চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

তরুণ উদ্যোক্তা ও স্বাস্থ্যসম্মত দেশি গরুতেই কোরবানি

অধ্যাপক সরওয়ার জাহান

১৯ জুলাই, ২০২১ | ৭:২৪ অপরাহ্ণ

মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই মূলত পশু কোরবানি। ঈদ এলেই অসাধু ব্যবসায়ীরা গবাদিপশু সংকটে বা কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। একসময় পত্রিকার পাতা খুললেই দেখা যেত, সীমান্ত বন্ধ, গরু আসবে কিনা সন্দেহ, সীমান্তে বাংলাদেশিদের অপহরণ, গুলি করে হত্যাসহ নানা ঘটনার খবর।

এছাড়াও পথে পথে প্রতিবন্ধকতাসহ নানাবিধ মৌসুমী সমস্যা তো ছিলই। আর এখন করোনা মহামারি সংকটের মধ্যে পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যবিধি এবং সুরক্ষার অভাবে কোরবানির গরু কেনা-বেচা সকলের কাছে সমস্যা হয়ে গেছে। তবে কথায় বলে যত মুশকিল, তত আসান। অর্থাৎ সমস্যা যতই হোক না কেন সমাধানের উপায়ও আছে। নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এ ব্যবসাকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষিত তরুণ উদ্যোক্তারা। তাদের এমন আগ্রহ নিঃসন্দেহে দেশের জন্য একটি ইতিবাচক পরিবর্তন।  প্রয়োজনের তাড়নায় নতুন নতুন সম্ভাবনা দেখা যায়। বিভিন্ন দুর্যোগ থেকে আমরা উঠে এসেছি। তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণে পরিণত হয়েছে দেশ।

অনেকের ধারণা ছিল বিদেশ থেকে গরু না আসলে কোরবানি হবে না। সময় পাল্টেছে, বাংলাদেশিরা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সেদিন আর বেশি দূরে নয় পৃথিবী বলবে, আমরা বাংলাদেশীদের মতো হবো। ঘুরে দাঁড়ানো বাংলাদেশ অনেকের কাছেই বিস্ময়। ২০২১-২০৪১ সালের মধ্যেই আগামীর বাংলাদেশ গড়বে তরুণরাই। শুধু প্রয়োজন প্রশাসনিক উদারতা এবং শ্রেণিবিন্যাস, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখা, ন্যায় এবং আইনের শাসনের বাস্তবায়ন।

তখন এই দেশের উন্নয়নকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না। সঠিক পরিকল্পনাই নিয়ে যাবে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে। শতবছরের সুযোগ একবারেই আসে। ২০৪১ সালের পর তরুণরা আর তরুণ থাকবে না।  কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে প্রতিবছর বেশি মুনাফার আশায় অসাধু পশুব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করে বাজারে নিয়ে আসে। স্টেরয়েড দিয়ে মোটাতাজা করা গরু দেখতে আকর্ষণীয়, চকচকে ও হৃষ্টপুষ্ট হয়। বিভিন্ন ধরনের ঔষধ, ইনজেকশন ও রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে কোরবানির পশুকে মোটাতাজা করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃত্রিম উপায়ে মোটাতাজা গরুর মাংস খেলে মানুষের শরীরে পানি জমে যাওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়া, মূত্রনালি ও যকৃতের বিভিন্ন রকম সমস্যা দেখা দিতে পারে। এসব ক্ষতিকর উপাদান রান্নার পরও মাংসে থেকে যায়। এই মাংস খেলে রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশে প্রায় এক কোটি গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়া কোরবানি দেওয়া হয় যার প্রায় ৭০ ভাগই গরু। সবাই সামর্থ অনুযায়ী সুন্দর মোটাতাজা গরু কোরবানি দিতে চান। অনেক সময় গরু মোটা পাওয়া যায় ঠিকই, কিন্তু সুস্থ পাওয়া যায় না। কিছু বিষয় জানা থাকলে সুস্থ এবং ঔষধ খাইয়ে কৃত্রিমভাবে মোটাতাজা করা পশু চেনা যায়।

পশুকে স্টেরয়েড বা হরমোন প্রয়োগ করা হলে তা পশুর প্রস্রাব বন্ধ করে দেয়। ফলে পশুর চামড়ার নিচে পানি জমতে থাকে এবং তা ফুলে যাওয়ায় পশু স্বাস্থ্যবান দেখায়। মৎস্যখাদ্য, পশুখাদ্য আইন ধারা ১৪তে বলা হয়েছে, গবাদি পশুর হৃষ্টপুষ্ট করণে কোন প্রকার হরমোন স্টেরয়েড এবং ক্ষতিকর রাসায়নিকদ্রব্য ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অসাধু পশুব্যবসায়ীরা কৃত্রিম উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করলেও দেশীয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণ করছেন শিক্ষিত তরুণ খামারিরা।

বিদেশ থেকে গরু আসা নিয়ে সংকট, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য, অস্বাস্থ্যকর পশু কোরবানি থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যই দেশি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা গবাদিপশু লালন-পালনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। অনেকে মূল পেশার পাশাপাশি এসব খামার গড়ে তুলছে। ঢাকায় ছাদের উপর গরুর খামারের সংবাদ পাওয়া যায়। নানা প্রতিবন্ধকতাকে উপেক্ষা করে প্রতিবছর দেশে নতুন গবাদিপশুর খামার যুক্ত হচ্ছে। মূলত, কোরবানির হাট ও দুধ বিক্রির লক্ষ্য নিয়ে শুরু হওয়া এসব খামারের বেশির ভাগ উদ্যোক্তা হচ্ছে শিক্ষিত তরুণ।

এসব তরুণ কোরবানির হাটে যে পরিমাণ গরু-ছাগলের যোগান দিচ্ছে, তাতে বিদেশ থেকে আর আমদানির দরকার হবেনা। উল্টো দেশের গরুর চাহিদা মিটিয়ে গরু উদ্বৃত্ত সম্ভব হবে। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ঠিক কতগুলো খামারে অর্গানিক পদ্ধতিতে গরু পালন করা হচ্ছে তার সঠিক হিসেব নেই। অর্গানিক পদ্ধতিতে পালন করা গরুকে যেসব খাবার খাওয়ানো হয় তা সম্পূর্ণ দেশীয়। এ খাতে যদি সহযোগিতা পাওয়া যায় খামারিরা উৎসাহিত হবে অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম কমবে, সর্বোপরি সুস্থ গরু পাওয়া যাবে।

করোনা ভাইরাসের কারণে খামারে আসা ক্রেতার সংখ্যা কম এবং মানুষ নানা সঙ্কটে। এবারের ঈদে অর্থ সংকটের কারণে অনেকেই কোরবানি থেকে বিরত থাকতে পারে। আর পশুর হাটে মানুষের ভিড় বেশি হওয়ার সম্ভাবনায় করোনা ভাইরাসের কারণে অনেকেই হাটে আসবে না। আর অনলাইনে আস্থার অভাবে পশু বিক্রি কেমন হবে তা নিয়েও অনেকে শঙ্কায় রয়েছে। যে কারণে চাহিদার তুলনায় কোরবানির পশুর সংখ্যা বেশি থাকা সত্ত্বেও পশু কম বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। আর গত বছরের তুলনায় এবারের গো খাদ্যের দাম বেড়েছে কয়েক গুণ। এজন্য পশু পালনে তাদের খরচও অধিকাংশে বেড়ে গেছে।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কোরবানির প্রাণী বেচা-কেনার জন্য ই-কমার্স প্লাটফরমগুলোর ক্রমবর্ধমান চাহিদা দেখা যাচ্ছে। যত্র-তত্র হাটের চেয়ে খামারিদেরকে আরও বেশি গ্রাহকের কাছে পৌঁছাতে, ই-কমার্স প্লাটফরমগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। গরুর হাটগুলোতে প্রচুর নগদ লেনদেন ব্যবসায়ী এবং গ্রাহকদের মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি অনেক বাড়িয়ে দেবে। অর্থ প্রদানের সুবিধার্থে এবং এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য, মোবাইল মানি অ্যাপের মতো ডিজিটাল সেবাগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

বর্তমান সময়ে রাজনীতিবিদরা ঠিকাদারিসহ শিল্পকারখানা ও বিভিন্ন ব্যবসায় মনোনিবেশ করলেও অনেক তরুণ চলছেন ভিন্ন পথে। বর্তমানে দেশের অনেক তরুণ এগ্রোভিত্তিক খামারে বিনিয়োগ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। করোনাপরিস্থিতির কারণে অর্থনীতির অন্যান্য খাত চাপের মুখে থাকলেও মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে প্রতিবছর যুক্ত হচ্ছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারী। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খামারের সংখ্যা।

এ কারণেই গবাদি পশু উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। কোরবানিকে সামনে রেখে বিশুদ্ধ উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণের যে উৎসাহ খামারিদের তৈরি হয়েছে, তা ধরে রাখতে হবে। শুধু কোরবানি নয়, সারাবছরের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে মাংস রপ্তানি করারও উদ্যোগ নিচ্ছেন এ খাতের বিনিয়োগকারীরা। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে হালাল মাংস আমদানির আগ্রহ দেখিয়েছে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ।

লেখক: প্রফেসর সরওয়ার জাহান উদ্যোক্তা, টেকসই উন্নয়নকর্মী

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট