চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

করোনাকালে শিশুদের মনের যত্ন

রশীদ এনাম

২০ মে, ২০২১ | ১:৫০ অপরাহ্ণ

‘হাসি আর গানে ভরে যাক, সব শিশুর অন্তর,/প্রতিটি শিশু বড়ো হোক সবার ভালো বাসায়। /শিশুদের আনন্দমেলায় স্বর্গ নেমেই আসুক।/আজ যে শিশু পৃথিবীর আলোয় এসেছে,/আমরা তার তরে একটি সাাজনো বাগান দেখেতে চাই।/আজ যে শিশু মায়ের হাসিতে হেসেছে,/আমরা সেই হাসি চির দিন ধরে দেখতে চাই!’

দেশবরেণ্য গীতিকবি শহীদ মাহমুদ জঙ্গীর লেখা গানের কলিগুলো সত্যি হৃদয় স্পর্শ করার মতো। করোনাকালীন সময়ে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। ওদের মনের খবর নিতে হবে সবার আগে। শিশুরা হাসলে যেমন পৃথিবী হেসে উঠে মন খারাপ হলে পৃথিবীর মন খারাপ। আমরা কি করতে পারছি শিশুবান্ধব বাসযোগ্য পৃথিবী।

পৃথিবীর বড় অসুখ, শিশুরা ভুলতে বসেছে দুরন্ত শৈশব, সহপাঠিদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মানসিক চাপ বাড়ছে। লকডাউনে কোথাও যেতে পারছেনা। ইশকুল বন্ধ গত দেড় বছর ধরে। গৃহবন্দী কবুতরের কোপের মধ্যে শিশুরা অস্থির সময় পার করছে। বিশ^মহামারী চলছে শিশুরা কিন্তু সবকিছু ভালো বুঝে। বড়দের মতো ওরা মাস্ক পড়ে, কিছুক্ষণ পর পর হাত ধোয়। আহা! কত কৌতুহল কত প্রশ্ন, ছোট দিহাম তাঁর বাবাকে জিজ্ঞেস করে, বাবা আমি কখন ক্রিকেট অনুশীলন করার জন্য মাঠে যাবে? বর্ণ তাঁর মাকে বলে, আমি কি জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে পারব? শায়ান তাঁর বাবাকে বলে করোনা কখন পালিয়ে যাবে, আর কতদিন ঘরে বসে থাকব? সুবাইতা তাঁর মাকে বলে, মা আমার বন্ধুদের সাথে কখন দেখা হবে? তুমি আমার বন্ধুদের এনে দাও না মা। আরোশের প্রশ্ন আমরা কেন ভ্যাকসিন নিতে পারব না? ইত্যাদি। ইশ্ধসঢ়; কত ধৈর্য্য ধরতে পারে শিশুরা বলুন!

বাবুই পাখির মতো হেসে খেলে যে শিশুটি ইশকুলে মাঠে হৈ হুল্লোড় করে বেরিয়েছে ছুটির বাঁকে সহপাঠীদের সাথে আনন্দে গোল্লাছুট, কানামাছি, খেলেছে। টিফিন পিরিয়ডে বন্ধুর সাথে টিফিন ভাগাভাগি করে খেয়েছে। করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ।

অনেক শিশু প্লেমেট বা বাসায় পরিবেশ থাকার কারণে মানিয়ে নিতে পারলেও অনেকের রাগ, উদ্বেগ, দুঃখ, ভয়, হি¯্র আচরণ বাড়তে থাকে, অনেকটা শিশুদের মনে মরিচিকা মাকড়সার জাল বাসা বাঁধার মতো। মহামারীসময়ে ওদের মনের জানালায় আলো প্রবেশ করতে পারছে না। বাসায় একটু দুষ্টামি করলে বাবা-মায়ের বকুনি। দুষ্ট চঞ্চল প্রকৃতির শিশুরা বিশেষ করে যাদের বয়স চার পাঁচ বছর ওরা চঞ্চল হবে স্বাভাবিক। ওদের ব্রেন কিন্তু শার্প হয় ওরা মেধাবী ও সৃজনশীল হয়ে থাকে। দেখবেন চঞ্চল শিশুরা একটা জায়গায় স্থির থাকে না। ছবি আঁকছে, বইয়ের পাতা উল্টে পাল্টে ছুড়ে মারছে। ছবি আঁকার সময় তাড়াহুড়ো করছে, খাবারের সময় খেলধুলা, ভাঙ্গা ভাঙ্গি তো আছে। দৌড়, লাফঝাপ, আমরা ওদেরকে শাষণ করি এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। এত করে শিশুদের মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বেড়ে উঠা শিশুরা দেখবেন বড়দের আর বিরক্ত করছে না। সে তার কৌতুল বিষয়গুলো নিয়ে মনের সাথে খেলা করছে একেবারে জীবন্ত খেলনার মতো। এটা স্বাভাবিক বাবা-মা বড়রা তাঁদের কৌতুহলের বিষয়গুলো উত্তর দিতে সাহায্য করতে পারেন। ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’ বলে কথা।  কালের বিবর্তনে আকাশসংস্কৃতি এবং প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বিশে^র সাথে তাল মেলাতে গিয়ে গিয়ে শিশুদের কাছ থেকে তিনটা অতি মূল্যবান জিনিষ কেড়ে নিয়েছি প্রকৃতি, জ্ঞান, একান্নবর্তী পরিবারের ভালোবাসা।

বিজ্ঞানের আশীর্বাদ যেমন আছে, তেমনি অভিশাপও আছে। বই-র বদলে যন্ত্র তুলে দিয়েছি শিশুদের হাতে। দিয়াশলাইয়ের বাক্সের মতো সবার হাতে মুঠোফোন, ট্যাব, কম্পিউটার, রোবট। আজকালকার শিশুরা নাকি মোবাইল হাতে না দিলে, খেতেও চাই না। ঘুম পাড়ানোর জন্য বালিশের নিচে মোবাইল রাখতে হয়। অনেক পিতামাতারা শিশুদের হাতে আনন্দের সাথে মোবাইল তুলে দেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যেম ফেসবুক জ্বরে ভুগছে সম্ভাবনাময় শিশুরা। ইদানিং দেখছি কচিকাঁচাদের ভার্চুয়াল জুম ক্লাশ প্রযুক্তি আসক্তি আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

মোবাইল আসক্তি অনেকটা মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। ফেসবুক আসক্তি মাদকাসক্তির চেয়েও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পিতা-মাতা দু’জনে চাকুরীজীবী হলে কথাই নেই, বাসার কাজের মেয়ে/বুয়া, টিভি, মোবাইল ট্যাব হয়ে যায়, শিশুদের খেলার সাথী। কর্মজীবী পিতামাতা অফিস থেকে ফিরে এসে দেখা যায়, দু’জনে  মোবাইল, ফেসবুক, টিভির রিমোট নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। এটা কিন্তু  শিশুদের উপর প্রভাব পড়ছে।

অফিস থেকে ফিরে যদি পিতা-মাতা শিশুদের কে একটু সময় দেন, আনন্দের সাথে গল্প করেন। শিশু কি চাই, কোন বিষয়ে আনন্দ পাচ্ছে, সেটা নির্বাচন করেন, না হয় মজার শিশুতোষ আনন্দের গল্প ছড়ার বই নিয়ে বসেন। দেখবেন শিশুরা সেটা অনুকরণ করছে। বাসায় যদি বড়রা বই পড়ার সু-অভ্যাস করেন দেখবেন শিশুরা যন্ত্র বাদ দিয়ে বইপ্রেমী হয়ে উঠছে।

প্রকৃতি কথায় আসি, বর্তমান সময়ে আমরা শিশুদের বড় করছি কারাগারের মধ্যে মধ্যে। খেলার মাঠ নেই। বাড়িওয়ালারা বাড়ি করার সময়, শিশুদের কথা ভাবে না। খেলার জন্য ছোট একটা জায়গা রাখতে কৃপণতা করেন। গাছ-পালা, প্রকৃতি উজাড় হয়ে যাচ্ছে। পাহাড় নদী দিঘি বিলিনের পথে। শিশুদের মন সবুজ, ওদের আনন্দের জন্য প্রকৃতির ছোঁয়া খুব প্রয়োজন। প্রকৃতির কাছে নিয়ে গেলে শিশুদের মন সবুজ হয়। তাই প্রতিবছর শিশুদেরকে অন্তত একবার হলেও পাহাড়ের কাছে সমুদ্রের কাছে নিয়ে যান। এতে শিশু আনন্দের সাথে বেড়ে উঠবে।

একান্নবর্তী পরিবার থেকে শিশুরা অনেক কিছু শেখে। শিশুদের পারিবারিক শিক্ষা, ভিত্তি ও মনোবিকাশটা কিন্তু পরিবার থেকে শিখে। একান্নবর্তী পরিবারে শিশুরা প্লে-মেট, দাদা-দাদী কিংবা চাচা ফুফুর কাছ থেকে সততা, সহমর্মিতা, ত্যাগ, মায়া, মমতা আদর স্নেহ ভালোবাসার মধ্যে দিয়ে বেড়ে উঠে ওদের মনোবিকাশ বেশ ভালো হয়। শিশুরা সুন্দর পরিবেশ বড় হওয়ার মধ্যে আনন্দ খোঁজে পাই। শিশুদের মনের যত্নের জন্য একান্নবর্তী পরিবারের ভালোবাসা খুব প্রয়োজন।

শিশুদের হাতে মোবাইল নয় বই তুলে দিন। বই পড়ার অভ্যাস যদি শিশুকাল থেকে গড়ে তুলতে পারেন, পড়ার জন্য জোরাজুরি করতে হবে না। দেখবেন আপনা আপনি আনন্দের সাথে বই পড়ছে। শিশুদেরকে আনন্দের সাথে বইপড়ার জন্য উৎসাহ দিতে হবে। আনন্দ থাকলে বই পাঠে শিশুরা মনোযোগী হয়ে উঠে। ভালো মানের শিশুতোষ বইয়ের গল্পগুলো অভিনয় করে বলুন, দেখবেন বই হবে ওদের আনন্দের সাথী। বই হলো মৌমাছির মতো, যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে শিশুপাঠকদের জন্য নিয়ে আসে। যদি শিশুদের আলোকিত করতে চান, বই পড়ার কোন বিকল্প নেই। কবি রবি ঠাকুর বলেছিলেন, মানুষ বই দিয়ে অতীত ভবিষ্যৎ এর মাঝে সাঁকো বেধে দিয়েছে। আজকের শিশুরা আগামীদিনের কান্ডারী। বই হলো মনের বড় দাওয়াই। তবে মনে রাখতে হবে, এ-প্লাস, গোল্ডেন এ-প্লাস পাওয়ার জন্য শিশুদেরকে অস্থির করা যাবে না। শিশুদের মনের প্রতিক্রিয়ার দিকে লক্ষ্যে রাখতে হবে।

ওদের মনের উপর জোড় কাটানো কিংবা বেশি প্রশ্ন করাও উচিত নয়। তাকে আনন্দগণ সুন্দর একটা পরিবেশ দিতে হবে। যাতে সে বুঝতে পারে, সে কি বলতে চাই। তার কথাগুলো গুরুত্ব সহকারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনতে হবে। শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, তারা বড়দের কাছ থেকে শেখে। শিশুদের সামনে কখনও নেতিবাচক ব্যক্য বিনিময় কিংবা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা উচিত নয়। করোনার খারাপ খবরগুলো শিশুদের সামনে আলোচনা না করাই ভালো। এতে শিশুদের উদ্বেগ বাড়তে পারে। করোনাকালীন সময়ে শিশুদের অস্বাভাবাবিক আচরণ পরিবর্তন, দুঃস্বপ্ন, ভয়, কম ঘুমনো, এই সমস্যাগুলো যদি প্রতিদিন জীবন যাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায় , তাহলে শিশুকে মনোরোগ ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে। কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের কথা দিয়ে শেষ করি, ‘বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান হচ্ছে চমৎকার একটি জীবন্ত খেলনা। এই খেলনার সবই ভালো। খেলনা যখন হাসে বাবা-মা হাসে। খেলনা যখন কাঁদে বাবা-মা’র মুখ অন্ধকার হয়ে যায়।’ আমরা চাই প্রতিটি শিশু আনন্দের মধ্যে বড়ো হোক। শিশুরা এগিয়ে গেলে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।  করোনাকালীন সময়ে শিশুদের মনের যত্ন নিতে হবে সবার আগে।

লেখক: রশীদ এনাম গল্পকার ও ব্যাংকার

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট