চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

বহুভাষার দেশ পাপুয়া নিউগিনি

অধ্যাপক রতন কুমার তুরী

৩০ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:১২ পূর্বাহ্ণ

কো নো একটি দেশে একাধিক ভাষার প্রচলন থাকা অস্বাভাবিক নয় তবে দেশ জনসংখ্যা যদি ব্যাপক হয় তাহলে মনে হয় বহুভাষার প্রচলন থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কয়েক লক্ষ জনসংখ্যার দেশে অসংখ্য ভাষার প্রচলন বিশ^কে অবাক করে। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশ ভারতের জনসংখ্যা প্রায় দেড়শ কোটি। দেশটিতে প্রচলিত ভাষার সংখ্যা ২২টি, অবশ্য, এতো ব্যাপক জনসংখ্যার দেশে ভাষার বৈচিত্র্য থাকবে এট্ওা স্বাভাবিক। কিন্তু যে দেশে মাত্র কয়েক লক্ষ মানুষের বাস সেখানে কয়েকটি ভাষার প্রচলন বিশ^কে অবাক করে। এমন কয়েকশ’ ভাষার দেশ হলো আফ্রিকার ছোট্ট একটি দেশ পাপুয়া নিউগিনি। জনসংখ্যা কিংবা আয়তনে কোনো দিক থেকেই দেশটি ভারতের সমান বা কাছাকাছি নয়। মাত্র ৭.৬ মিলিয়ন বাসিন্দা নিয়েও এখানে ব্যবহৃত হয় ৮৫০টি ভাষা। পুরো বিশে^ ভাষার ক্ষেত্রে এরকম বৈচিত্র্যের দেখা মেলে শুধুমাত্র এই দেশটিতেই এখন প্রশ্ন হলো, পাপুয়া নিউগিনিতে কীভাবে আসলো এতো ভাষা? সেই দেশের বাসিন্দারাই বা কীভাবে এতো বিচিত্র ভাষা আয়ত্ত করলো? পাপুয়া নিউগিনির পুরনো ভাষাগুলোকে বলা হয় ‘পা-পুয়ান’ যা আজ থেকে প্রায় ৪০ হাজার বছর আগে যেখানে প্রথম বসতি স্থাপনকারিদের মাধ্যমে সেখানকার জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। এসব ভাষা ‘পা পুয়ান’ হলেও এদের উৎপত্তির ভিত্তি কিন্তু এক নয়। আসলে, এই ভাষাগুলো আলাদা আলাদা কয়েক ডজন অসম্পর্কিত পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। এরকমও কিছু ভাষার সন্ধান এখানে পাওয়া যায়। যা কোনো পরিবারের অংশ নয়। এর শিকড় কোথায় তাও জানা যায় নি। পরবর্তীতে তথা আজ থেকে প্রায় ৩,৫০০ বছর আগে, পাপুয়া নিউগিনিতে কয়েকটি শব্দ পূর্বচীনের উপকূলীয় পিজিন ভাষা থেকে আসে। অনেক ভাষাবিদদের মতে এই ভাষার কাঠামো নিউ আয়ারল্যান্ডের একটি অস্ট্রোনেশীয় ভাষা থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে। এর ব্যবহার প্রথম শুরু হয় ঊনিশ শতকের দিকে। যখন ইউরোপ থেকে ব্যবসায়ীরা এবং তিমি শিকারীরা আসা শুরু করে। তারা তখন আঞ্চলিক লোকজনের সাথে যোগাযোগের জন্য সাধারণ কোনো মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। আর, সেখান থেকেই ভাষার একটি সহজ রূপ ঠিক করা হয়। ইউরোপের ব্যবসায়ীরা যখন বাসিন্দাদের কুইনসল্যান্ড এবং স্যামোয়ার আখের জমিতে চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করে, তখন মূলত এর ব্যবহার বিস্তার লাভ করে। কেননা, এসব শ্রমিক নিজেদের গ্রামে বা বাড়ি ফিরে, এই ভাষার প্রয়োগ করতো। অথবা তারা যখন অন্য কোথাও যেত তখন তাদের আয়ত্ত করা নতুন ভাষা আশেপাশে মানুষজনের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ফলে, ধীরে ধীরে টোক পিসিন পাপুয়া নিউগিনির গ্রামে এবং শহর এলাকায়ও জনপ্রিয়তা লাভ করে। দেশটির কিছু কিছু শহরে এটাই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। ‘টোক পিসিন’-এর প্রয়োগ রেডিও এবং টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে ও খবরের কাগজেও দেখা যায়। জাতীয় ও প্রাদেশিক সংসদে এবং গণ-বিতর্কেও এটা বহুলভাবেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। বাইবেলের একটি ভাষা, দ্য নিউ স্টেটম্যান”-কে – ‘দ্য ইভানজেলিক্যাল লুথারানস’ টোক পিসিন ভাষায় প্রকাশ করে ১৯৬৯ সালে। আর, ১৯৮৯ সালে পুরো বাইবেলকে টোক পিসিন ভাষায় প্রকাশ করে দ্য পিএনজি বাইবেল সোসাইটি। প্রকৃতপক্ষে যুগ যুগ ধরে পাপুয়া নিউগিনিতে বহুদেশের মানুষ এসে বসতি স্থাপন করার কারণে তাদের ভাষাতেও এসেছে বৈচিত্র্য। কিন্তু আফ্রিকার এই দেশটি এখনো সেই মধ্যযুগে রটে গেছে। এখানে বিজ্ঞানের ছোঁয়া তেমন একটা লাগে নি। ফলে, তাদের অনেক ভাষাই তারা কয়েকটি গোত্র কিংবা কয়েকটি পরিবার ছাড়া কেউ বোঝে না। তাছাড়া, তাদের এই ভাষাগুলো তারা আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দেয়ারও ব্যবস্থা করছে না। ফলে, তাদের বৈচিত্র্যময় এমন ভাষার অনেকগুলোই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ ভাষার দেশ পাপুয়া নিউগিনি চাইলে রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাষাগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আন্তর্জাতিক সাহায্য চাইতে পারে।

লেখক : কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক, মানবাধিকারকর্মী।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট