্ষে ৪০-এর দশকে সামান্য মূলধন নিয়ে বইয়ের ব্যবসা শুরুর মাধ্যমে জনাব ইউসুফ চৌধুরী যে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিষ্ঠা করে গিয়েছিলেন তা আজ বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে। তিনি মূলত শিক্ষার প্রতি অনুরাগ থেকেই জীবনের প্রথমেই বইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিলেন। শিক্ষার প্রতি এই অনুরাগ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তার মধ্যে বিদ্যমান ছিল। তিনি মুদ্রণশিল্পসহ, ওষুধশিল্প, দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত শিল্প আরো বেশকিছু শিল্প গড়ে তুলেছিলেন। এসব শিল্প গড়ে তুলতে তিনি যে মেধা এবং শ্রম দিয়েছেন তা সত্যিই বিরল। তিনি মূলত স্বপ্ন দেখতেন একটি আধুনিক চট্টগ্রামের, যে চট্টগ্রাম কোনো জেলার ওপর কোনো কিছুর জন্য নির্ভর করবে না। যে চট্টগ্রামে থাকবে সব আধুনিক সুযোগ সুবিধা।

আজ জনাব ইউসুফ চৌধুরী বেঁচে না থাকলেও তার আধুনিক চট্টগ্রামের স্বপ্ন প্রায় পূরণ হয়েছে। চট্টগ্রামে আজ অনেক শিল্প কারখানা গড়ে ওঠেছে। চট্টগ্রামের মানুষ আজ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে চট্টগ্রামেই চাকরি করছে এবং শিল্প কারখানার জন্য অনেক উদ্যেক্তা হয়েছে, যা সেসময় ছিল দুঃস্বপ্ন। এই পথ কিন্তু দেখিয়ে গেছেন জনাব ইউসুফ চৌধুরী। প্রকৃতপক্ষে ৫০-এর দশক থেকে চট্টগ্রামের ইতিহাস লিখতে গেলে চট্টগ্রামে তথা জাতীয় অর্থনীতিতে জনাব ইউসুফ চৌধুরীর অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই, বিশেষ করে মুদ্রণশিল্পে এবং দৈনিক পূর্বকোণ পত্রিকায় চট্টগ্রামে বিশাল জনপ্রিয়তার জন্য। সময় এসেছে এই কর্মবীরকে জাতীয় স্বীকৃতি দেয়ার।

লেখক: রতন কুমার তুরী কলেজশিক্ষক, প্রাবন্ধিক

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট