চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

ইতিহাস-ঐতিহ্যের সিআরবিতে কোনো ধরনের স্থাপনা নয়

১৭ জুলাই, ২০২১ | ৫:৫৯ অপরাহ্ণ

গত কয়েকদিন যাবৎ চট্টগ্রামসহ সারাদেশের প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ চট্টগ্রামের সিআরবি এলাকায় ছয় একর জমিতে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ লি.এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী প্রাইভেট হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করছেন ব্যাপকভাবে।

পরিবেশ ও মানবাধিকার সংঘঠনগুলো খোদ সিআরবিতেই প্রতিদিন প্রতিবাদ সমাবেশ করছে, তারা বৃহত্তর আন্দোলন ও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হবেন বলে জানিয়েছেন (ইতোমধ্যে পরিবেশ সংঘঠন গুলোর পক্ষ থেকে আইনী নোটিশ প্রেরণ করা হয়েছে)।

সোস্যাল মিডিয়াতে ব্যাপক প্রতিবাদ হচ্ছে। চট্টগ্রামের সব দৈনিক পত্রিকা সিআরবিকে অবরুদ্ধ করে হাসপাতাল করার বিরুদ্ধে তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। আমরা সবাই জানি যে, শহরের যানজটে অতিষ্ঠ মানুষগুলো ইট-পাথরের খাঁচায় বন্দি থাকে, শিশুকিশোরদের খেলার জায়গাগুলো ক্রমেই সংকুচিত, মনের আনন্দে সামান্য সময় কাটাবে কিংবা বুকভরে নিঃশ্বাস নেবে- এমন উন্মুক্ত জায়গা চট্টগ্রামে খুব একটা নেই। ব্রিটিশ আমলের লাল ইটের দৃষ্টিনন্দন সিআরবি ভবনকে ঘিরে শতবর্ষী গাছগাছালি, পিচঢালা আঁকাবাঁকা রাস্তা, পাহাড়-টিলা আর মনজুড়ানো এক প্রাকৃতিক পরিবেশ রয়েছে সিআরবিতে। এটা যেন সৃষ্টিকর্তার অপরিসীম কৃপা।

নগরবাসী স্থানটিকে চট্টগ্রামের ‘ফুসফুস’ বলে থাকেন। এখানের পাহাড়ে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি ও প্রাণীর আবাস। গত কয়েক বছর ধরে পহেলা বৈশাখসহ নানা আয়োজন হয় সিআরবি শিরীষতলায়। ছায়াঘেরা পরিবেশ নগরবাসীর প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণ এবং বিনোদনের কেন্দ্রও এই স্থানটি। কিন্তু এখানে   প্রাইভেট হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণ করা হলে সেই ‘ফুসফুস’ ধ্বংস হবে।

ইতোমধ্যে আমাদের কর্তাব্যক্তিদের  অদূরদর্শীতার কারণে আউটার স্টেডিয়ামের অধিকাংশ জায়গা খেয়েছি, সার্কিট হাউজের সামনের মাঠ খেয়েছি, ফয়েজলেক খেয়েছি, ছোটবড় অনেক পাহাড়-টিলা খেয়েছি, খাল-নালার উপর ভবন তৈরি করে নগরীতে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করার ব্যবস্থা করেছি এবং সর্বশেষ টাইগারপাসের সৌন্দর্য খাবো খাবো করছি, এখন দৃষ্টি পড়েছে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্যমন্ডিত এলাকা সিআরবির উপর।

উল্লেখ্য, গতবছরের ১৩ ফেব্রুয়ারি পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ১৮ মার্চ ’২০ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ  লিমিটেডের সাথে সঙ্গে চুক্তি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয়েছে ১২ বছর। প্রকল্পের আওতায় ১০০ আসনের একটি মেডিকেল কলেজ, ৫০ আসনের একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং দুই ধাপে মোট ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। ৫০ বছর পর প্রকল্পের মালিকানা হবে রেলওয়ের। ইতোমধ্যে প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্ট এবং প্রিমিয়াম বাবদ ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ রেলওয়েকে প্রায় পাঁচ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে এবং আরও সাড়ে তিন কোটি টাকা কয়েক ধাপে পরিশোধ করবে।

আমরা মনে করি, স্বর্গোদ্যানসম এ জায়গাটিতে হাসপাতাল হলে এখান থেকে বিতাড়িত হবে প্রকৃতির ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণ, কাটা পড়বে গাছগাছালি, তৈরি হবে মেডিকেল বর্জ্য, গড়ে উঠবে দোকানপাট। এভাবে একবার বাণিজ্যিক আগ্রাসন শুরু হলে সেটা আর আটকানো যাবে না। তাছাড়া যানজটের কারণে এই এলাকা রিয়াজুদ্দিন বাজার ও বহদ্দারহাটের রূপ ধারন করবে। ফলে মৃত্যুবরণ করবে প্রিয় সিআরবি, ধ্বংস হবে মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেয়ার জায়গাটুকু। আমরা মনে করি, সিআরবিতে শুধু হাসপাতালই নয়, কোনো ধরনের স্থাপনাই হওয়া উচিত হবে না। এই স্থানটি চট্টগ্রামের ফুসফুস। বুকভরে বাতাস নিতে এটাকে রক্ষা করতে হবে। চট্টগ্রামে ঢাকার মতো রমনা পার্ক নেই, বোটানিক্যাল গার্ডেন নেই। গাছগাছালিতে আচ্ছাদিত নয়নাভিরাম এই উন্মুক্ত পরিসরটিই যদি না থাকে, মানুষ যাবে কোথায়!

এদিকে চুক্তি করলেও সিআরবিতে হাসপাতাল চান না খোদ রেলওয়ের শ্রমিক-কর্মচারীরা। এরই মধ্যে তারা প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপিও দিয়েছেন। তাদের বক্তব্য, তারা হাসপাতালের বিপক্ষে নন। তবে এই ধরনের হাসপাতাল করার মতো চট্টগ্রাম নগরীতে রেলওয়ের অনেক জমি পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। কিছু জমি প্রভাবশালীরা দখল করে আছেন। সেগুলো উদ্ধার করে হাসপাতাল করা যায়। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম শহরের অদূরে কুমিরায় রেলের একটি বক্ষব্যাধি হাসপাতাল রয়েছে। পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ওই হাসপাতাল ও আশপাশে প্রায় ১০ একর জমি খালি পড়ে রয়েছে। সিআরবির পরিবর্তে ইউনাইটেড হাসপাতালটি যেন সেখানে নির্মাণ করা হয়। চসিক মেয়র প্রয়োজন হলে হাসপাতাল করার জন্য অন্যত্র সিটি কর্পরেশনের জায়গা দেয়ার কথা বলেছেন।

এদিকে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দাবি করেছে, সিআরবির যে অংশে শতবর্ষী গাছ ও শিরিষ তলা- সেখানে হাসপাতাল নির্মাণ করা হচ্ছে না। হাসপাতাল হবে গোয়ালপাড়ার দিকে। কোন শতবর্ষী গাছ কাটা হবে না। এই বক্তব্য যে ‘অদূরদর্শী’ তা বলাবাহুল্য মাত্র। কারণ সিআরবিতে হাসপাতাল বা বড় ধরনের স্থাপনা বা কর্মযজ্ঞের বিরোধিতার আন্দোলন শুধুমাত্র যে গাছ রক্ষার আন্দোলন নয়, এটা বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছে।

এই আন্দোলন মূলতঃ সিআরবির সৌন্দর্য তথা প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রক্ষার, পরিবেশ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য রক্ষার আন্দোলন, সৃষ্টিকর্তার দানকে রক্ষার আন্দোলন, চট্টগ্রামের মানুষের নিঃশ্বাস নেয়ার আশ্রয়টুকু রক্ষার আন্দোলন। আমরা মনে করি, প্রাকৃতিক ও ঐতিহ্যগত কারণেই সিআরবি এলাকাকে অবিকৃত রাখতে হবে। রেলের জায়গার কোন অভাব নাই যে সিআরবি ধ্বংস করে এই জায়গাতেই হাসপাতাল করতে দিতে হবে। রেলওয়ে শ্রমিকলীগের প্রস্তাবানুযী কুমিরাতেই পরিত্যক্ত বক্ষব্যাধি হাসপাতাল এলাকাই হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ নির্মাণের জন্য উপযুক্ত স্থান। প্রস্তাবটি যুক্তিপূর্ণ। আমরা সিআরবি ছাড়া অন্য যে কোনো স্থানে হাসপাতাল নির্মাণের পক্ষে।

লেখক: মুহাম্মদ মুসা খান, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী

পূর্বকোণ/সাফা/এএইচ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট