চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

ইসলামে আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষার গুরুত্ব

মোহাম্মদ নুর হোসাইন

৪ জুন, ২০২১ | ২:০২ অপরাহ্ণ

ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির ভালমন্দ সম্পর্কের প্রভাব পড়ে পরিবার ও সমাজে। সাধারণত নিজের আত্মীয়ের সাথে মানুষের গভীর সম্পর্ক থাকে। আত্মীয় মানে আত্মার সাথে সম্পর্কিত বা রক্তের সম্পর্কের ব্যক্তি। যিনি যত বেশি নিকটাত্মীয় তার সাথে সম্পর্কও তত বেশি। সে-সূত্রে তার প্রতি দায়িত্বও বেশি। সালাম-কালাম, খোঁজখবর, যাতায়াত ও যোগাযোগ, দেখা-সাক্ষাৎ, সাহায্য-সহযোগিতা, সেবা-শুশ্রুষা ইত্যাদি হলো আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার উপায়। এটাকে পবিত্র কুরআন-হাদিসের ভাষায় ‘ছিলাতুর রিহ্ম’ বলা হয়েছে। এর প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ইহসান’ বা সদাচারণ শব্দটিও ব্যবহার হয়েছে। বিপরীত শব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, ‘কত্য়ুর রিহ্ম’ বা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় না রাখা বা ছিন্ন করা। পরিভাষায় আত্মীয়দের সাথে সদাচারণ করা, সাধ্যমত তাদের কল্যাণ করা এবং কষ্ট লাঘব করাকে ‘ছিলাতুর রিহ্ধসঢ়;ম’ বলা হয়। পক্ষান্তরে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় না রাখা, সম্পর্ক ছিন্ন করা বা তাদের সাথে অসদাচারণ করাকে ‘কত্য়ুর রিহ্ম’ বলা হয়।

মানুষ হিসেবে যে-কারো সাথে সদাচারণ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখা প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব। তবে ইসলামি আইনে আত্মীয়দের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব বা আবশ্যক। ইমাম কুরতুবি ও কাযি আয়ায (রহ.) এ বিষয়ে আলেমগণের ‘ইজমা’ বা ঐক্যমত নকল করেছেন। আবার আত্মীয়দের মধ্যে নিকটাত্মীয় ও দূরবর্তী আত্মীয় আছে। তাই কোন্ধসঢ়; পর্যায়ের আত্মীয়ের সাথে কতটুক সম্পর্ক বজায় রাখা আবশ্যক- সে বিষয়ে ইমামগণের বিভিন্ন মত আছে। সাধারণত রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়ের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা ওয়াজিব। রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয় হলো, যাদের একজন পুরুষ আর অপরজন নারী হলে পরস্পরের মাঝে বিয়ে নাজায়েয হবে। পবিত্র কুরআনে ১৪ শ্রেণির মানুষের সাথে বিয়ে নাজায়েয ঘোষণা করা হয়েছে। অতএব তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা আবশ্যক।

আরেকটি মত হলো, যারা সম্পদের ওয়ারিশ হয় তাদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রাখা আবশ্যক। এটি অবশ্য বিশুদ্ধ মত নয়। কারণ, তখন আপন খালা ও খালু বাদ পড়ে যায়। অথচ পবিত্র হাদিসে বলা হয়েছে, ‘খালা মায়ের স্থলাভিষিক্ত’। মোট কথা হলো, মাতাপিতা ও বৈবাহিক সূত্রে যারা আত্মীয় তাদের সবার সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা উচিৎ। তবে রক্তসম্পর্কীয় আত্মীয়দের প্রতি দায়িত্ব বেশি এবং সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে তারা অগ্রাধিকার পাবে। নিজের সামর্থ্য ও আত্মীয়ের প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন করা হবে। যিনি যত বেশি নিকটের আত্মীয়, সম্পর্ক বজায় রাখা এবং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে তিনি বেশি প্রাধান্য পাবেন। পাশাপাশি যার জন্য যা প্রযোজ্য সে ক্ষেত্রে তিনি প্রাধান্য পাবেন।

পবিত্র কুরআন-হাদিসে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখতে বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। নিষেধ করা হয়েছে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করতে বা তাদের সাথে অসদাচারণ করতে। মা-বাবার সাথে অসদাচারণকে সবচেয়ে বড় পাপের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের দশটি আয়াতে সরাসরি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করা ও আত্মীয়ের হক আদায় করার কথা এসেছে। প্রত্যেক হাদিসগ্রন্থে এ বিষয়ক অধ্যায় রয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মানব, তোমরা তোমাদের রবকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে একটি মাত্র আত্মা থেকে সৃষ্টি করেছেন। আর তিনি সেই আত্মা থেকে তার জোড়া সৃষ্টি করেছেন। তাদের উভয় থেকে ছড়িয়ে দিয়েছেন নারী-পুরুষ। আর ভয় কর তাঁকে, যাঁর নাম দিয়ে তোমরা পরষ্পর যাচনা করে থাক। আর ভয় কর আত্মীয়তার বন্ধন ছিন্ন করাকে’ (সূরা নিসা: ১)। অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যারা প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর তা ভঙ্গ করে, আল্লাহ তায়ালা যাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখতে বলেছেন তাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে আর পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করে তাদের প্রতি অভিসম্পাত এবং তাদের জন্য রয়েছে মন্দ ঠিকানা (সূরা রা‘দ, ২৫)।

এক ব্যক্তি আল্লাহর নবি (দ.)-কে বললেন, আমাকে এমন আমল শিক্ষা দিন, যা আমাকে জান্নাতে নিয়ে যাবে। তিনি বললেন, “তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে, কোনকিছুকে তাঁর সমকক্ষ দাঁড় করাবে না, নামায কায়েম করবে, যাকাত আদায় করবে এবং আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখবে (বুখারি, ১৩৯৬)। তিনি আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখে সে যেন আত্মীয়তা সম্পর্ক বজায় রাখে (প্রাগুক্ত, ৬১৩৮)। যারা আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখেনা তাদের জন্য অশনি সংকেত রয়েছে পবিত্র কুরআন-হাদিসে। বলা হয়েছে, প্রতি জুমার রাতে আদম সন্তানের আমল পেশ করা হয়। তবে আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারীর আমল কবুল হয় না। মুসনাদের এক হাদিসে বলা হয়েছে, “তিন শ্রেণির মানুষ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না; মদ্যপায়ী, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং যাদুতে বিশ্বাসী’।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য যেসব কর্মসূচি পালন করা প্রয়োজন তা হলো, ১। সালাম-কালাম করা, ভালমন্দের খোঁজখবর নেয়া, চিঠিপত্র দেয়া, যোগাযোগ রক্ষা করা ২। টাকাপয়সা ও উপহার দেয়া। যদি আত্মীয় দরিদ্র হয় তাহলে একদিকে আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা হবে অপরদিকে সেটি ছদকাও হবে। আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, “নিঃস্বকে ছদকা দিলে ছদকার ছাওয়াব আর দরিদ্র আত্মীয়কে ছদকা দিলে ছদকা ও ছিলাহ (আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা) উভয়ের ছাওয়াব পাবে (নাসায়ি) ৩। বয়স্ক আত্মীয়কে সম্মান করা এবং ছোটদেরকে স্নেহ করা ৪। পদ অনুযায়ী মর্যাদা দান করা ৫। সুখে-দুঃখে তাদের পাশে থাকা। যেমন, বিয়ে-সাদি, অলিমা, আকিকা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করা, তাদের কেউ মারা গেলে তার পরিবারের লোকজনকে শান্তনা দেয়া, বিপদে পড়লে ধৈর্যের উপদেশ দিয়ে কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করা ৬। অসুস্থ হলে দেখতে যাওয়া ও সেবা-শুশ্রুষা করা ৭। মারা গেলে জানাযায় অংশগ্রহণ করা ৮। দাওয়াত দিলে উপস্থিত হওয়া ৯। উদারতা প্রদর্শন করা এবং তাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ না করা ১০। আত্মীয়দের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হলে তা মিটিয়ে দেয়া এবং সুসম্পর্ক ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা ১১। তাদের জন্য দোয়া করা ১২। নেক কাজের দাওয়াত, ভাল কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করা।

আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখা আল্লাহ তায়ালার নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রিয় আমল। এর মাধ্যমে তাঁর আদেশ পালন করা হয় এবং এতে তিনি সন্তুষ্ট হন। এটি আল্লাহর নবি (দ.)-এর সুন্নাহ এবং প্রথম জীবন থেকে প্রদত্ত মৌলিক শিক্ষার অন্যতম। এটি ঈমান ও উত্তম চরিত্রের পরিচায়ক; কিয়ামত দিবসে মুক্তি ও জান্নাত লাভের গুরুত্বপূর্ণ আমল ও উসিলা। এর মাধ্যমে পরষ্পরের মাঝে ভালবাসা সৃষ্টি হয়। যারা আত্মীয়তার বন্ধন রক্ষা করে আল্লাহ তায়ালাও তাদের সাথে সম্পর্ক রাখেন অর্থাৎ তাদের প্রতি অধিক দয়া করেন। এর মাধ্যমে জীবিকা ও আয়ু বৃদ্ধি পায় এবং মন্দপরিণতি থেকে মুক্তি লাভ করে। আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, ‘কোন ব্যক্তি যদি চায় যে, তার জীবিকা এবং তার আয়ু বৃদ্ধি পাক তাহলে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক বজায় রাখে’ (প্রাগুক্ত, ৫৯৮৬)। দিন দিন মানুষ আত্মকেন্দিক হচ্ছে। পরিবার ও সমাজকেন্দ্রিকতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে পারিবারিক ও সামাজিক শান্তি বিনষ্ট হচ্ছে। মায়া-মমতা-শ্রদ্ধার স্থলে জায়গা করে নিচ্ছে হিংসা-বিদ্বেষ ও শত্রুতা। আত্মকেন্দ্রিকতার মাধ্যমে অনেকেই বাহ্যিক বা আর্থিক উন্নতি লাভ করলেও মানসিক শান্তি হ্রাস পাচ্ছে। মানসিক শান্তি ফিরিয়ে আনার অন্যতম কর্মসূচি হলো আত্মীয়তার বন্ধনকে গুরুত্ব দেয়া, তাদের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখা, প্রয়োজনে তাদের সাহায্য করা, সাধ্যমত যোগাযোগ রক্ষা করা এবং খোঁজখবর নেয়া। যেহেতু পৃথিবীর সব মানুষ একই পিতা-মাতা থেকে সৃষ্ট সেহেতু প্রত্যেকেই একে অপরের আত্মীয়; হোক সে নিকটের বা দূরের আত্মীয়। যিনি একজনের দূরের আত্মীয় তিনি আরেকজনের নিকটাত্মীয়। সে হিসেবে মানুষ একে অপরের নিকটাত্মীয়। প্রত্যেক ব্যক্তি যদি অন্তত আত্মীয়দের প্রতি সদাচারণ ও দায়িত্ব পালন করে এবং তাদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখে তাহলে পৃথিবীর সব মানুষের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হবে। এ সুসম্পর্কের সুবাদে শান্তির সমাজ বিনির্মাণ হবে।

লেখক: মোহাম্মদ নুর হোসাইন সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট