চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

উপজেলায় অক্সিজেন সংকটে বাড়ছে করোনার মৃত্যুহার

ডা. হাসান শহীদুল আলম

১৮ আগস্ট, ২০২১ | ১১:৫৪ অপরাহ্ণ

দ্বিতীয় পর্ব। লিখলাম উপজেলায় অক্সিজেন সংকটের কারনে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পাওয়া সম্পর্কে। আমাদের আলোচনার মাঝে খবর এলো, উপজেলায় সংক্রমন ৮১ শতাংশ ছাড়ালো (দৈনিক পূর্বকোণ, ১৪ জুলাই ২০২১)। গতবারের ধারাবাহিকতায় লিখছি-

গ) করোনা রোগীর চিকিৎসা কিভাবে করা হয়?

রিপোর্টে করোনা পজিটিভ আসলে রোগীকে আইসোলেশন বেডে ভর্তি করা হয়। রোগীকে শারীরিক সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হয়। শ্বাসকষ্ট থাকলে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন দেয়া হয়। সুস্থ হলে বাড়িতে আরো দুই সপ্তাহ আইসোলেশন বা পরিবারের সবার থেকে আলাদা থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।

আর যদি অবস্থার অবনতি ঘটে তবে আইসোলেশন বেড থেকে রোগীকে আইসিইউ বেডে স্থানান্তরিত করে হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা দেয়া হয় একজন বিশেষজ্ঞ আবেদনবিদ বা এনেস্থেটিস্ট এর নিবিড় তত্ত্বাবধানে। আশা করি আমি সম্মানিত পাঠকবৃন্দকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছি যে, করোনাচিকিৎসায় অক্সিজেন এবং আবেদনবিদ এ দুটো জিনিসের প্রয়োজনীয়তা খুবই বেশি।আর অক্সিজেন সঠিকভাবে দেয়ার জন্য অবধারিত ভাবেই প্রয়োজন হয় অক্সিজেন সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামসমূহের।

ঘ) অক্সিজেন সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামসমূহ থাকাটা কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ? বিশেষজ্ঞদের মতে, পালস অক্সিমিটার দিয়ে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতির পরিমাণ বের করা হয়। সে অনুযায়ী রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। এজিবি বা আর্টারিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার দিয়ে মুমূর্ষু রোগীর শরীরে অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়। কনসেনট্রেটর মেশিন বাতাসের নাইট্রোজেন সরিয়ে অক্সিজেনের বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করে।

ক্যানুলা অক্সিজেন সিলিন্ডার ও ফেসমাস্কের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। হিউমিডিফায়ার মূলত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের মধ্য থেকে বাতাসের আর্দ্রতা নিষ্কাশন করে থাকে। যাতে সেখানকার রোগীরা রোগ জীবাণু দ্বারা সংক্রমিত না হন। সিপ্যাপ ও বিপ্যাপ মূলত যেখানে ভেন্টিলেটর মেশিন থাকে না সেখানে রোগীর শরীরে অক্সিজেনের চাপ নিশ্চিত করতে ব্যবহার করা হয়। যাতে রোগীর ফুসফুসে সঠিক মাত্রায় অক্সিজেন পৌঁছায় এবং ফুসফুস কলাপস না করে।

ঙ) উপজেলায় চিকিৎসা ব্যবস্থার বেহাল দশার কারণ :

১) প্রাইমারি স্বাস্থ্যখাতে অপ্রতুল বরাদ্দ : আমাদের জাতীয় পরিকল্পনা ও বাজেট বরাদ্দে সবার জন্য স্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার হিসাবে বলা হলেও এই খাতের প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়টি বাজেটে খুব একটা প্রাধান্য পায় না। আমাদের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দাতাদের নির্দেশিত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব থাকায় স্বাস্থ্যের মতো সেবাখাতগুলোকে বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় নিতে বাধ্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীভূত বাজেট প্রক্রিয়ায় সত্যিকার অর্থে জন চাহিদা তুলে আনা হয় না। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি দেশকে প্রাইমারি স্বাস্থ্যখাতে জিডিপির ১ শতাংশ বিনিয়োগ করতে পরামর্শ দিয়েছে (বাংলা ট্রিবিউন, ২১ অক্টোবর ২০২০)। কিন্তু বাংলাদেশে প্রাইমারি স্বাস্থ্যখাতে নতুন অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে জিডিপির ০.৪ শতাংশেরও কম।

২) স্বাস্থ্যসেবার ছয়টি নিয়ামকের মধ্যে সমন্বয় না থাকা : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একটি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিকভাবে কাজ করার জন্য ছয়টি বিষয় নিশ্চিত করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, জনবল, চিকিৎসা সরঞ্জাম, তথ্য-উপাত্ত, সেবাদানের সঠিক নির্দেশিকা ও যথাযথ ব্যবস্থাপনা। এর যে কোন একটির অনুপস্থিতিতে অন্যটি ঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। যেমন ধরা যাক, কোন একটি উপজেলায় স্বাস্থ্যসেবা দিতে যে পরিমাণ ওষুধ ও যন্ত্রপাতি দরকার সেটা না থাকলে সেখানে কয়েক ডজন চিকিৎসক বসিয়ে রাখলে কোন লাভ হবে না। অর্থ, চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের সবকিছু থাকলেও যদি ‘কিভাবে কাজ করতে হবে’ এবং ‘কে কতটুকু কাজ করবেন’- এসব নির্দিষ্ট না করা হয়, তাহলে নামকাওয়াস্তে স্বাস্থ্যকাঠামো টিকে থাকবে বটে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া সম্ভব হবে না।

৩) ওষুধের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট না থাকা : উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতাল গুলোতে যে টাকা ওষুধের জন্য বরাদ্দ রাখা হয় তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। তাই হাসপাতালগুলোতে ওষুধের সংকট থাকে। অন্যদিকে কিছু ওষুধ কেন্দ্র থেকে চাপিয়ে দেয়া হয় যেগুলোর চাহিদা হাসপাতালে থাকে না।

৪) উপজেলা পর্যায়ে সঠিক রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা নেই : জেলা হাসপাতালগুলোতে রোগ নির্ণয়ের জন্য সামান্য উপকরণ থাকলেও সঠিক রোগ নির্ণয়ের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ উপজেলা হাসপাতাল গুলোতে থাকে না।

চ) উপজেলায় করোনা রোগীর মৃত্যুুহার বৃদ্বির কারণ :

১) পরিস্থিতি মোকাবেলায় পরিকল্পনার অভাব : বিএমএ-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, সার্বিক বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট হয় যে, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় স্বাস্থ্যবিভাগের ন্যূনতম পরিকল্পনাও ছিলনা। করোনা আক্রান্ত কোন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের অক্সিজেন প্রয়োজন হয়। অন্যথায় হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। এ পরিস্থিতিতে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি মনোযোগী হবার প্রয়োজন ছিল (সমকাল, ৬ জুলাই ২০২১)।

২) আইসিইউ ও হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ব্যর্থতা : করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর অনেক দেশ আইসিইউ সক্ষমতা বাড়াতে পারলেও এক বছরের বেশি সময় পেয়েও বাংলাদেশে বাড়েনি আইসিইউ সক্ষমতা। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা কার্যকর করা হয়নি। প্রধানমন্ত্রী ২০২০ সালের জুন মাসে একনেকের বৈঠকে সারা দেশে সব জেলা সদর হাসপাতালে আইসিইউ চালুর নির্দেশ দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে হাই ফ্লো অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও ৪২ জেলা সদর হাসপাতালে কেন আইসিইউ স্থাপন করা হয়নি, উপজেলা সদর হাসপাতালে কেন অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়নি, তার কোন সদুত্তর দিতে পারছেন না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়-এর কর্মকর্তারা (আলোকিত বার্তা, ২৮ জুন ২০২১)।

ছ) উপজেলায় করোনারোগীর মৃত্যুহার কমাতে করণীয় :

১) সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের করণীয় : উপজেলা পর্যায়ে নমুনা পরীক্ষা করতে দিলে সে নমুনা জেলা শহরে পাঠানো হয়। ফল পাওয়া যায় কয়েক দিন পর। ততদিন পর্যন্ত ঐ ব্যক্তি জানতে পারছেন না তিনি সংক্রমিত হয়েছেন নাকি হননি।

২) সরকারের করণীয় : একটি জেনারেটর থেকে প্রতিদিন ২৪ থেকে ২৫ হাজার লিটার অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব। জার্মানির সহায়তায় ভারত এই প্রক্রিয়ায় অক্সিজেন উৎপাদন করে হাসপাতালে রোগীদের সরবরাহ করছে। একটি হাসপাতালে জেনারেটর স্থাপন করা হলে তা থেকে হাই ফ্লো নেজাল ক্যানুলা দিয়ে আইসিইউ এর মতো ৭০ থেকে ৮০টি শয্যায় অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এছাড়া সাধারণ শয্যায় একটি জেনারেটরের মাধ্যমে ১০০ থেকে ১২০টিতে সরবরাহ করা যাবে (সমকাল, ৬জুলাই ২০২১)।

অক্সিজেন সংকট দূরীকরণ প্রসঙ্গে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে অক্সিজেন উৎপাদনের জন্য জার্মান একটি কোম্পানি আছে। তাদের উৎপাদন ডবল করার জন্য বলতে হবে। তারা উৎপাদন দ্বিগুণ না করে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করছে। প্রতিটি জেলায় সরকার অক্সিজেন প্ল্যান্ট বসানোর উদ্যোগ নিতে পারে। এতে প্রতি প্ল্যান্টে ৬ কোটি টাকা খরচ হবে। সারাদেশে মোট খরচ হবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা। তাহলে আর বাইরে থেকে অক্সিজেন আমদানি করতে হবে না। আজকে অর্ডার দিলে তিন মাসের মধ্যে দেশে সব মেশিন চালু করা সম্ভব বলে মনে করি (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ৮ জুলাই ২০২১)।

৩) স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দে ইউনিয়ন পর্যায়কে গুরুত্ব দেয়া : বাজেটে ইউনিয়ন পর্যায়কে গুরুত্ব দেয়া উচিত যেহেতু গ্রামাঞ্চলের জনসাধারণ আর্থিক এবং অন্যান্য প্রতিকুলতার কারণে শহরে এসে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে না। স্থানীয়ভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সক্ষমতা অর্জনের নীতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশে প্রতিটা সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অর্থ সরকারি ট্রেজারিতে জমা দিতে হয়। এটা ঐতিহাসিকভাবে চলে আসছে। সেটা ল্যাব টেস্ট, এম্বুলেন্স ভাড়া বা অন্য কোনো ইউজার ফি হতে পারে। সরকারি আর্থিক ব্যবস্থাপনার নীতি পরিবর্তন করে স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অর্থ স্থানীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের অধিকার দিতে হবে। এটা সেবাপ্রদানকারীদের মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি করবে এবং এর ফলে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সেবার মান উন্নত হবে।

উপসংহার : উপজেলায় করোনায় অধিকতর মৃত্যুহার কমাতে উপজেলায় নমুনা পরীক্ষার ব্যবস্থা ও হাই ফ্লো নেজাল অক্সিজেন ও অক্সিজেন সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম এর ২৪ ঘণ্টার সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। সে সঙ্গে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরিভাবে প্রয়োজনীয় জনবল ও বরাদ্দ বাড়িয়ে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে একটি শক্তিশালী ও পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে সক্ষম কেন্দ্র হিসাবে তৈরি করতে হবে। (সমাপ্ত)

লেখক: ডা. হাসান শহীদুল আলম ডায়াবেটিস চর্মযৌনরোগে, স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চিকিৎসক।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট