চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে সমন্বিত উদ্যোগ

মো. মনজুরুল কিবরীয়া

৬ জুন, ২০২১ | ৩:০১ অপরাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এই পাহাড়ি ঢল না আসলে প্রজনন ক্ষেত্রে মা মাছ ডিম ছাড়ে না। স্বাভাবিক ভাবে এই পাহাড়ি ঢলের পানি তামাকের বিষাক্ততা নিয়ে আসলে মা মাছ ডিম ছাড়বে না। ২০১৬ সালে তাই ঘটেছিল।

মানিকছড়ি এলাকার হালদার চরের কৃষকদের তামাক চাষ থেকে মূলধারার কৃষি কাজে ফেরত আনতে না পারলে হালদা নদীর প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ব্যবহৃত হবে- এজন্য প্রয়োজন বিকল্প জীবিকায়ন ও সচেতনতা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি’ একটি বেইজ লাইন স্টাডি করে তামাক চাষিদের তালিকাসহ কিছু সুপারিশমালা প্রণয়ন করে। এই সুপারিশমালার ভিত্তিতে এগিয়ে আসলেন আইডিএফ এবং পিকেএসএফ। দুই সংস্থাকে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন মানিকছড়ি উপজেলা প্রশাসন। ২০১৮ সাল থেকে মানিকছড়ি এলাকার পরিবেশ বিবেচনা করে এবং চাষিদের চাহিদার ভিত্তিতে প্রায় ১৫০ জন তামাক চাষিকে উচ্চ ফলনশীল সবজি বীজ, সার, ফল বাগান সৃজনে জন্য ফলদ গাছ এবং মাছ চাষের জন্য হালদার পোনা সরবরাহ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি সাথে যৌথভাবে সচেতনতা প্রোগ্রামসহ বিকল্প জীবিকায়নের মাধ্যমে ২০২০ সালে দীর্ঘ দুই বছর কাজ করে প্রায় সকল তামাক চাষিকে মুল ধারার কৃষি কাজে ফেরত আনা সক্ষম হয়।

হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্লান্টের কার্যক্রম বন্ধ : বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের অধীন হাটহাজারী ১০০ মেগাওয়াট পিকিং বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ২০১২ সালে হাটহাজারী উপজেলা সদরে স্থাপন করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পরিবেশগত ছাড়পত্রবিহীন ও ইটিপি নির্মাণ ব্যতিরেকে পিকিং পাওয়ার প্লান্টটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে এসেছে। লাল শ্রেণিভুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে দৈনিক প্রায় ২৫ ঘনমিটার তরলবর্জ্য সৃষ্টি হয়। এইচএফও (ঐবধাু ঋঁবষ ঙরষ) দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনার ফলে সৃষ্ট অপরিশোধিত তেলমিশ্রিত তরলবর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে বৃষ্টির পানির সাথে মিশে পার্শ¦বর্তী মরা ছড়া খাল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে হালদা নদীতে পতিত হয়ে মারাত্মক দূষণ করে আসছে। হালদা সংশ্লিষ্ট সকলের অভিযোগের প্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক পিকিং বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দূষণমুক্ত রাখার জন্য বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনাসহ একাধিকবার জরিমানা করা হয়।

ইটিপি স্থাপন না করে এইচএফও দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা এবং হালদা নদী দূষণের কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ২০১২ সালের ২০ মে প্রথম দশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এর পরেও প্রতিষ্ঠানটি কোন রকম পরিবেশ দূষণের বিষয়টি তোয়াক্ষা না করে উৎপাদন চালিয়ে যেতে থাকে। ২০১৯ সালের ১৪ জুন হালদা নদীতে ব্যাপক হারে মাছ মারা যাওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক সরেজমিন পরিদর্শন করে ইটিপি নির্মাণ কার্যক্রম সম্পন্ন না করা, অয়েল ওয়াটার সেপারেটর কার্যকর না থাকা, অভ্যন্তরীণ ড্রেনে তরলবর্জের ফলাফল পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা, ১৯৯৭ অনুসারে গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার বাহিরে থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে আবারও বিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয় এবং সেইসাথে ইটিপি নির্মাণ সম্পন্ন এবং ওয়েল ওয়াটার সেপারেটর কার্যকর না করা পর্যন্ত উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। উপরোক্ত শর্ত পূরণ না করায় বর্তমানে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকায় হালদা নদী ২০২০ সালে ফার্নেস অয়েল দ্বারা দূষণমুক্ত আছে।

এশিয়ান পেপার মিলের দূষণের দায়ে উৎপাদন বন্ধ : চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারীতে অবস্থিত এশিয়ান পেপার মিলস নামক প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালে নন্দিরহাট নামক স্থানে ঘন জনবসতিপূর্ণ একটি এলাকায় স্থাপন করা হয়। আলোচ্য পেপার মিলে পুরাতন কাগজ হতে দৈনিক প্রায় ২৫ টন মিডিয়া পেপার ও ১৫ টন নিউজ পেপার উৎপন্ন হয়। উক্ত উৎপাদন কার্যক্রম হতে দৈনিক আনুমানিক ৪৫০ ঘনমিটার তরলবর্জ্য সৃষ্টি হয়। কারখানাটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে উক্ত তরল বর্জ্য এবং সৃষ্ট স্লাজ বৃষ্টির পানির সাথে মিশে পার্শ্ববর্তী ছড়ার মাধ্যমে হালদা নদীতে পতিত হয়ে নদীর পরিবেশের মারাত্মক দূষণ করে আসছে।

গত ২০১৮ সালের ১৯ জুন হালদা নদী ব্যাপক দূষণ আগ্রাসনের শিকার হয়। ২০-২১ জুন পর্যন্ত নদী এবং এর অববাহিকার বিলগুলোতে ব্যাপক হারে মাছ মরে ভেসে উঠে। এমতাবস্থায় পরিবেশ অধিদপ্তর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি ও বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় হালদা নদী রক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে হালদা নদীর বিভিন্ন অংশ থেকে পানির নমুনা পরীক্ষা, মৃত মাছ সনাক্ত এবং নদী দূষণের উৎস হিসেবে হাটহাজারী পিকিং পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং এশিয়ান পেপার মিলস নামক দুটিকে প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়।

প্রতিষ্ঠানটি পরিবেশগত ছাড়পত্রের শর্তাবলী প্রতিপালন না করে পানি, ভূমি ও হালদা নদী দূষণ করায় পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক একাধিকবার জরিমানাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপগুলো হলো- হালদা নদীর পরিবেশ ও প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করার সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ২৫ জুলাই দুই লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। ২০১৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আলোচ্য পেপার মিল কর্তৃক অপরিশোধিত তরলবর্জ্য পরিবেশে নির্গত করে হালদা নদী দূষণের প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৪ সালের ৩ মার্চ পরিবেশ সদর দপ্তরের এনফোর্সমেন্ট এক কোটি পনেরো লক্ষ তেষট্টি হাজার দুইশত টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। একই বছর ১৮ নভেম্বর পরিবেশ অধিদপ্তরের এনর্ফোসমেন্ট টিম কর্তৃক হালদা দূষণের দায়ে সাত লক্ষ আটানব্বই হাজার সাতশত দশ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করে। ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় কর্তৃক ইটিপি বন্ধ রেখে বাইপাসের মাধ্যমে অপরিশোধিত তরলবর্জ্য দ্বারা পরিবেশ দূষণের দায়ে সাত লক্ষ ছত্রিশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এবং একই বছর ৮ নভেম্বর একই কারণে এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। এছাড়াও চট্টগ্রাম গবেষণাগার কর্তৃক পরিশোধিত তরলবর্জের নমুনা পরীক্ষা করে গ্রহণযোগ্য মানমাত্রার বাহিরে হওয়ায় ২০১৮ সালের ২৮ মে সাতান্ন হাজার ছয় শত টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়। ২০১৯ সালের ১০ জুন চট্টগ্রাম মহানগর কার্যালয় কর্তৃক পরিবেশগত ব্যবস্থাপনার ক্রুটি পরিলক্ষিত হওয়ায় দূষণের দায়ে বিশ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ ধার্য করা হয়।

সর্বশেষে একইবছর ১৪ আগস্ট হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক সরেজমিন পরিদর্শনকালে প্রতিষ্ঠানটি বাইপাসের মাধ্যমে তরলবর্জ্য অপসরণের অভিযোগের প্রেক্ষিত পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মহানগর কর্তৃক ২০১৯ এর ১৮ আগস্ট কারখানার কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং সেই সাথে কারখানার পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। কারখানা কর্তৃপক্ষ আজ পর্যন্ত পরিবেশ অধিদপ্তরের নির্দেশ অনুযায়ী পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন করতে সমর্থ না হওয়ায় কারখানাটি বন্ধ রয়েছে। যার ফলে ২০২০ সালে হালদা নদী অনেকাংশে দূষণমূক্ত ছিল। এটা প্রমাণিত সত্য যে এশিয়ান পেপার মিল বন্ধ থাকলে হালদা নদীর পরিবেশের উন্নতি হয়, মাছের ডিমের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় এবং একই সাথে স্থানীয়দের জন্যও বসবাসের জন্য স্বস্তি দায়ক হয়।

ব্রুড মাছ নিধন রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ : এক সময় মৌসুমে হালদা নদীতে রুই জাতীয় মাছেরা এখানে প্রচুর পরিমাণে ডিম ছাড়তো। ১৯৪৫ সালে এর পরিমাণ ছিল ১৪৮,০০০ কেজি, ২০০১ সালে ৪৭,৭০০ কেজি। মনুষ্যসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে হালদা নদীর উৎপাদনশীলতা কমে ২০১৬ সালে মা মাছ ডিম ছাড়েনি (মাত্র ৭৩৫ কেজি নমুনা ডিম পাওয়া যায়)।

এ প্রেক্ষাপটে হালদা নদীতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়নের লক্ষে এগিয়ে আসে সরকারী প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) অর্থায়নে বেসরকারী সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ)। আইডিএফ এর মাধ্যমে ২০১৫-১৬ সাল হতে ‘হালদা নদীতে মাছের প্রাকৃতিক প্রজননক্ষেত্র সংরক্ষণ ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে।

মৎস্যবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন যাতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে হালদার ব্রুড (মা ও বাবা) মাছ রক্ষা এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তার জন্য এই প্রকল্পের আওতায় হালদার দুই পাড়ে (হাটহাজারী ও রাউজান) ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক, ১ টি স্পিড বোট, ১টি ইঞ্জিন নৌকা ও ১টি সোলার বোট রাখা হয়েছে। মা মাছ রক্ষায় গত ২/৩ বছর হালদা নদী রক্ষায় স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা উল্লেখ করার মত। বিশেষ করে হাটহাজারী ও রাউজান উপজেলা প্রশাসনের। এদের সাথে আন্তরিক সহযোগিতা করেছেন পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম। মৎস্য অধিদপ্তরের মূল দায়িত্বতো হালদার মাছ রক্ষা করা।

শুধুমাত্র হাটহাজারী উপজেলা প্রশাসনের তথ্যমতে দেখা দেখা যায়, সেপ্টেম্বর ২০১৮ থেকে ফেব্রুয়ারি ২০২১ পর্যন্ত হালদা নদীতে শুধুমাত্র অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করেছে ২৬৮ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা বিভিন্ন ধরনের জাল। যা পুরো হালদা নদীর দৈর্ঘ্যরে প্রায় আড়াই গুণেরও বেশি। একই সময়ে পরিচালিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের ১৫৮টি অভিযানে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত ৫০টি ইঞ্জিনচালিত নৌকা, জব্দ করা হয় ১ লাখ ১৫ হাজার ঘনফুট বালু। এসব অভিযানে ধ্বংস করা হয় বালু উত্তোলনে ব্যবহৃত সাড়ে তিন কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপ এবং জাল বসানোর কাজে ব্যবহৃত নৌকা জব্দ করা হয় পাঁচটি। একই সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ১ লাখ ৬৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয় এবং তিনজনকে দেয়া হয় এক মাসের কারাদ-।

ব্রুড মাছ রক্ষায় স্থানীয় (হাটহাজারী ও রাউজান) উপজেলা প্রশাসনের আন্তরিক প্রচেষ্টা, মৎস্য ও পরিবেশ অধিদপ্তরের একাগ্রতা, স্বেচ্ছাসেবকদের সহযোগিতা এবং আইডিএফ-পিকেএসএফ এর লজিষ্টিক সাপোর্টের ফলে ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ২৫,৫৩৬ কেজি ডিম সংগ্রহের অন্যতম কারণ।

বেসরকারি সংস্থা আইডিএফ ও পিকেএসএফের কার্যক্রম : পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এবং ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আইডিএফ) এর বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে- মৎস্য বিভাগ ও প্রশাসন যাতে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে হালদার ব্রুড (মা ও বাবা) মাছ রক্ষা এবং পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে তার জন্য হালদার দুই পাড়ে (হাটহাজারী ও রাউজান) ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক, ১টি স্পিড বোট, ১টি ইঞ্জিন নৌকা ও ১টি সোলার বোট রাখা হয়েছে।

২০১৮ সালে নদীতে ব্রুড মাছের সংখ্যা বৃদ্ধি করার জন্য সর্তা ঘাটের কাছে হালদা নদীতে প্রায় ১৮০০ কেজি মাছ (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউস) অবমুক্ত করা হয়। এ ছাড়াও উল্লেখিত সময়ে এই প্রকল্পের আওতায় নদী পাড়ের স্কুল-মাদ্রাসার কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কে হালদা নদীর গুরুত্বপূর্ণ, এবং নদী সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে ক্যাম্পেইন করা হচ্ছে। মসজিদের ইমাম সাহেবরা যেন জুমার নামাজের খুতবাতে হালদা নদীর গুরুত্ব এবং নদী রক্ষায় সরকারের নির্দেশনা সাধারণ জনগণ কে অবহিত করেন এবং নদীর মা মাছ শিকার বন্ধে মানুষকে সচেতন করেন সেজন্য নদীর দুই পাড়ের মসজিদের ইমামদের নিয়ে সচেতনতামূলক কর্মকা- পরিচালনা করা হচ্ছে।

প্রকল্পের শুরু থেকে ডিম থেকে স্থানীয় পদ্ধতিতে রেণু উৎপাদনের জন্য যে মাটির কুয়া ব্যবহৃত হতো তার উন্নয়নের উপর কাজ করছে। ২০১৭ সাল থেকে হালদার দুই পাড়ে ১৫৭টি মাটির কুয়ায় রেণু উৎপাদনকারীদের উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়াও হালদা নদীর উপর গবেষণা করার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাব (যা বাংলাদেশের একমাত্র একক নদী ভিত্তিক গবেষণাগার) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অবৈধভাবে মাছ শিকারিদের স্কুল পড়ুয়া সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে শিক্ষায় সহায়তা দেয়া হয়েছে। প্রাথমিকভাবে দুই পাড়ের ৫০ জন জেলে সন্তান কে নির্বাচন করে বৃত্তি প্রদান করা হয়েছে।

হালদা নদীর দুই পাড়ে যতো সংখ্যক ডিম সংগ্রহকারী আছে সেই তুলনায় হ্যাচারির সংখ্যা কম। সেজন্য আধুনিক সুবিধা সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ হ্যাচারি স্থাপনের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে। যেখানে ডিম সংগ্রহকারীরা যেমন ডিম ফুঁটাতে পারবেন তেমনি হালদার পোনা থেকে ব্রুড মাছ উৎপন্ন করা হবে।

নৌ পুলিশের কার্যক্রম ও সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন : বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ টিম নৌ পুলিশ কর্তৃক প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে মা মাছ শিকার, বিপন্নপ্রায় ডলফিন বাঁচাতে এবং অবৈধ বালু উত্তোলন বন্ধ করতে লাগানো হয়েছে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে হালদা পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী ফাঁড়ি। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো নদীকে সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে মনিটরিং করা হচ্ছে। ছয়টি উচ্চ ক্ষমতার ক্যামেরা হালদা পাড়ের মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া পর্যন্ত এলাকা মনিটরিংয়ের আওতায় আনা হয়েছে। এর ফলে নদীর প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকা সার্বক্ষণিক নজরদারির আওতায় এসেছে।

এই ক্যামেরাগুলো বসানোর ফলে কয়েকটা সুবিধা পাওয়া যাবে। যেকোনো স্থান থেকে নদী নজরদারি করা যাবে, রাতেও নদীতে কেউ জাল বসাচ্ছে কিনা, বালি উত্তোলন বা ডলফিন হত্যা করছে কিনা, অবৈধ কিছু করা হচ্ছে কিনা, সেটা বোঝা যাবে। সেই সঙ্গে যারা অবৈধ মাছ ধরে বা বালু তোলে, তাদের মধ্যেও একটা ভীতি তৈরি হবে।

হালদা নদীকে ‘বঙ্গবন্ধু ফিশারীজ হেরিটেজ’ ঘোষণা বাংলাদেশের নদী রক্ষার ক্ষেত্রে একটি অনন্য উদাহরণ। হালদাকে বঙ্গবন্ধু মৎস্য হেরিটেজ ঘোষণা করার ফলে নদীটির বিশেষ মর্যাদা ও গুরুত্ব পাবে। নদী (বঙ্গবন্ধু ফিশারীজ হেরিটেজ) সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত উদ্যোগ বাংলাদেশে নদী সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনায় একটি জাতীয় মডেল হয়ে উঠতে পারে। স্থানীয় জনগণ (স্বেচ্ছাসেবক), বেসরকারি সংস্থা, প্রশাসন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের সমন্বিত উদ্যোগের মধ্য দিয়ে হালদা নদীর মা মাছ এবং ডলফিনসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা পালন করবে। এর আদলে বাংলাদেশের মৃতপ্রায় অন্যান্য নদীগুলোর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। সুজলা-সফলা, শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলাদেশের নদীগুলো রক্ষার মাধ্যমে এসডিজি ২০৩০, ভিশন ২০৪১ এবং ডেল্টা প্লান ২১০০ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। (সমাপ্ত)

লেখক: মো. মনজুরুল কিবরীয়া অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ; সমন্বয়ক, হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট