চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

করোনার অভিঘাত : জ্ঞানের ফেরিওয়ালা যখন ভ্যানওয়ালা

মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন

৬ জুলাই, ২০২১ | ৮:১১ অপরাহ্ণ

একজন মহান শিক্ষকের কাজ একজন স্থপতি বা শিল্পীর কাজের চেয়েও অধিক তাৎপর্যমন্ডিত। কারণ একজন শিক্ষকের কাছে তৈরি হচ্ছে শিল্পী, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, ডাক্তার, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনায়ক, কবি, সাহিত্যিক, কৃষিবিদসহ দেশ পরিচালনার মহান মানুষ। এই হিসাবে একজন শিক্ষকের মূল্য শুধু তার এই ‘সৃষ্টির সন্মান’।

শিক্ষককে তাই শিক্ষাবোদ্ধারা আখ্যায়িত করেছেন, ‘জাতির মহান কান্ডারী হিসাবে।’ তাই পেশা হিসাবে শিক্ষাকে অবশ্যই গুরু দায়িত্ব, জাতীয় দায়িত্ব হিসাবে মনে করতে হবে। এখানে ফাঁকির কোন সুযোগ বা স্থান নাই। আছে শুধু সুন্দর আগামীর প্রত্যাশায় কাজ করার মহান দায়িত্ববোধ। আর এই বিষয়টি আমাদের মধ্য থেকে যারা এই পেশায় এসেছেন তাদের উপলব্দি করা দরকার। এই উপলব্দি নাই বলে আমাদের শিক্ষার এমন আত্মসমর্পন ।

শিক্ষাবিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞরা শুধু বছর বছর শিক্ষাক্রম পরিবর্তনের কাজে মনোযোগী হয়েছেন। কিন্তু তারা কখনও উপলব্দি করেনি যে, একজন শিক্ষক মানে একটি শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক যদি শিক্ষাব্যবস্থা হন-তাহলে জাতি হিসাবে আমরা এগুতে পারব। করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছুটি শুরু ১৭ মার্চ ২০২০ সেই হিসেবে ১ বছর ৩ মাসের অধিককাল। এই সময়ে বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। অনেকেই বলেন কিন্ডারগার্টেন বন্ধ হয়েছে! বিষয়টি সঠিক নয়।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয় হয়ত বন্ধ হয়নি কিন্তু শিক্ষকদের পাওনা দিতে পারছেন না। বহু এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের খণ্ডকালীন শিক্ষক ছিলেন যারা এই আয় দিয়েই সংসার চালাতেন তারা আজ কি করছেন? লকডাউন নামক আধেক খোলা আর আধেক বন্ধের যে কাহিনী! এই কাহিনী শিক্ষকদের মত কত মানুষকে পথে বসিয়েছে সরকার খবর নিয়েছেন? নেননি। নেয়ার সময় বা কোথায়। যে দেশে করোনার কারণে না খেয়ে পথে বসছে অনেকেই! সেই দেশের সংসদে এখনও রাষ্ট্রপ্রধান বিরোধীদলের নামের বাহাস নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। সেই দেশে অন্যখবর নেয়ার সুযোগ বা কতটুকুন।

শিক্ষকরা যুগে যুগে অভুক্ত ছিলেন। অভুক্ত রেখে আমরা শিক্ষকদের হাতে গড়ে তুলতে চাইছি সমৃদ্ধ জাতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে দুই ধরনের শিক্ষক থাকেন। একধরন এমপিওভুক্ত। যাদের ভাগ্যবান শিক্ষক হিসাবেই অবিহিত করা হয়। এই ভাগ্যবান শিক্ষকরা তাদের সকল বেতন-ভাতা এবং তিনটি উৎসব ভাতাও পেয়েছেন বিগত বছরে। আর আয়েশি জীবন তো আছেই। তবে তাদেরও অনেকের অবস্থা ভাল নয়, যাদের অধিক খরচ। কারণ তাদের  প্রাইভেট বন্ধ হয়ে গেছে। আরেক ধরনের হলেন, নন এমপিও- যাদের হতভাগাই বলা চলে। এই হতভাগারা গত একবছরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হতে কোন বেতন পাননি। তাদের কথা একবার ভাবুন তো। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। আর অপরদিকে বেসরকারি বা কিন্ডারগার্টেন শিক্ষকদের কথা তো আন্দাজ করা যায়। তাদের অবস্থা এখন শেষপর্যায়ে।

যশোর মহিলা কলেজের ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক শরিফুল ইসলাম। ২০১৫ সাল থেকে তিনি এই কলেজের বৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত একজন শিক্ষক। কিন্তু তিনি নন-এমপিও। যারফলে কলেজ থেকে সামান্য বেতন পেতেন, যা দিয়ে জোড়াতালির সংসার। গত ৫ মাস ধরে তিনি কলেজ থেকে সেই বেতনও পান না। এতদিন লোকলজ্জার ভয়ে বিষয়টি গোপন রেখে কোনভাবে দিন কাটাচ্ছিলেন। অবশেষে নিরুপায় হয়ে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। এই স্ট্যাটাস পড়ে ক্ষমতাসীনদের কতটা নিজেকে দেখার সুযোগ হবে জানি না, তবে বিবেকবান যেকোন মানুষের মন ও চোখের পানি ধরে রাখা সম্ভব নয়। কথা হয়। কত অনলাইন মিটিং উদ্বোধন একবছরে দেখলাম। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন কথা বলেন, একটি বারও এই শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে একটি শব্দ উচ্চারণ করতেও শুনিনি। কেন এই নিরবতা? কেন এমন তাচ্ছিল্য! বড় অসহায় মনে হয়।

শরিফুল ইসলাম তার নিজের নয় শুধু, সমগ্র বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে পুরো শিক্ষকসমাজের যে অবস্থা তা তুলে এনেছেন। করোনা শুধু শিক্ষক নন কতশত মানুষের দিনের রোজকার এভাবে পথে বসিয়েছে সেই খবর রাখেন কিনা সরকার তা জানা নেই। এইদেশে শিক্ষক সমাজের এমন অবস্থার খবর নেয়ার সময় কারো কি নাই? নাই। বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এখন বেকার বা অর্ধবেকার। বেকার বা অর্ধবেকারের এই শহরে শরিফুলরা আর পারছে না! তারা অসহায়।

এমন অবস্থার মধ্যে কি হাস্যকর! অর্থমন্ত্রী গবেষকরা বেকারের যে চিত্র তুলে এনেছেন সেই বেকারদের নাম ঠিকানা চেয়েছেন। অর্থমন্ত্রী একজন শরিফুল তার নাম ঠিকানা আপনাকে দিয়ে দিলেন! খোঁজ নিয়েছেন? নেননি। নিলে তো তাবৎ দুনিয়ায় তা খবর হয়ে যেত। আপনার এলাকার এই জাতীয় শিক্ষক যারা রয়েছেন তাদের নাম ঠিকানাও কি গবেষকদের দিতে হবে? তাদের অবস্থা কি? একটু সময় করে খবর নিবেন। দীর্ঘদিন বিশেষত করোনাকালীন সময়ে অনলাইনে নানা আলোচনা অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া ও একটি অনুষ্ঠান ধারাবাহিক পরিচালনা করতে গিয়ে আমি দেখেছি নিজ চোখে শিক্ষকরা কেমন আছেন? মোটেই ভাল নেই।

তারা সত্যি ভালো নেই। একজন শিক্ষক বেতন পান না। যার একমাত্র আয় ছিল এই বেতনটাই। ভাবুন তো কিভাবে সংসার চলে? চলে না। ঘরভাড়া দিতে পারেন না। সংসার চলে না। আহ! কি কঠিন সময়। অপরদিকে কিন্ডারগার্টেন বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ভাড়াবাসায় চলে। শিক্ষার্থীরা বেতন দেন না। বাসাভাড়া দেয়া যাচ্ছে না, শিক্ষককে কিভাবে দিবে? এই ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ৬৫ হাজারের বেশি। ১২ লক্ষের অধিক মানুষের জীবন ও জীবিকা এ খাতের উপর নির্ভরশীল ছিল। একটু ভাবুন তো কি এক অবস্থা।

শিক্ষকরা কচু বিক্রেতা, রিক্সাচালক, ভ্যানের ড্রাইভার, চা-বিক্রেতা থেকে এমন কোন পেশা নাই তারা বেছে নেননি। এমন অবস্থা একদিনে তৈরি হয়নি।  জ্ঞানের ফেরিওয়ালারা এখন ভ্যানওয়ালা। একসময় যারা সামান্য বেতনে জ্ঞানের ফেরি করে বেড়াতেন এখন তারা ভ্যানে করে তরকারি, মাছ, চা, ডিম, সবজি ফেরি করে বেড়ান। এই হল আমাদের উন্নয়ন। সংবাদ মাধ্যম বিশেষত বিটিভির নিউজ দেখলে যেখানে উন্নয়নের জোয়ার চোখে পড়ে, মনে হয় ইউরোপ বা উন্নত কোন রাষ্ট্রের নাগরিক। আহ! কি সুবাতাস। সেখানে এই সব অভুক্ত শিক্ষক, যারা এভাবে পাড়ায় মহল্লায় তরকারি, সবজি আর চা ফেরি করে বেড়াচ্ছেন, তাদের খবর দেয়ার বা নেয়ার মানুষটিও যেন হারিয়ে গেছেন।

অর্থমন্ত্রী তালিকা চাইবেন তারপরও? তালিকার পর তালিকা দিলেও শেষ হবে না। কর্মহীন, উপার্জনহীন পথে বসা এ শিক্ষকদের খবর না নেয়ার মধ্য দিয়েই একটি জাতি কতটা পেছনে পড়ছে সেই বিষয়টি ভাবনায় আনবার মত সময় এখনও হয়নি। বহুদিন হয়ত অপেক্ষাও করতে হবে না। অতি অল্প সময়ের মধ্যে আমরা দেখতে পাব রুচিশীল, একটু জানা মানুষজন আর শিক্ষকতায় আসবেন না। আর যোগ্য অভিজ্ঞ যেসকল সম্মানিত শিক্ষক এমন পরিস্থিতে পড়েছেন তারাও আর পূর্বের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষকতায় ফিরে আসবেন না।

একটু সম্মান নিয়ে জীবন পরিচালনার নিয়তে যারা শিক্ষকতার মত মহান পেশাকে বেছে নিয়েছিলেন তারা তো এখন নিজেই বাছেন না! কেন এমন জায়গায় ফিরে আসবেন? তাহলে দীর্ঘমেয়াদে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা সংকটে পড়বে সেটি কোন গ্লাস ছাড়াই অনুমান করা যায়। তবে যাদের সামনে ক্ষমতার আয়না পড়ে আছে, তারা হয়ত ক্ষমতা ছাড়া বেশিকিছু দেখার সুযোগ পাবেন না। কিন্তু মানুষের কাতারে আসতে হলে সেই আয়না সরাতে হবে। আবারও বলি, শিক্ষকসমাজকে অভুক্ত রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে উন্নত করার স্বপ্ন কোনদিই আলো দেখবে না। অতীত অভিজ্ঞতা আমাদের সেই বার্তাই দেয়।

লেখক: মুহাম্মদ কামাল উদ্দিন শিক্ষাবিদ-নজরুল গবেষক।
পূর্বকোণ/সাফা/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট