চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

মিয়ানমারের বিকল্প সরকারের রোহিঙ্গা-ভাবনা

 অধ্যাপক শাব্বির আহমদ  

১০ জুন, ২০২১ | ২:২৪ অপরাহ্ণ

সামরিক জান্তাকে উৎখাত করে ক্ষমতায় যেতে পারলে বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সসম্মানে ফিরিয়ে নেয়া এবং তাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে মায়ানমারের সামরিক জান্তা বিরোধী ছায়া সরকার। আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা এএফপি, আলজাজিরাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম জানিয়েছে, গত ৪ জুন মায়ানমারের জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্য সরকার তাদের সম্ভাব্য সংখ্যালঘুনীতি নিয়ে তিন পৃষ্ঠার এক বিবৃতি প্রকাশ করেছে। এতে সামরিক জান্তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে রোহিঙ্গাদের সাহায্য প্রার্থনা করা হয়েছে। পাশাপাশি, দেশটিতে বিদ্যমান ১৯৮২ সালের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে মিয়ানমারে জন্ম নেয়া বা বিশ্বের যেকোনো স্থানে জন্ম নেয়া মায়ানমার নাগরিকদের সন্তানদের পূর্ণ নাগরিকত্ব দানের অঙ্গীকার করেছে।

গত ১ ফেব্রুয়ারি মায়ানমারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির এনএলডি (ন্যাশনাল লি ফর ডেমোক্র্যাসি) সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে দেশটির সামরিক বাহিনী। এর পরপরই জান্তাবিরোধী বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে মায়ানমার। বিক্ষোভ দমনে চড়াও হয় সামরিক সরকারও। এতে এ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন আট শতাধিক মানুষ, বন্দি করা হয়েছে কয়েক হাজার। এ অবস্থায় জান্তাকে অবৈধ ঘোষণা দিয়ে একটি ছায়া সরকার গড়ে তোলেন মায়ানমারের রাজনীতিবিদরা, যার বেশিরভাগ সদস্যই এনএলডির। জাতীয় ঐক্য সরকার (এনইউজি) নাম দিয়ে এটিকেই মায়ানমারের বৈধ সরকার বলে দাবি করেন তারা। বিবৃতিতে ছায়া সরকার বলেছে, ‘আমরা রোহিঙ্গাদের জান্তাবিরোধী চলমান লড়াইয়ে অংশ নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’ বিশ্লেষকদের মতে, বিবৃতিতে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি ব্যবহার করা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।

সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতায় থাকাকালে সু চির গণতান্ত্রিক সরকার রোহিঙ্গাদের ফেরাতে কখনোই আন্তরিক ছিল না। কার্যত, তারা ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটিই ব্যবহার করত না, এদের ‘রাখাইনে বসবাসকারী মুসলিম’ বলে উল্লেখ করতেন সু চি সরকারের নেতারা। সামরিক জান্তার মনোরঞ্জনের জন্য হোক, কিংবা জনসমর্থন আদায়ের জন্য হোক, নোবেল বিজয়ী সু চি রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিম গণহত্যাকে সমর্থন দিয়েই ক্ষান্ত থাকেননি, গাম্বিয়াতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেনাবাহিনীর হয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে অস্বীকার করে নিজের সবক’টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার পর্যন্ত খুইয়েছেন তিনি।

তবে সামরিক বাহিনীর হাতে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে চোখ খুলেছে সুচির দলের নেতাদের একাংশের। এনইউজির বিবৃতিতে তারা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর ‘গুন্ডা’ সামরিক বাহিনীর সহিংসতা ও চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং গত কয়েক দশক ধরে রাখাইনে চলা সহিংসতায় লাখ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হওয়ার বিষয়টি খুব ভালোভাবে বুঝে জাতীয় ঐক্য সরকার। আমরা এর জন্য গভীরভাব দুঃখিত। আজ সামরিক বাহিনীর নৃশংসতার শিকার মায়ানমারের সকল মানুষ রোহিঙ্গাদের দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিশীল। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইতিহাসজুড়ে রোহিঙ্গাসহ মায়ানমারের সকল মানুষের ওপর সামরিক বাহিনী যেসব অপরাধ করেছে, আমরা তার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি চাইব। রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মায়ানমারে সংঘটিত অপরাধের বিষয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের এখতিয়ার প্রদানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। এছাড়া, মায়ানমারে জাতীয় কার্ড ভেরিফিকেশন পদ্ধতিও বিলুপ্ত করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এনইউজি। দেশটির প্রশাসন এর মাধ্যমেই রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি নাগরিক’ বলে উল্লেখ করেছিল। এসবের পাশাপাশি বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ‘স্বেচ্ছা, নিরাপদ ও সসম্মানে প্রত্যবাসন’-এ হওয়া চুক্তিগুলোর প্রতি পুনঃসমর্থন জানিয়েছে এনইউজি। এ বিষয়ে সকল পক্ষকে পূর্ণ সহায়তা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে মায়ানমারের এ ছায়া সরকার।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তরফ থেকে অনেক চাপ সত্ত্বেও সামরিক জান্তার পাশাপাশি মায়ানমারের যে রাজনীতিকরা রোহিঙ্গাদের অধিকারের বিন্দুমাত্র স্বীকৃতি দিতে রাজী হয়নি এতোদিন, হঠাৎ করে তাদের অবস্থানে নাটকীয় পরিবর্তন বেশ বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে আন্তর্জাতিক রাজনীতির অঙ্গনে। এই ঘোষণাটিকে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ হিসেবে দেখছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। রোহিঙ্গাদের অধিকারের পক্ষে সোচ্চার বিভিন্ন সংগঠনও এটিকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে তাদের অবস্থান কতটা আন্তরিক অথবা রোহিঙ্গাদের অধিকারের পূর্ণাঙ্গ স্বীকৃতি এই ঘোষণায় আছে কিনা- তা নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়ে গেলেও এই ঘোষণাকে যুগ যুগ ধরে নির্যাতিত-নিপীড়িত ও বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বড় অর্জন বলে মনে করেন অনেক রাজনীতি বিশ্লেষক।

১৪৩০-১৭৮৪ সাল পর্যন্ত স্বাধীন থাকা আরাকানের অধিবাসী রোহিঙ্গারা যে সেখানকারই ভূমিপুত্র তা ইতিহাস কর্তৃক নির্ধারিত। ১৩ হাজার ৫৪০ বর্গমাইল আয়তনের এই প্রদেশেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ও তাদের পরিচয়কে ঘিরে রাজনীতি ও সভ্যতা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আবর্তিত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে; এমনকি স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়; আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানি মুসলমানের বংশধর। আর ঐ মধ্যযুগেই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলাওল – আরাকান রাজসভায় অমাত্য (মন্ত্রী) হিসেবে স্থান পান।

তিনি পদ্মাবতী, সয়ফুলমুলুক ও বদিউজ্জামালসহ আরো বেশকিছু কাব্যগ্রন্থ লিখেছিলেন। ১৭৮৫ সালে মায়ানমার কর্তৃক আরাকানের করদ রাজ্যে পরিণত হওয়া, ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ শাসন থেকে বার্মার স্বাধীনতা এবং ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের ক্ষমতা দখল সবকিছুই রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রতি নির্যাতন, বঞ্চনা উত্তরোত্তর বাড়িয়ে দিয়েছে। সর্বশেষ ১৫ অক্টোবর ১৯৮২ মায়ানমার সরকার যে নাগরিকত্ব আইন প্রকাশ করে সেখানে ১৩৫টি গোত্র নাগরিকত্ব লাভ করলেও রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করা হয়। উল্লেখ্য, জেনারেল নে উইনের আমলে রোহিঙ্গা ছাড়াও অন্যান্য ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপরও চালানো হয় অবিশ্বাস্য ধরনের নিপীড়ন।

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদে রাখাইন জনগোষ্ঠীর লোকেরা মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও এরা মায়ানমারের মূল জনগোষ্ঠী নয়, মূল জনগোষ্ঠীর নাম বর্মী, এরা মূল জনসংখ্যার আশি শতাংশ। এছাড়াও শান, কাচিন, কারেন, কায়ান প্রভৃতি জনগোষ্ঠীর আছে সেখানে, রয়েছে তাদের সশস্ত্র সংগঠনও। তাদের সবার সাথেই বর্মীদের একটা বিরোধ আছে। তবে রাখাইনরা রোহিঙ্গা মুসলিম খেদাও আন্দোলনে বর্মী সরকারের অত্যন্ত আস্থাভাজন। এটাও ঠিক, পুরো মায়ানমার জুড়েই রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে এমন মনোভাব ক্রিয়াশীল, তারা বাংলাদেশের লোক। ফলে বর্মী সরকারের বিরুদ্ধ সশস্ত্র আন্দোলন জড়িত থাকলেও কোন সময় কোনো বিদ্রোহী গ্রুপ রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল এমন নজির নেই। রাখাইনরা শুধু মুসলমানদের ওপরই অত্যাচার করে, তা নয়। হিন্দুরাও তাদের নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হিন্দুদের বলে ‘কালা’ আর মুসলিম রোহিঙ্গাদের বলে ‘চাটগাইয়্যা’। ২০১৭ সালে মুসলিম রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি হিন্দুরা রোহিঙ্গাও নিপীড়নের শিকার হয়।

আরাকানের রোহিঙ্গারা স্বকীয়তা নিয়ে নিজেদের পিতৃভূমিতে ঠিকে থাকার চেষ্টা কম করেনি, কিন্তু কোন প্রচেষ্টাই কাজে আসেনি। ২য় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে রাখাইন আর বর্মীদের সমর্থনে জাপান ব্রিটিশদের হাত থেকে১৯৪২ সালে মিয়ানমার দখল করে নিলে রোহিঙ্গারা জাপানীদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশদের পক্ষে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নেয়। ১৯৪৫ সালে মিয়ানমার আবার ব্রিটিশদের হাতে আসলেও ১৯৪৭ সালে ভারত- পাকিস্তানের স্বাধীনতা প্রদানের এক বছর পর ১৯৪৮ সালে বৃটেন বার্মাকে স্বাধীনতা প্রদান করলে রোহিঙ্গা চরম বেকায়দায় পড়ে।

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান বিভক্তিকালে আরাকানের রোহিঙ্গা নেতারা ‘আরাকান মুসলিম লীগ’ গঠন করে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত হওয়ার জন্য চেষ্টা করেন। তারা তৎকালীন মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে করাচিতে দেখাও করেন। কিন্তু জিন্নাহ্ধসঢ়; এ বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেননি। তিনি তখন দেশ বিভক্তি নিয়ে বেজায় ব্যস্ত। তিনি আরাকানের মুসলমান নেতাদের বলেন, আমরা নতুন ঝামেলার মধ্যে যেতে পারব না, ব্রিটিশ সরকারের নেতাদের গিয়ে বলুন। ব্রিটিশ কর্মকর্তারাও রোহিঙ্গা মুসলমান নেতাদের দাবিকে গুরুত্ব দেননি।

মুসলিম লীগের সমর্থন না পেয়ে ১৯৫০ সালের দিকে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ‘রোহিঙ্গা মুজাহিদিন ফোর্স’ গঠন করে আরাকানকে স্বাধীন করতে সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইনের সামরিক সরকার মায়ানমারের ক্ষমতায় এসে রোহিঙ্গাদের স্বাধীনতা আন্দোলন কঠোরহস্তে দমন করে। পরে ‘আরএসও’ ‘আরসা’ নামে একাধিক সশস্ত্র সংগঠন গড়ে উঠলেও পারস্পরিক আস্থা ও বুঝাপড়ার অভাবে বেশিদূর এগোতে পারেনি।

যাই হোক, রোহিঙ্গা মুসলিমদের উপর অতীতে একাধিকবার গণহত্যা ও শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করলেও ২০১৭ সালের গণহত্যা ও শুদ্ধি অভিযানটি ছিল নজিরবিহীন। মায়ানমার সামরিক বাহিনীর ব্যাপক গণহত্যা ও নির্যাতনের মুখে দশ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এদের ফেরত পাঠাতে মায়ানমারের জান্তা সরকারের চেয়ে ঐক্য সরকারকেই বাংলাদেশের সমর্থন করা উচিত বলে মনে করেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। অনেক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক মনে করেন, ঢাকা আপাতত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মায়ানমারের জান্তার সঙ্গে চলমান ঢিলেঢালা আলোচনা অব্যাহত রাখতেই পারে। তবে একথা মনে রাখা উচিত, এই প্রচেষ্টার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। পর্দার আড়ালে বাংলাদেশকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের পূর্ণ অধিকারের বিনিময়ে স্বীকৃতি দেয়া নিয়ে এনইউজির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। কারণ, দিন যতই গড়াচ্ছে মায়ানমারের সামরিক জান্তার পায়ের নিচে মাটি ততই সরে যাচ্ছে।

লেখক: অধ্যাপক শাব্বির আহমদ, কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষক।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট