চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

মো. মোরশেদুল ইসলাম

২২ জুন, ২০২১ | ৮:২৭ অপরাহ্ণ

যে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল শূন্য হাতে সেই বাংলাদেশ এখন মহাশূন্যে উপগ্রহ পাঠায়, নিজস্ব অর্থে পদ্মা সেতু বানায়। ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে যে দেশটি যাত্রা শুরু করেছিল, অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সেই বাংলাদেশ এখন বিশ্বের চোখে এক বিস্ময়। এই কৃতিত্বের দাবিদার বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। কারণ তাঁর নেতৃত্ব না হলে এই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া সম্ভব হতো না। শেখ হাসিনা এখন শুধু একজন প্রধানমন্ত্রী নন, তিনি একজন বিশ্বনন্দিত রাষ্ট্রনায়ক। 

স্বাধীনতার পর থেকে অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বিদেশিদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল একটি তলাবিহীন ঝুড়ি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর পূর্বমুহূর্তেই জাতিসংঘের ‘কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি’ বাংলাদেশকে ‘এলডিসি’র তালিকা থেকে বের হওয়ার সুপারিশ করেছে। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ। পাকিস্তানের গড় মাথাপিছু আয় বর্তমানে যেখানে ১১৭০ ডলার, পক্ষান্তরে বাংলাদেশে এটা ২০৬৪ ডলার। সাম্প্রতিক করোনা অতিমারিকালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ০.৪ শতাংশ, পক্ষান্তরে বাংলাদেশে এটা ৫.২ শতাংশ।

পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ২০.৮ বিলিয়ন ডলার, আর বাংলাদেশে এটা ৪২ বিলিয়ন ডলার। কোনো কোনো সামাজিক সূচকে আমরা ভারতকেও ইতিমধ্যে ছাড়িয়ে গেছি (যেমন: প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুহার, স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগারের সংখ্যা, অর্থনীতিতে প্রান্তিক নারীদের অংশগ্রহণ ইত্যাদি)। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭২ সালে। সে সময় প্রায় প্রতিটি সূচকেই এগিয়ে ছিল ভারত ও পাকিস্তান। এখন এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এটিই বাংলাদেশের স্বাধীনতার বড় অর্জন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অর্মত্য সেনের মতে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। যে কোনো দেশের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ধরা হয় মানবসম্পদ উন্নয়ন। এক্ষেত্রেও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে সমুদ্রসীমাবিরোধ নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে প্রথমে মিয়ানমার এবং পরে ২০১৪ সালে ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। এতে ১ লক্ষ ১৮ হাজার ১৮৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র এলাকার ওপর আমাদের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে চট্টগ্রাম উপকূল হতে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সকল প্রকার প্রাণিজ ও খনিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশ একচ্ছত্র মালিকানা লাভ করেছে। যার মাধ্যমে ব্লু ইকোনোমির দ্বার খুলে গেছে।

এখন বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে উন্নত দেশ হওয়ার। উন্নত দেশে রূপান্তরিত হতে কাজ চলছে ১০ মেগা প্রকল্পের। প্রকল্পসমূহ হলো: পদ্মা সেতু প্রকল্প, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র, মেট্রোরেল প্রকল্প, এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, পায়রা বন্দর নির্মাণ, পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ, চট্টগ্রাম-ঢাকা ডাবল রেল লাইন, চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন, বঙ্গবন্ধু টানেল। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ এওয়ার্ডে। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে দেশের ৪৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল।

কৃষিক্ষেত্রে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যোর জন্য বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বাংলাদেশ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং আবিষ্কার করেছেন। সমগ্র বিশ্বে ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে, যার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন ৩টি। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে সফলতার সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের পাশাপাশি আবাসন, জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যশিল্পের প্রসার ঘটেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় যোগ হয়েছে জাহাজ, ওষুধ এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যসামগ্রী।

বর্তমান বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের স্থান। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই প্রথম ই-পাসপোর্ট চালু হয়। ভূমি ব্যবস্থাপনাকে আধুনিকায়ন করতে ৫৫টি জেলায় বিদ্যমান মৌজা ম্যাপ ও খতিয়ান কম্পিউটারাইজেশনের কাজ সম্পন্ন করার কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। মন্দার প্রকোপে বৈশ্বিক অর্থনীতি যখন বিপর্যস্ত ছিল বাংলাদেশ তখন বিভিন্ন উপযুক্ত প্রণোদনা প্যাকেজ ও নীতি সহায়তার মাধ্যমে মন্দা মোকাবিলায় সক্ষমই হয়নি, জাতীয় প্রবৃদ্ধির হার গড়ে ৬ শতাংশের বেশি বজায় রাখতে সক্ষম হয়। বিখ্যাত সম্পদব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস ১১টি উদীয়মান দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ রয়েছে এ তালিকায়। ১০ লাখেরও অধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থায় চালকের আসনে অবস্থান করে নিয়েছে। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পাশাপাশি বিমসটেক, ডি-৮, ওআইসি, ন্যামসহ বিভিন্ন ফোরামে ভূমিকা রাখছে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বিজয় অর্জন আমাদের জন্য সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে দিয়েছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষার প্রসার, নারী উন্নয়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুরহার কমানোসহ বিভিন্নক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে এগিয়ে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। জাতিসংঘ বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, মহেশখালীতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরসহ সারাদেশে ১০০টি অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি ঘরে এখন বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে। ধান, ফল, মাছ উৎপাদনে বিস্ময়কর সাফল্য এসেছে। শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে অবস্থান করে নিয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবতায় রূপ দিয়ে বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। কৃষিখাতে অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য বিশ্বদরবারে বারবার আলোচিত হয়েছে। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সমগ্র বিশ্বের নিকট প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্রঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র দূরীকরণে সাফল্য, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমগ্র বিশ্ব এখন বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ গণ্য করছে।

২০২০ সালের সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৪১তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। এখন যে ধরনের অর্থনৈতিক বিকাশের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনোমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের ওয়ার্ল্ড লিগ টেবিল ২০২১ রিপোর্টে। রিপোর্ট অনুযায়ী উন্নয়নের চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগামী ১৫ বছর পর বিশ্বের ১৯৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান হবে ২৫তম। উন্নয়ন গবেষকরা আজকের বাংলাদেশকে ‘উন্নয়নের রোল মডেল’, দক্ষিণ এশিয়ার ‘তেজি ষাঁড়’, অফুরন্ত সম্ভাবনার এক বাংলাদেশ’সহ নানা অভিধায় ভূষিত করেছেন। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এসে আমরা বিশ্বসভায় অন্য এক মর্যাদাপূর্ণ বাংলাদেশকে দেখতে পেয়েছি। বর্তমান সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়া।

উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশের যে অগ্রগতি তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি ঘোষণা করেছিলেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়ে এদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তর করবেন। সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি ও তাদের জীবনমানের উন্নতির জন্য তিনি আমৃত্যু সংগ্রাম করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুকন্যার সুযোগ্য নেতৃত্ব, কূটনৈতিক দক্ষতা ও নিরলস প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ আজ সত্যিকারঅর্থেই ইতিহাসের স্বর্ণযুগে।

মো. মোরশেদুল আলম সহকারী অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ/পারভেজ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট