চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে হজের যেসব গুরুত্ব

সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন

১৭ জুলাই, ২০২১ | ১২:৫৫ পূর্বাহ্ণ

অত্রাঞ্চলের মুসলমানগণ নামাজসহ যাবতীয় এবাদত বন্দেগী পশ্চিম অভিমুখে করে থাকেন। কারণ হচ্ছে, কুরআনুল করীমে সূরা কুরাইশের ৩ নম্বর আয়াতে যে ঘরকে আল্লাহতা’আলা নিজের ঘর হিসাবে অভিহিত করেছেন এবং সূরা বাকারার ১২৫ নম্বর আয়াতে আমার ঘর বলে ঘোষণা দিয়েছেন সে মর্যাদাপূর্ণ পবিত্র আল্লাহর ঘর ‘বায়তুল্লাহ’ বিশ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে হওয়াতে ভৌগোলিকভাবে আমাদের পশ্চিমে অবস্থিত।

সারা জীবন যে পবিত্র ঘরের দিকে নামাজ বা অন্যান্য এবাদত আদায় করতে হয় সে ঘর দেখার অদম্য বাসনা মুসলমানদের অন্তরে সদা জাগরুক। একটু যদি ঘরখানা স্বচক্ষে দেখা যায়! এ যে বাসনা বা ইচ্ছা আভিধানিক অর্থে তাই হজ। ইসলামী পরিভাষায় যুলহিজ্বাহ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন হাদিস, তথা আল্লাহ ও রাসূল (দ.) এর নির্দেশ মুতাবিক নির্দিষ্ট সময়ে পবিত্র কাবা এবং কয়েকটি বিশেষ স্থানে যেমন- মিনা, আরাফাত, মুযদালিফাসহ ১৬ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে তাওয়াফ, সাঈ, জিয়ারাত এবং অবস্থান করাকে হজ বলে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত প্রিয় নবী (দ.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলাম পাঁচটি খুঁটির উপর প্রতিষ্ঠিত। ১. আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ বা উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ (দ.) আল্লাহর রাসূল এ সাক্ষ্য প্রদান। ২. নামাজ প্রতিষ্ঠা করা। ৩. রমযানুল মুবারকে রোজা রাখা। ৪. সামর্থ্য থাকলে হজব্রত পালন করা এবং ছাহিবে নিসাব হলে (পূর্ণ এক বৎসর সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রৌপ্যের মালিক) জাকাত আদায় করা।’ (সহীহ বুখারি ও মুসলিম) হজ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে সূরা বাকারার ১৯৬ নম্বর আয়াতে এসেছে ‘আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ ও ওমরা পূর্ণ করো।’ হজ ফরয হওয়ার বিষয়টি কুরআন, হাদিস এবং ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। সূরা আলে-ইমরানের ৯৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর যে ব্যক্তি সামর্থ্য রাখে, তার উপর আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এ ঘরের (বায়তুল্লাহ) হজ করা ফরয। কিন্তু যে ব্যক্তি তা মানে না, আল্লাহ সমগ্র সৃষ্টিজগত থেকে স্বয়ংসম্পূর্ণ।’

যাদের উপর হজ ফরয: যার নিকট মক্কা শরীফ থেকে হজ করে ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের অপরিহার্য খরচ ব্যতিরেকে মক্কা শরীফ যাতায়াত এবং তথায় খরচের মোটামুটি পরিমাণ অর্থ থাকে তার উপর হজ ফরয। প্রয়োজনাতিরিক্ত জমির মূল্য ও ব্যবসায়িক পণ্য এ অর্থের হিসাবে গণ্য হবে। মহিলাদের নিজ স্বামী অথবা নিজের কোন বিশ্বস্ত দ্বীনদার মাহরাম পুরুষ ছাড়া হজে যাওয়া বিধিসম্মত নয়। কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক হজ করলেও প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সামর্থ্য থাকলে পুনরায় হজ করতে হবে। দৃষ্টিশক্তিহীন কেউ ধনী হলেও তার উপর হজ ফরয নয়। একইভাবে গোলাম বা ক্রীতদাসের উপরও হজ ফরয নয়। হজ ফরয হওয়ার জন্য অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। কোন কাফির বা অবিশ্বাসীর উপর হজের বিধান প্রযোজ্য নয়। কারো আর্থিক সংগতি থাকা সত্বেও শারীরিক বা অন্য কোন কারণে হজ করতে না পারলে তিনি বদলি হজ করাবেন।

হজ তিন প্রকার; ১. হজে ইফরাদ: শুধুমাত্র হজ সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে ইহরাম পরিধান করে তালবিয়া পাঠ করা হচ্ছে হজে ইফরাদ। ২. হজে তামাত্তু: হজের মাসের প্রথমে ওমরা আদায় করে হালাক হয়ে ঘরে ফিরে পূনরায় হজের ইহরাম পরিধান করে হজ আদায় করলে হজে তামাত্তু হয়। ৩. হজে কিরান: একসঙ্গের হজ ও ওমরা পালনের নিয়তে ইহরাম পরিধান করাকে হজে কিরান বলে। প্রতিটি ক্ষেত্রে মী’কাতের বাইরে থেকে ইহরাম পরিধান করতে হবে। তবে ইফরাদের জন্য মক্কা শরীফে অবস্থানকারীগণ ওখান থেকেই ইহরাম পরিধান করবেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মাযহাব মতে হজে কিরান উত্তম। তবে হজে তামাত্তু কিছুটা সহজ হওয়াতে প্রায় বাংলাদেশী হাজীগণ হজে তামাত্তু করতে পছন্দ করেন।

নামাজ আদায়কারীর জন্য তাকবীরে তাহরিমার মাধ্যমে স্বাভাবিক অবস্থার অনেক হালাল ও বৈধ কাজ যেমন হারাম বা অবৈধ হয়ে যায়, ঠিক তেমনি ইহরামের মাধ্যমে হজ ও ওমরা পালনকারীর জন্যও স্বাভাবিক সময় বা অবস্থার অনেক হালাল কিংবা বৈধ কাজ হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই হজ ও ওমরার জন্য ইহরাম ফরয করা হয়েছে। ইহরাম শব্দটি এসেছে হারাম শব্দ থেকে, যার অর্থ কোন জিনিসকে নিজের উপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেয়া। এ ইহরামই হজের তিনটি ফরযের মধ্যে প্রথম ফরয। ইহরাম গ্রহণের পর পার্থিব কাজ-কর্ম যেমন- স্ত্রী সহবাস, পুরুষদের সেলাই করা পোশাক পরিধান, সুগন্ধি ব্যবহার, নখ, চুল, দাড়ি, গোঁফ ও শরীরের পশম কাটা বা ছেঁড়া, অন্যকে কষ্ট দেয়া ও শিকার করা নিষিদ্ধ হয়ে যায়।

তবে ক্ষতিকর প্রাণী মারা যাবে। এ সকল কাজের পাশাপাশি হজ ও ওমরা যেটি আদায়ের ইচ্ছা হবে তার নিয়ত করে উচ্চস্বরে (মহিলা হলে নিচু স্বরে) তিনবার তালবিয়া (লাব্বইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লা শারীকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারীকা লাকা—-) পাঠই হল ইহরাম।  বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘরের সম্মানার্থে হজ এবং ওমরা পালনকারীকে নিজ নিজ মীকাত থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়। ইহরাম ছাড়া মীকাত অতিক্রম করা নিষিদ্ধ। হজ বা ওমরা পালন করার জন্য বিনা ইহরামে যে স্থান অতিক্রম করার অনুমতি নেই তাই হচ্ছে মীকাত।

পৃথিবীর বিভিন্ন দিক থেকে আগত হজ যাত্রীদের জন্য ইসলামী শরিয়ত পাঁচটি নির্দিষ্ট স্থানকে মীকাত হিসাবে নির্ধারণ করেছে। ১. যুল হুলাইফা বা আবইয়ারে আলী: এটি মদিনাবাসী এবং মদিনার পথে আগমনকারী হজ যাত্রীদের মীকাত। ২. ইয়ালামলাম: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ থেকে জেদ্দা হয়ে মক্কায় প্রবেশের মীকাত। ৩. আল-জুহফা: সিরিয়া, মিশর এবং সে পথ ধরে আগমনকারী হাজীদের মীকাত, যার বর্তমান নাম রাগেব। ৪. কারনুল মানাজিল বা আসসাইলুল কাবীর! নজদ (রিয়াদ, আল ক্বাছিম, হাইল) থেকে আগতদের জন্য মীকাত। ৫. যাতু ইরক: ইরাক থেকে আগতদের মীকাত। উল্লেখ্য যে, যদি কেউ বিনা ইহরামে মীকাত অতিক্রম করে- তার জন্য দম বা কাফফারা দিতে হবে। তদুপরি গুনাহ হবে।

হজের দ্বিতীয় ফরয হচ্ছে উকুফে আরাফা বা আরাফাতের ময়দানে অবস্থান: ১০.৪ কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত আরাফার ময়দানের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে উঁচু ফলক দ্বারা। সীমানা অভ্যন্তরেই হাজীগণকে অবস্থান করতে হবে। অন্যথায় ফরয আদায় হবে না। যুলহিজ্বাহ মাসের ৯ তারিখ সূর্য হেলে পড়ার পর থেকে ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পূর্বপর্যন্ত যে কোন সময় আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করা ফরয। উল্লিখিত সময়ের মধ্যে যদি কেউ অল্প সময়ও অবস্থান করে তবুও হজের ফরয় আদায় হয়ে যাবে।

জোহরের নামাজের পূর্বে মসজিদুল হারামের প্রধান ইমাম বা খতীব আরাফাতে অবস্থিত মসজিদে নামিরার মিম্বর থেকে উপস্থিত হাজীগণ এবং বিশ্ব মুসলিমসম্প্রদায়ের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করেন, যাতে আল্লাহর কাছে দুনিয়ার কর্মকান্ডের জবাবদিহি করা, মুসলিমমিল্লাতের মধ্যে সংহতি জোরদার, নিজেদের সমৃদ্ধি আনয়ন সর্বোপরি বিশ্ব শান্তি ও কল্যাণের কথা জোর দিয়ে বলা হয়। অত:পর জোহর ও আসরের মধ্যবর্তী সময়ে জোহর ও আসরের কসর নামাজ জামাতে আদায় করা হয়। সূর্যাস্ত পর্যন্ত হাজী সাহেবান আরাফাতের ময়দানে অবস্থান করে এবাদত বন্দেগী, গুনাহ মাফ চাওয়া এবং আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকেন।

প্রতিদানে পরম দয়ালু আল্লাহ তা’আলা সে সকল হাজীদেরকে নিষ্পাপ ঘোষণা করেন। হাদিস শরীফে এসেছে ঐ দিন মহান আল্লাহ ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, “হে ফেরেশতাগণ তোমরা দেখ! আজ আমার বান্দারা বহুদূর থেকে সংকট মোকাবিলা করে এসে আরাফাতের ময়দানে ধূলাবালির সঙ্গে মিলিত হয়েছে। তোমরা সাক্ষী থাক, যারা আমার ঘর (কাবা) জিয়ারত করতে এসে এত কষ্ট স্বীকার করছে, অবশ্যই আমি তাদের পাপ সমূহ মার্জনা করে দিলাম।’ (সহীহ বুখারি) মুসলিম শরীফে এসেছে, ‘আরাফার দিন আল্লাহ এত অধিক নরকবাসীকে অগ্নি থেকে অব্যাহতি দেন, যা অন্য কোন দিবসে দেন না।’

হজের তৃতীয় ফরয তাওয়াফে জিয়ারাহ: এটি হজের গুরুত্বপূর্ণ আমল, যদি কেউ যুলহিজ্বাহ মাসের ১০ তারিখ সুবহে সাদিকের পর থেকে ১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্বে এ তাওয়াফ সম্পন্ন করে তাহলে ফরয আদায় হয়ে যাবে। এ তাওয়াফকে তাওয়াফে ইফাজাও বলে থাকে। আল্লাহর ঘর ‘বায়তুল্লাহ’ সম্বন্ধে সূরা আলে-ইমরানের ৯৬ নম্বর আয়াতে এসেছে, ‘অবশ্যই এ ঘর সর্বপ্রথম মানুষের জন্য নির্ধারিত হয়েছে, যে ঘর মক্কায় অবস্থিত এবং বিশ্বের মানুষের জন্য শুদ্ধ ও সঠিক পথনির্দেশক।’ এ ঘরকে কেন্দ্র করেই মুসলমানরা হজ ও ওমরার সময়ে ঘড়ির বিপরতি দিকে সাতবার প্রদক্ষিণ করে থাকেন, যা আরবীতে তাওয়াফ নামে পরিচিত। এ তাওয়াফ আরম্ভের পূর্বে হাজরে আসওয়াদে (কাল পাথর) চুমু দেয়া নিয়ম। তবে ভিড় থাকলে হাত দিয়ে ইশারা করে তাওয়াফ শুরু করতে হয়।

হাজীদের জন্য কিছু ওয়াজিব বা অবশ্য করণীয় আমল রয়েছে। যেমন- ১. ইহরাম বাঁধার কাজটি মীকাত পার হওয়ার পূর্বেই সম্পন্ন করা। ২. সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতের ময়দানে অবস্থান। ৩. কিরান এবং তামাত্তু হজ আদায়কারীর জন্য কংকর নিক্ষেপ ও মাথা মুস্তানের মধ্যবর্তী সময়ে কোরবানি সম্পন্ন করা। ৪. সাফা মারওয়া পাহাড়ে সাঈ করা (সাঈ সাফা থেকে শুরু করা)। ৫. মুযদালিফায় রাত্রি যাপন। ৬. তাওয়াফে জিয়ারাত আইয়্যামে নহরের (১২ তারিখ সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত) মধ্যে সম্পন্ন করা। ৭. শয়তানকে কংকর নিক্ষেপ (রমি) করা। ৮.মাথা মুস্তন বা চুল ছোট (কংকর নিক্ষেপের পর) করা। ৯. মীকাতের বাইরের লোকদের জন্য বিদায়ী তাওয়াফ করা। অতি জরুরী বিষয়টি হচ্ছে, হজ্বের ওয়াজিব ছুটে গেলে দম বা কাফফারা দিতে হবে (পশু কোরবানি)। কিন্তু কোন ফরয ছুটে গেলে পুনরায় হজ্ব করতে হবে।

লেখক: সৈয়দ মুহাম্মদ জুলকরনাইন, রাজনীতিক, প্রাবন্ধিক।

পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট