চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

পবিত্র আশুরার শিক্ষা অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত

 মাহমুদ আহমদ 

২০ আগস্ট, ২০২১ | ৮:৪৭ অপরাহ্ণ

বিশ্বনবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে চক্রান্তকারী ইয়াজিদ বাহিনীর হাতে এই পবিত্র মহররম মাসের ১০ তারিখে নির্মমভাবে কারবালার প্রান্তরে শাহাদত বরণ করেন। সেদিন প্রকৃত ইসলাম ও সত্যের জন্য হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদ বাহিনীর কাছে মাথানত না করে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেছিলেন।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) সেদিন ন্যায় ও সত্যের জন্য চরম আত্মত্যাগের যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা অনুকরণীয়। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদতের দিনকে স্মরণ করে যথার্থই লিখেছেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’। তাই রাস্তা-ঘাট বন্ধ করে অপরকে কষ্ট দিয়ে শোক প্রকাশ না করে বরং হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর ত্যাগের কথা স্মরণ করতে হবে। এছাড়া শহীদে কারবালায় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) বলে গেছেন- ‘আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ! আহ! করো না, আঁচল ছিঁড়ো না, বরং ধৈর্য ধারণ করে থাকবে’।

হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনার জন্য প্রত্যেক মুসলমানই সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করে থাকেন। কারবালায় হজরত ইমাম হোসাইন (রা.), তাঁর পরিবারের সদস্যবর্গ এবং কয়েকজন সাথী সঙ্গীকে বড় নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে এ ঘটনা হজরত ওসমান (রা.)-এর শাহাদাতের ঘটনারই একটি ধারাবাহিকতা। 

হজরত ইমাম হাসান ও হোসাইন সম্পর্কে মহানবী (সা.) বলেছেন, জান্নাতের যুবকদের সরদার তারা। তাদের উভয়ের জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) আল্লাহতায়ালার কাছে এই দোয়া করতেন যে, হে আল্লাহ;! আমি তাদের ভালবাসি, তুমিও তাদেরকে ভালবাস। অতএব, যারা রাসুলুল্লাহর দোয়ার কল্যাণ এতটা লাভ করেছেন আর একইসাথে যারা শাহাদতের পদমর্যাদাও লাভ করেন এমন মানুষ অবশ্যই আল্লাহর প্রতিশ্রুতি অনুসারে জান্নাতে মহান জীবিকা লাভ করবেন এবং তাদের হত্যাকারী অবশ্যই খোদার গযব এবং ক্রোধের শিকার হবে। এই মহররম মাসে আজ থেকে চৌদ্দশ বছর পূর্বে দশ তারিখে নিষ্ঠুর পাষাণরা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর এই অতি আপন এবং প্রিয়জনকে শহীদ করে। যে শাহাদতের ঘটনা শুনে গা শিউরে উঠে। এই পাষাণরা এক মুহূর্তের জন্যও চিন্তা করল না যে কাকে আমরা খড়গাঘাত করতে যাচ্ছি।

হজরত হোসাইন (রা.)-এর সৈন্য বাহিনীর ওপর যখন শত্রু নিয়ন্ত্রণ পায় তখন তিনি ঘোড়াকে সমুদ্রমুখী করে অগ্রসর হওয়ার জন্য ইচ্ছা করেন তারপরও তাকে বাধা দেওয়া হয় এবং তার প্রতি তীর ছোঁড়া এবং সেই তীর হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর চিবুকের নীচে লাগে। বর্ণনাকারী বলেন, আমি শাহাদতের পূর্বে তাকে এই কথাই বলতে শুনেছি, আল্লাহর কসম, আমার পর খোদার এমন কোন বান্দাকে তোমরা হত্যা করবে না, যার হত্যার কারণে আল্লাহ তোমাদের প্রতি আরো বেশি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করবেন। আমি আশা করি আল্লাহতায়ালা তোমাদের লাঞ্ছিত করবেন আর আমাকে সম্মানিত করবেন।

এরপর আমার হত্যার প্রতিশোধ এমনভাবে নেবেন যে, যা তোমরা ভাবতেও পার না। খোদার কসম, আমাকে যদি তোমরা হত্যা কর তাহলে আল্লাহতায়ালা তোমাদের মাঝে যুদ্ধ সৃষ্টি করবেন এবং তোমাদের রক্ত ঝরবে। যতক্ষণ পর্যন্ত বেদনাদায়ক শাস্তিকে আল্লাহ বহুগুণে বৃদ্ধি না করেন তিনি বিরত হবেন না। তাকে শহীদ করার পর কুফাবাসীরা তার পবিত্র লাশের সাথে কি ব্যবহার করেছে দেখুন, আমর বিন সাদ আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা দেয়, কে কে হজরত ইমাম হোসেনের মৃত দেহের ওপর ঘোড়া দৌঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত।

এই কথা শুনে দশজন ঘোড়সোয়ার বের হয় যারা নিজেদের ঘোড়া নিয়ে তাঁর পবিত্র দেহের ওপর ঘোড়া দৌঁড়ায় এবং পিষ্ট করে আর তাঁর বক্ষ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায়। এই যুদ্ধে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর দেহ ৩৫টি তীরে  আঘাত বিদ্ধ হয়। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.)-এর মরদেহ পরবর্তীতে কুফার গভর্নরের কাছে পাঠানো হয়, সে তাঁর শিরোচ্ছেদ করে এজিদের কাছে প্রেরণ করে। এই ছিল নির্দয় ব্যবহার যা তাঁর সাথে করা হয়েছে, তাঁর লাশের সাথে করা হয়েছে।

এর তুলনায় নিষ্ঠুর পাষাণ ব্যবহার আর কি হতে পারে? তাঁর পবিত্র লাশের এমন অসম্মান অবমাননা কোন নোংরা শত্রুই তার শত্রুর ওপর করতে পারে কি? এমন কাজের মাধ্যমে এমন লোকদের অভ্যন্তরে শুধু নোংরামি আর নোংরামিই প্রকাশ পায়। এরা দুনিয়ার কীট ছিল, এরা নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের জন্য সাধুতা-ভদ্রতার সকল সীমা অতিক্রম করতে পারে এবং করেছে। ধর্মের সাথে তাদের দূরতম সম্পর্ক নেই। এদের উদ্দেশ্যটা হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) উপলব্ধি করতে পেরেছেন, যার ফলে তিনি এজিদের বয়াত করতে অস্বীকার করেছেন।

তিনি এজিদের প্রতিনিধিদের একথাও বলেছিলেন যে, আমি যুদ্ধ চাই না, আমাকে যেতে দাও, আমি গিয়ে খোদার ইবাদত করতে চাই বা কোন সীমান্তে আমাকে পাঠিয়ে দাও যেন ইসলামের জন্য যুদ্ধ করতে করতে আমি শাহাদাত বরণ করতে পারি বা আমাকে এজিদের কাছে নিয়ে যাও যাতে আমি তাকে বুঝাতে পারি যে, আসল ব্যাপার কি। কিন্তু তার প্রতিনিধিরা কোন কথা শুনে নাই। অবশেষে যুদ্ধ যখন চাপানো হয় তখন বীরপুরুষের মত মোকাবেলা করা ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় ছিল না। এই স্বল্পসংখ্যক মুসলমান যাদের সংখ্যা ৭০ থেকে ৭২ হবে তাদের মোকাবেলায় ছিল এক বিশাল সৈন্যবাহিনী।

এদের বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা কোনভাবেই সম্ভব ছিল না। একে একে তারা সবাই শাহাদাত বরণ করেন। আল্লাহতায়ালার প্রতিশোধ নেয়ার নিজস্ব রীতি আছে যেভাবে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) নিজেই বলেছিলেন যে, আল্লাহতায়ালা আমার হত্যার প্রতিশোধ নিবেন আর আল্লাহতায়ালা প্রতিশোধ নিয়েছেনও। এজিদকে আজ সবাই ঘৃণা করে। হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) এর জীবনের একটি উদ্দেশ্য ছিল। তিনি কখনো রাষ্ট্রক্ষমতা অর্জনের লোভ করতেন না, তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন।

তিনি ন্যায়ের জন্য দন্ডায়মান হয়েছিলেন। হজরত ইমাম হোসাইনের ত্যাগ, কোরবানি আমাদের জন্য অনেক শিক্ষা রেখে গেছে। নিজের অধিকার নিজের জীবন বাজি রেখে পৃথিবীতে সত্যের প্রসার করেছেন সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তিনি সত্য প্রচারের যে আদর্শ রেখে গেছেন তা সব সময় আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে হবে। আর এর ওপর যদি আমরা প্রতিষ্ঠিত থাকি তাহলে সেই বিজয়ের অংশ হবে, যা ইসলামের জন্য অবধারিত। কারবালা প্রান্তরে তাঁর শাহাদতবরণ ইসলামের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। সত্য, ন্যায় এবং নবুয়্যতের পদ্ধতিতে আল্লাহর জমিনে সত্যিকারের ইসলামী খেলাফত পুনঃপ্রবর্তনের লক্ষ্যে হজরত ইমাম হোসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গী-সাথীরা যে ত্যাগ ও কোরবানি স্বীকার করেছেন, কিয়ামত পর্যন্ত তা আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

লেখক: মাহমুদ আহমদ ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট