চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

কিংবদন্তি মানুষ রামেন্দু মজুমদার

শিশির দত্ত

৯ আগস্ট, ২০২১ | ৯:৫২ পূর্বাহ্ণ

রামেন্দুদা এখন আশিতে। এক দীর্ঘ সময় নিয়ে কেবলমাত্র নাটক ও নাট্য পত্রিকার সম্পাদনার ভিতর দিয়ে তিনি আজ আমাদের কাছে একজন সাংস্কৃতিক আদর্শ হিসেবে নিজেকে তৈরি করলেন। তাঁর আদর্শে আজও বাংলাদেশের নাটকের দল, নাট্যকর্মীরা অনেকবেশি উদ্বুদ্ধ ও স্বতঃস্ফূর্ত। প্রায় ৫০ বছরের কাছাকাছি সময় ধরে রামেন্দুদা ‘থিয়েটার’ নামক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করছেন। তাঁর সম্পাদিত ‘থিয়েটার’ এ মুদ্রিত হয়েছে অজস্র নাটক ও নাট্য বিষয়ক নিবন্ধ, এমন একটা দায়িত্ব পালন করে আসার জন্য আমরা বাংলাদেশের নাট্যকর্মীরা তাঁর কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশের নাটককে আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরিচিত করে তোলার ক্ষেত্রে তিনি একটা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। বলা যায়, তাঁর একক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আইটিআই। পাশাপাশি বাংলাদেশের নাটক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পেয়েছে পরিচিতি। তিনি এককভাবে এক্ষেত্রে পালন করেছেন অনন্য ভূমিকা। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে তিনি যা শুরু করেছিলেন, আজও সেই ধারাবাহিকতার কোথাও ছেদ পড়েনি। তিনি ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার ভলিউম’ নামে উল্লেখযোগ্য কিছু প্রকাশনা সম্পাদনা করেছেন। পাশাপাশি আইটিআই এর সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। তাঁর সব কৃতিত্বই কেবলমাত্র নাটককে কেন্দ্র করে।

তখন সময়টা একেবারেই অন্যরকম। ঢাকায় এসেই প্রথমে মহিলা সমিতি, টিএসসি তারপরেই বিটপী (তৎকালীন সময়ে রামেন্দুদার কর্মস্থল) হাজির হতেই হবে। রামেন্দুদাই সম্ভবত (নিশ্চিত করে বলা যায়) নাট্যদলগুলো নিয়ে সম্মিলিত মোর্চা তৈরির পরিকল্পক। আশির দশকের শুরুতেই ফেডারেশন তৈরির বিষয়গুলো মাথায় নেন রামেন্দুদা। প্রথমে বেশ কয়েকটি অনানুষ্ঠানিক মিটিং করার পর ১৯৮০ সালে টিএসসির ২য় তলায় আনুষ্ঠানিকভাবে সূচনা হলো ফেডারেশনের। দীর্ঘদিন ফেডারেশন পরিচালনায় রামেন্দুদার ভূমিকা ছিল একেবারেই স্বতন্ত্র, তিনি যে একজন অসাধারণ সংগঠক তখন থেকেই তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন। আমরা যারা ঢাকার বাইরে নাটক করতাম তাদেরকে খুঁজে নিয়ে একসাথে পথচলার শুরুটা দেখালেন তিনি। বিশেষ করে ফেডারেশনের প্রতিবাদী ভূমিকা, অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের ক্ষেত্রে ফেডারেশনকে কার্যকর একটা ভূমিকায় রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন। এক্ষেত্রে একক কৃতিত্ব একেবারেই রামেন্দুদারই প্রাপ্য।

১৯৮২ সালে রামেন্দুদা আমাকে আইটিআই-এর প্রতিনিধিত্ব করতে কলকাতায় পাঠান। কলকাতায় সেবার এই সম্মিলনের আয়োজনে ছিলেন ‘পদাতিক’ এর শ্যামানন্দ জালান। কলকাতার কেন্দ্রস্থল লা মার্টিনিয়ার স্কুলে ছিল দিনভর সেমিনার ও ডেমন্স্ট্রেশন। আর সন্ধ্যায় কাছাকাছি কলামন্দিরে বসতো নাটক ও ধ্রুপদী নাচের আসর। সেবারেই প্রথম আমি অনেকগুলো আন্তর্জাতিক ব্যক্তির সাথে কথোপকথনের সুযোগ পাই। সেখানেই ছিলেন রিচার্ড-শেখনার, মল্লিকা সারাভাই, ইউজিনো বারবারা ও সংযুক্তা পানিগ্রাহি প্রমুখ। আমার ব্যক্তিগত শিখনে এই স্মৃতি এখনও তাড়িত করে। এই প্রেরণা আমাকে নাট্যক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকতে উৎসাহ জুগিয়েছিল, যার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা জানাতে চাই রামেন্দুদাকে।

রামেন্দুদার ‘থিয়েটার’, ‘অরিন্দম’ এর আমন্ত্রণে চট্টগ্রামে মঞ্চায়ন করেছে ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ স্থানীয় মুসলিম হল মিলনায়তনে যে ধরণের দর্শক উপস্থিত হয়েছিল তা চট্টগ্রামের নাট্য ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ এর প্রদর্শনী শেষে রামেন্দুদা সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতেন, যা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি তাড়িত হতে সাহায্য করতো এবং অনেক মুক্তিযোদ্ধা দর্শকদের আমরা দেখেছি আবেগতাড়িত হতে। দেখবার এই শক্তি আমরা খুব বেশী পাই তা নয়। আমার এখনও মনে হয়, গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি এখন কেন হয় না? তখনই মনে হয় আমরা রামেন্দুদাদের আর কতদিন পাবো? যেখান থেকে নিজেদের তৈরি করতে চাই, পারবো কি তৈরি করতে? এখানে আপনি অনেক বেশি শ্রদ্ধেয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন নাট্যচর্চা নিয়ে অনেকের ভিন্ন মত রয়েছে। বিশেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসমূহ এ প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে জনসচেতনতার কাজ করলেও এর শিল্পমান নাট্যবোদ্ধাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। সেটা ছিল অনেকটা শুরুর দিকে। পরে অনেকেই ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও কিছু সংগঠনের উদ্যোগে বাংলাদেশের উন্নয়ন নাট্যচর্চার প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের নিয়ে মোর্চা গঠনের প্রস্তুতি শুরু হলে তখন তাতেও তিনি যথাযথ মনোযোগ দিয়েছেন। রামেন্দু মজুমদার তাঁর বক্তব্যে এই ধরণের মোর্চা গঠনের উদ্যোগকে সময় উপযোগী বলে অবহিত করেন। তিনি বলেন, ‘উন্নয়নের সঙ্গে সংস্কৃতির ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলেও তা আমাদের দেশের সরকার উপলব্ধি করছে না। তাই এ বিকল্পধারার নাট্যচর্চা বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় শুধু মনে প্রাণে গ্রহণ করেছে। অথচ এদেশের নাট্যচর্চা পৌনঃপৌনিকতায় ভুগছে, যেখানে টিএফডি (থিয়েটার ফর ডেভলাপমেন্ট) প্রক্রিয়ায় থিয়েটার চর্চা একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। এমন অবস্থায় মোর্চা গঠনের মাধ্যমে বিভিন্ন মাধ্যমকে একত্রিত করে বাংলাদেশের প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লোকজ মাধ্যমগুলোকে নিয়ে নিজেদের আরও আস্থাবান করে তুলে টিএফডি প্রক্রিয়ায় থিয়েটার চর্চাকে একটি পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে মনে করি।’

লাদেশের নাটক ও নাট্যচর্চায় তিনি বড় একটা বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে দিয়েছেন। যেখানে গত ৫০ বছরের আমাদের সংস্কৃতির ইতিহাসে অচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছেন তিনি। শত বছর যেন তিনি আমাদের নাটক, আমাদের সংস্কৃতির সাথে থাকেন।

শিশির দত্ত কবি, সাংস্কৃতিক সংগঠক ও উন্নয়নকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট