চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

সিয়াটল টু নিউ ইয়র্ক : উই আর দ্যা সিক্স গাইজ

 আতিকুল ইসলাম

৬ এপ্রিল, ২০২১ | ২:০৯ অপরাহ্ণ

তিনি আমাদেরকে অন্য বাসের ড্রাইভারের হাতে সমর্পণ করে, অন্য বাসের ড্রাইভারকে বুঝিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। নতুন বাসের ড্রাইভার আমাদের থেকে ভাড়া নিলেন না। বললেন এটা ফ্রি ট্রান্সফার। আরো ১০ থেকে ১৫ মিনিট পর আমাদের নামিয়ে দিলেন দূরপাল্লার বাস স্টেশনের সামনে। যুক্তরাষ্ট্রের বাস টার্মিনালগুলো অনেকটা এয়ারপোর্ট টার্মিনালের মত। ভেতরে টিকেট কাউন্টার ছাড়াও বসবার জন্য ওয়েটিং লাউঞ্জ আছে। বাসে ওঠবার জন্য বোডিং গেট ব্যবহার করতে হয়। গেট পেরিয়ে লাগেজ বাসের পাশে রেখে বাসে উঠতে হয়। তবে বিমানের মত কোনো সিট নম্বর ঠিক করা থাকে না। খালি একটি সিটে বসে পড়লেই হল।

গ্রেহাউন্ড বাসের কাউন্টারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেলো পরের বাস  ছাড়বে সন্ধ্যে সাতটা তিরিশ মিনিটে। সিয়াটল থেকে নিউইয়র্ক শহরের ভাড়া ১৩২ মার্কিন ডলার। অবাক ব্যাপার হচ্ছে ৩২ বছর পরেও সে ভাড়া এখনো মাত্র ১৫০ মার্কিন ডলার। সবাই নগদ ডলার দিয়ে টিকেট কিনতে গেলে কাউন্টার ক্লার্ক একটু অবাক হলেন। এ দেশে এত টাকা কেউ নগদ দেয় না, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করেন। আর আমাদের কারোরই কাছে ক্রেডিট কার্ড নেই। ক্লার্ক আমাদের জানালেন পথে পথে বিভিন্ন শহরে আমাদের বাস বদলাতে হবে। আমাদের হাতে কিছু সময় ছিল তাই ভেন্ডিং মেশিন থেকে হালকা খাবার কিনে খেলাম। আমরা সব ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে আছি বাসের অপেক্ষায়। হঠাৎ মাইকে শোনা গেল ‘সিক্স গাইজ প্লিট রিপোর্ট টু কাউন্টার ত্রি।’ আমাদের তিন নং কাউন্টারে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। বলা হলো ৭ নম্বর প্লাটফর্ম থেকে আমাদের বাস ছাড়বে। ছ’ ফুটেরও বেশি লম্বা মাঝবয়সী শেতাঙ্গ ড্রাইভার আমাদের স্বাগত জানালেন। টিকিটের এক অংশ নিজের কাছে রেখে দিয়ে আমাদের বাসে উঠতে বললেন। সন্ধ্যে ৭.৩৬মিনিটে বাস ছাড়লো।  শুরু হলো আমাদের যাত্রা। যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম প্রান্ত থেকে পূর্বপ্রান্তে ৩০০০ মাইল বা ৪৮০০ কিলোমিটারেরও বেশি পথ অতিক্রম। তিন পর্বে লিখা ঘটনাবহুল এই রোমাঞ্চকর যাত্রাতে আপনারাও চলুন আমাদের সাথে, জেনে নিন যুক্তরাষ্ট্রের জানা-অজানা অনেক মজার তথ্য।

পর্ব ২ : সাত্রিশ লক্ষ বর্গমাইলের এই ভূখ-ে যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে ৫০টি অঙ্গরাজ্য। তার মাঝে ৪৮টি অঙ্গরাজ্য একটির সাথে আর একটি লাগানো। যাদের বলা হয় লোয়ার ফোটি এইট (ষড়বিৎ ৪৮) অথবা ঈড়হঃরমঁড়ঁং (সংলগ্ন) টঝ। আলাস্কা অঙ্গরাজ্য যা কিনা কানাডা অতিক্রম করে যেতে হয়, তা যোগ করে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯টি স্টেটকে বলা হয় কন্টিনেন্টাল ইউ এস (ঈড়হঃরহবহঃধষ টঝ)। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ডুয়েট আইনজেনহাওয়ার (উরিমযঃ ঊরংবহযড়বিৎ) যুক্তরাষ্ট্র সেনাবাহিনীর প্রধান (ঝঁঢ়ৎবসব ঈড়সসধহফবৎ ড়ভ ঃযব অষষরবফ ঊীঢ়বফরঃরড়হধৎু ঋড়ৎপব) হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এই পাঁচ তারা জেনারেল জার্মানির অটোবান (অঁঃড়নধযহ- যার বাংলা অনুবাদ হচ্ছে রাজপথ বা হাইওয়ে) সিস্টেম দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। কোনো ট্রাফিক লাইট ছাড়াই এক শহর থেকে অন্য শহরে চলাচল করা যায়। ১৯৫২ সালে রিপাবলিকান পার্টির পদপ্রার্থী হিসেবে ৩৪তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবার পর যুক্তরাষ্ট্রে অত্যাবশ্যক ইন্টারস্টেট (অন্তরাজ্য) হাইওয়ে সিস্টেম বাস্তবায়ন করেন তিনি যার শুরু হয় “ঞযব ঋবফবৎধষ-অরফ ঐরমযধিু অপঃ ড়ভ ১৯৫৬” দিয়ে। এই সিস্টেমে দক্ষিণ থেকে উত্তরের হাইওয়েগুলোকে দু’অঙ্কের বেজোড় সংখ্যা নাম্বার দেওয়া হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে পূর্বে ইন্টারস্টে ও-৯৫ (আই-নাইন্টিফাইভ) মেইন (গধরহব) অঙ্গরাজ্য থেকে শুরু হয় ফ্লোরিডার মায়ামি পর্যন্ত বিস্তৃতি।  ২,৯০০ মাইল লম্বা ইন্টারস্টেট ৮০ বা ও -৮০ (৮০, আই-এইটি) দিয়ে আপনি চাইলে নিউইয়র্ক শহর থেকে ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সান ফ্রান্সিসকো শহর পর্যন্ত একটানা না থামিয়ে গাড়ি চালিয়ে যেতে পারবেন। সবচাইতে দীর্ঘতম হাইওয়েটি হচ্ছে ও -৯০ যার দৈর্ঘ্য ৩০২০ মাইল। ও -৯০ ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের সিয়াটল শহরে শুরু হয়ে বোস্টন শহরের লোগান এয়ারপোর্টে গিয়ে শেষ হয়। তিন সংখ্যার ইন্টারস্টেট হাইওয়েগুলো মূল হাইওয়েগুলোকে সংযুক্ত করে। নিউ ইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিরাকিউস শহরে ও -৬৯০ ও -৯০ এবং ও-৮১ হাইওয়েকে সংযুক্ত করে। বলা বাহুল্য ফেডারেল (ঋবফবৎধষ- যুক্তরাষ্ট্রীয়) সরকার ৪৭,০০০ মাইলের ইন্টারেস্টেট হাইওয়ে তৌরি এবং মেরামতের খরচ বহন করেন। জেনে রাখুন, ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যে হাইওয়েকে ফ্রিওয়ে (ভৎববধিু) বলা হয়ে থাকে। আমাদের বাসটি সিয়াটল স্টেশন থেকে বের হয়ে কিছুদূর লোকাল রাস্তায় ভ্রমণ করবার পর ইন্টারস্টেট ও-৯০ তে উঠে পড়ল। বাসের ড্রাইভার জানালেন আমাদের পরবর্তী গন্তব্য স্পোকেন, ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্যের পূর্বপ্রান্তের একটি বড় শহর। স্পোকেন শহরে ‘ফাদার্স ডের’ জন্ম। রাস্তার দু’পাশে তুষার পড়ে সাদা হয়ে রয়েছে যদিও বাইরের দৃশ্য তেমন একটা দেখা যাচ্ছিল না। এর ভিতর দিয়েই ছুটে চললাম আমরা পূর্বদিগন্তে। আমাদের সকলের উপর দিয়ে খুব ধকল গেছে গত দু’দিন। বাসের পঞ্চাশ থেকে ষাট শতাংশ সিট খালি থাকায় আমরা প্রত্যেকেই দুটো করে সিট দখল করে নিয়েছি। ভীষণ ক্লান্ত সবাই। নিজের অজান্তে ঘুমিয়ে পড়লাম।

আশির দশকে প্রায় সকল ইন্টারস্টেট হাইওয়ের সর্বোচ্চ গতিসীমা ছিল ঘণ্টায় ৫৫ মাইল। নব্বইয়ের মাঝামাঝি সময়ে তা ৬৫ মাইলে দাঁড়িয়েছে। অল্প কিছু ইন্টারস্টেট হাইওয়েতে সর্বোচ্চ গতিসীমা ৭৫ মাইল। সাত ঘণ্টায় ২৮৬ মাইল অতিক্রম করে আমরা রাত আড়াইটার দিকে স্পোকেন শহরে পৌঁছালাম। মাঝে ছোট্ট একটি শহরে অল্প কিছুক্ষণের জন্য থেমে ছিল আমাদের বাসটি। ড্রাইভার আমাদের জাগিয়ে দিলেন। বাস বদল করতে হবে।  এক ঘণ্টা বিরতি। এ দেশের বাস স্টেশনগুলোতে বাথরুম ছাড়াও বিনামূল্যে খাবার পানির ব্যবস্থা থাকে, যা সাধারণত বাথরুমের বাইরে কল থেকে সংগ্রহ করতে হয়। পানির পিপাসা মিটিয়ে ওয়েটিং লাউঞ্জে বসে রইলাম। চোখ খুলে রাখতে পারছি না। কিন্তু ঘুমাতেও পারছি না। ওয়েটিং লাউঞ্জের এক প্রান্তে ছোট্ট একটি বাচ্চা উচ্চৈঃস্বরে কাদছে। কেউ কিছু বলছে না।   আমাদের মাঝে একজন খুব কাছের পাবলিক ফোন ব্যবহার করে বাংলাদেশে ফোন করবার চেষ্টা করল। কিন্তু সফল হল না। ডায়াল করতেই ওপার থেকে অপারেটর কথা বলছেন আর বন্ধুটি কিছুই বুঝতে পারছেন না। মেয়ে অপারেটরের মিষ্টি গলা। বন্ধুটি ফোনও ছাড়তে চাইছেন না। লাইন কেটে দিলেও আবার চেষ্টা করছেন বন্ধুটি। পরের বার এক পুরুষ অপারেটরের গলা শোনা গেলো, “ঐবষষড়, যড়ি পধহ ও যবষঢ়?” বন্ধুটি তড়িঘড়ি করে ফোন রেখে আমাদের কাছে চলে এলেন।

সংযুক্ত ৪৮টি স্টেটে রয়েছে চারটি টাইম জোন (ঃরসব ুড়হব) পশ্চিমে প্যাসিফিক টাইম জোন, মাউন্টেন, সেন্ট্রাল এবং সবচাইতে পূর্বে ইস্টার্ন। এক একটি টাইম জোনের সময়ের পার্থক্য এক ঘণ্টা আর প্রতিটি টাইম জোনের বিস্তৃতি পৃথিবীর বিষুব রেখাতে ১০০০ মাইলেরও একটু বেশি। তা থেকে উত্তর কিংবা দক্ষিণে এ দূরত্ব কমতে কমতে দুই মেরুতে শূন্য হয়ে যায়। অনেকটা কমলার কোষের মত। ২৪,৯০১ মাইল পরিধির এ পৃথিবীতে সর্বমোট ২৪টি টাইম জোন রয়েছে। (পরবর্তী অংশ দেখুন আগামি সোমবার)

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট