চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

উপজেলা হাসপাতালগুলোতে জনবল সংকটে সৃষ্ট সমস্যা

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১ সেপ্টেম্বর, ২০২১ | ১১:৪৩ অপরাহ্ণ

ভাদ্রের দ্বিতীয় সপ্তাহ। ১৪২৮ বঙ্গাব্দ। গেলো বারে উপজেলাসমূহে জনবল সংকটের বির্পযস্ত চিত্র সম্মানিত পাঠকবৃন্দের সম্মুখে হাজির করেছিলাম। এবারে আলোচনা হবে উপজেলায় জনবল সংকটে সৃষ্ট সমস্যাদি নিয়ে। এ সংকট কিভাবে সমগ্র স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আক্রান্ত করছে সে ব্যাপারেও আলোকপাত করা হবে।

১) চিকিৎসকদের উপর চাপ সৃষ্টি হওয়া: উপজেলা হাসপাতালসমূহে প্রতিদিন জরুরি আউটডোর ও ইনডোর মিলিয়ে গড়ে ৫০০ রোগী আসছে। সকাল নয়টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত এই বিপুলসংখ্যক রোগী দেখার জন্য তিন চারজনের বেশি চিকিৎসকের পদায়ন থাকে না। এতে চিকিৎসকদের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। রোগী প্রতি দুই থেকে আড়াই মিনিট সময় পাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এই স্বল্পসময়ের মধ্যেই রোগীর সঙ্গে কথা বলা, তার বক্তব্য শোনা এবং এর মধ্যেই প্রভিশনাল ডায়াগনোসিস করে ব্যবস্থাপত্র দিতে হয় চিকিৎসককে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে চিকিৎসকের দেখা পেলেও এসময় স্বল্পতায় রোগীরা অসন্তুষ্ট থাকে।

২) আউটডোর সেবার মান নিম্নমুখী হওয়া: মেডিকেল অফিসার রোগী দেখার সময় রোগীদের সিরিয়াল বজায় রাখার জন্য কেউ থাকে না।তা ছাড়া রোগীদের ভাইটাল উপসর্গ রেকর্ড করার জন্য সরকারিভাবে কোন সেবাকর্মী থাকে না। বিশৃংখল পরিবেশে আউটডোর সেবার মান নিম্নমুখী হয়।

৩) জরুরি রোগীরা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে: উপজেলা হাসপাতালসমূহের জরুরি বিভাগে নির্দিষ্টভাবে জরুরি মেডিকেল অফিসারের কোন পদ থাকে না। আউটডোর বা ইনডোরের দায়িত্বে যিনি থাকেন তাঁকেই জরুরি বিভাগে দৌড়াতে হয়। ফলে ডাক্তার নিয়োগ অপ্রতুল থাকায় জরুরি রোগীরা যথাযথ সেবা পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।  

৫) টিমওয়ার্কের পরিবেশের অভাবে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দিতে চিকিৎসকদের ব্যর্থতা: চিকিৎসা একটি টিমওয়ার্ক। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী ন্যূনতম প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য ৬৩ জনের একটি মেডিকেল টিম থাকতে হয়। উক্ত টিমে চিকিৎসকদের সহযোগী হিসাবে নার্স টেকনোলজিস্ট ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্তভুুক্ত থাকেন। চিকিৎসক চিকিৎসা দেবার পর ২৪ ঘণ্টা সহযোগী স্বাস্থ্যকর্মীরা নিবিড় পর্যবেক্ষণ করেন এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাদের দায়িত্বের মধ্যে থাকলে গ্রহণ করেন অথবা চিকিৎসককে অবহিত করেন। উন্নত দেশে এভাবেই চিকিৎসা প্রদান করা হয়। উপজেলা হাসপাতালসমূহে চিকিৎসক টিমওয়ার্কের সহযোগিতা না পেয়ে মানসম্পন্ন চিকিৎসা দিতে সমর্থ হচ্ছেননা।

৬) রোগের ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন অনুযায়ী করা সম্ভব হয় না: জাতীয়ভাবে ক্লিনিক্যাল প্রটোকল বা গাইডলাইন ক্ষেত্রবিশেষে থাকলেও সব রোগের ম্যানেজমেন্ট গাইডলাইন নেই এবং থাকলেও সেগুলিকে টিমওয়ার্ক হিসাবে সাজানো হয়নি। চিকিৎসাসেবা একধরনের টিমওয়ার্ক। এ টিমের প্রতিটি সদস্যের কার দায়িত্ব কতটুকু একে কতটুকু করবেন সেটা নির্ধারিত থাকতে হয়। উপজেলা হাসপাতালে দেখা যায় চিকিৎসক স্বল্পতার কারণে একই চিকিৎসককে আউটডোর রোগীর চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে ইনডোরে দৌড়াতে হচ্ছে। আবার একইভাবে সেই চিকিৎসককেই ইনডোর রোগীর চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে জরুরি বিভাগে দৌড়াতে হচ্ছে জরুরি রোগীর চিকিৎসা দেবার জন্য। সেবাকর্মে কষ্ট করতে হয় এটা আমরা সকলেই জানি। কিন্তু তিনটি বিভাগের তিন পরিস্থিতির জন্য একই জনকে দৌড়াতে হলে চিকিৎসকের চিন্তাশক্তি কিভাবে কাজ করবে? এতে রোগীরা সময় কম পাচেছন চিকিৎসক থেকে। এ পর্যায়ে রোগীর অবস্থার অবনতি হলে জনগণ সে দায় চিকিৎসকের উপরই বর্তিয়ে দেয়।

৬) রোগীদের বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়: উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে শয্যা অনুযায়ী পর্যাপ্ত উপকরণ ও জনবল নেই। এর ফলে সেবা নিতে আসা রোগীদের নানামুখী সমস্যায় পড়তে হয়। ফলে তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র জনগণকে জেলা হাসপাতালে বা বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসা নিতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হয়।

৭) জনবল সংকটের কারণে চিকিৎসা সরঞ্জামাদি অব্যবহৃত থেকে নষ্ট হওয়া: সম্প্রতি পটিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাসপাতালে আসা ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি স্থাপন করা হলেও টেকনিশিয়ানের অভাবে ব্যাহত হচ্ছে সেবা কার্যক্রম। সীতাকুন্ড স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরীক্ষার জন্য একটি ল্যাব থাকলেও টেকনিশিয়ান নেই। মিরসরাই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স গাইনী বিভাগের আল্ট্রাসনোগ্রাফি যন্ত্রটি থাকলেও অপারেটর না থাকাতে এটি কোন কাজেই আসছে না। সন্দ্বীপ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে জরুরী সেবা দেয়ার জন্য দুটি সী এমবুলেন্স থাকলেও চালক ও জ্বালানীর ব্যবস্থা না থাকায় তা রোগীদের কোন উপকারেই আসছে না। হাটহাজারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোটি টাকার সরঞ্জামাদি অব্যবহৃত পড়ে আছে জনবলের অভাবে। আনোয়ারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অপারেশন কক্ষটি জনবল ও যন্ত্রপাতির অভাবে চালু করা যাচ্ছে না (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৩-২-২০)।

৮) চতুর্থ শ্রেণির সেবাকর্মী সংকটে সৃষ্ট অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের ফলে রোগের বৃদ্ধির কারণে রোগীদের অসন্তোষ সৃষ্টি হওয়া: স্বাস্থ্যসেবাকর্মীর বাইরে ওয়ার্ডবয়, সুইপার আয়া ইত্যাদিও স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মান উন্নয়নের জন্য অংশীদার। অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের কারণে দশজনের কাজ তিনজনকে দিয়ে করিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রের পরিবেশ স্বাস্থ্যকর রাখা যায় না বিধায় রোগীরা অসন্তুষ্ট থাকে এবং সূস্থ মানুষ এখানে এসে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে।

৯) রোগীরা চিকিৎসকদের ওপর বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে: উপজেলায় রোগী অনুপাত ডাক্তার র্নাস সেবাকর্মী খুবই স্বল্প হয়ে পড়েছে বিধায় চিকিৎসক ও সেবাকর্মীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেও রোগীদের সন্তুষ্ট করতে পারছেন না। রোগীদের সম্পুর্ণ ক্ষোভ থাকে ডাক্তারদের উপর। ফলে উপজেলায় চিকিৎসকদের উপর হামলা বাড়ছে।

১০) সব দায় নিতে হচ্ছে চিকিৎসকদেরকে: উপজেলায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের পদায়ন খুবই অপর্যাপ্ত হবার কারণে রোগ নির্ণয়ে সমস্যা হয়। অতি স্বল্প নার্সের কারণে সেবার মান কমে যায়। চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর সংকটের জন্য নোংরা দুর্গন্ধ পরিবেশে রোগীরা হাসপাতালের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। এসবগুলির দায় নিতে হচ্ছে চিকিৎসকদেরকে। বিশেষ করে এজন্য নবীন চিকিৎসকদের ভোগান্তি হয় সবচেয়ে বেশি। যেহেতু উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে নবীন চিকিৎসকদের পদায়ন হয়ে থাকে।

১১) টারশিয়ারি ধাপ বা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহে রোগীর অস্বাভাবিক বৃদ্ধি: মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসমূহ হচ্ছে টারশিয়ারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ রুপ। এমনি ধরনের টারশিয়ারি ধাপের সার্বিক চিকিৎসাব্যবস্থাসম্পন্ন হাসপাতালসমূহে যতো রোগী চিকিৎসার জন্য যায় তার ষাট শতাংশ উপজেলা হাসপাতালসমূহে বা প্রাইমারি ধাপের হাসপাতালসমূহে এবং বিশ শতাংশ জেলা হাসপাতালসমূহে বা সেকেন্ডারি ধাপের হাসপাতালসমূহে চিকিৎসা গ্রহণ করে সুস্থ হতে পারতো বলে পর্যবেক্ষণে দেখা গিয়েছে। অবশিষ্ট বিশ শতাংশ হচ্ছে মূলত টারশিয়ারি ধাপের হাসপাতালসমূহে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করার রোগী। অর্থাৎ হাজার তিনেক রোগীর মধ্যে ৬০০ জন হচ্ছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করার রোগী। কিন্তু অতিরিক্ত ২৪০০ জন রোগী যাদের চিকিৎসা প্রাইমারি ও সেকেন্ডারি ধাপের হাসপাতালে হতে পারতো তাদের চাপে টারশিয়ারি ধাপের প্রকৃত ৬০০ জন ‘ক্রিটিকেল কেয়ার’ এর রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।

উপসংহার: উপজেলা হাসপাতাল হচ্ছে প্রাইমারি ধাপের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিকিৎসার জায়গা। সেখানে চিকিৎসা না পেয়ে তবেই রোগীরা শহরমুখী হচ্ছে। অতএব সেকেন্ডারি ও টারশিয়ারি ধাপের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে রোগীর চাপে বিপর্যস্থ হওয়া থেকে রক্ষা করতে হলে প্রাইমারি ধাপ অর্থাৎ উপজেলা হাসপাতালের সমস্যাসমূহের সমাধান করা অতীব জরুরি।

লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস ও চর্ম ও যৌনরোগে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট