চট্টগ্রাম শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

দ্রব্যমূল্যের উল্লম্ফন : চাই টিসিবির ভোক্তাবান্ধব তৎপরতা

এ আর এম শামিমউদ্দিন

৩১ মার্চ, ২০২১ | ১:২৬ অপরাহ্ণ

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন থেকে কারণে অকারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। তাতে মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত জনসাধারণের জীবনযাত্রা অত্যন্ত দুর্বিসহ ও কষ্টকর হয়ে উঠে। ফলে স্বল্প আয়ের মানুষজন ছুটে চলে টিসিবির দিকে। আমি অফিসে যাওয়ার পথে প্রায়ই জামালখানে টিসিবির ন্যায্যমূল্যের মালামাল নেয়ার জন্য রোদের মধ্যে সাধারণ মানুষের দীর্ঘলাইন দেখি। তারা কাক্সিক্ষত মাল ক্রয়ের জন্যে রোদে পুড়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকে টিসিবির ট্রাকের পেছনে। এমন দৃশ্য সত্যিই কষ্টদায়ক।

সরকারের এ ব্যবস্থার পেছনে প্রধানত দুটি উদ্দেশ্য আছে। প্রথমত সাধারণ জনগণকে ন্যায্যমূল্যে প্রয়োজনীয় মালামাল সরবরাহ করা; অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে প্রভাব ফেলা। কিন্তু আমি মনে করি এ ব্যবস্থা অত্যন্ত সাময়িক এবং তা দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। স্বাধীনতার পর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অনুধাবন করতে পেরেছিলেন অসাধু ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের বিনাকারণে দ্রব্যমূল্য বাড়ানোকে প্রতিরোধ করতে হলে সরকারী উদ্যোগে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার, যেটা নাকি ন্যায্যমূল্যে জনসাধারণকে মালামাল সরবরাহ করবে।

অন্যদিকে সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে। যার ফলশ্রুতিতে তিনি ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিবিসি) প্রতিষ্ঠা করেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমরা জনগণ লক্ষ্য করছি অজ্ঞাতকারণে টিসিবিকে নির্লিপ্ত করে রাখা হয়েছে এবং যেসব মালামাল সরবরাহ করা হয় তা অত্যন্ত নিম্নমানের। ফলে বাজারমূল্যে টিসিবির প্রভাব পড়ছে না। আমরা মাঝে মাঝে লক্ষ্য করি দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য মজুতদারদের গুদামে হানা দেয়া হয় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টাও করা হয়। কিন্তু খ- খ-ভাবে এরকম ব্যবস্থা দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সহায়ক ভূমিকা রাখে না। উল্টো দ্রব্যমূল্য আরো বৃদ্ধি পায়। এ অবস্থায় সারাদেশে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে হলে কিছু সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া দরকার। যেমন- ১) টিসিবিকে অত্যন্ত শক্তিশালী করতে হবে এবং একটি সিস্টেমের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ২) রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোন বিশেষ সময়ে ন্যায্যমূল্যে মালামাল সাধারণ মানুষকে লাইন ধরে সরবরাহ করা কোন উত্তম ব্যবস্থা নয়। এতে সবাই উপকৃত হতে পারে না। মধ্যবিত্তশ্রেণি মান-সম্মানের কথা বিবেচনায় নিয়ে এই ব্যবস্থায় অংশ নেয় না। তারা সামাজিক সম্মানের কথা বিবেচনায় নিয়ে টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইন ধরতে পারে না। আবার সীমিত আয় দিয়ে সংসার চালানোও চরম কষ্টের। ৩) টিসিবিতে অর্থবল ও জনবল দিয়ে নতুনভাবে সাজাতে হবে। ৪) প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় টিসিবির স্থায়ীভাবে বিক্রয়কেন্দ্র থাকতে হবে, যাতে সারাবছর জনগণ ন্যায্যমূল্যে ভালমানের নিত্যপ্রয়োজনীয় মালামাল সহজেই টিসিবি দোকান থেকে কিনতে পারে যেখানে থাকবে কাঁচাবাজার, শুকনাবাজার, মাছ, মাংস ইত্যাদি মালামাল। ৫) সরকার উন্নয়নের জন্য বড় বড় প্রজেক্ট গ্রহণ করেছে এবং বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করছেন। সাধারণ জনগণকে ন্যায্যমূল্যে পণ্য ক্রয়ের সুযোগ দিতেও কিছু সুচিন্তিত ও ফলপ্রসূ প্রজেক্ট হাতে নেয়া দরকার। ৬) টিসিবির দেশী-বিদেশী মালামাল ক্রয়ে সরকারের কঠোর নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। যৌক্তিক মূল্যে, কোয়ালিটিসম্পন্ন মালামাল ক্রয় ও আমদানী করতে হবে। অতীতে আমরা সংবাদপত্রের মাধ্যমে জেনেছি টিসিবি পোকাযুক্ত চাউল, ময়দা, আটাসহ নানা নিম্নমানের পণ্য বিক্রয় করেছে। এতে টিসিবির মালামালের প্রতি জনসাধারণের অনীহা সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতির উন্নতি একান্ত প্রয়োজন। ৭) বাংলাদেশ সংবিধানের ১৫ (ক) ধারা অনুযায়ী সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা করা সরকারের দায়িত্ব। অতএব এই মৌলিক চাহিদার মধ্যে টিসিবির মাধ্যমে প্রতি জেলা ও উপজেলায় বিক্রয়কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে মালামাল ন্যায্যমূল্যে বিক্রয় করলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। ৮) শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মালিকানা ব্যবস্থার পাশাপাশি কাজ করলে একটি ভাল সুফল পাওয়া যায়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- চিকিৎসা, ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও যাতায়াত ব্যবস্থায় মানুষ সুফল পাচ্ছে। তবে এ ব্যাপারেও বলা যায় কোন কোন ক্ষেত্রে দুর্বল রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার কারণে রাষ্ট্রের ভাল উদ্দেশ্য ব্যাহত হয় ও প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে তার উদ্দেশ্য বিনষ্ট করে দেয়। এজন্য সরকারী মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরসমূহ মনিটরিং ও সুপারভিশন শক্তিশালী করতে হবে। ৯) কৃষকের কাছ থেকে সরকার ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় সকল মালামাল ক্রয় করে টিসিবির বিক্রয়কেন্দ্রের মাধ্যমে বিক্রয় করলে দ্রব্যমূল্য অবশ্যই নিয়ন্ত্রণে আসবে। তবে পাশাপাশি কৃষকের কাছ থেকে মালামাল সংগ্রহ করে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ীদের অসৎ উদ্দেশ্যকে নিয়মিত কঠোর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ১০) টিসিবির জন্য বিদেশ থেকে মালামাল ক্রয়ে এলসি খোলার সময়ে ভাল মালামাল, সঠিক দামে, সঠিক দেশ থেকে ক্রয় করা হচ্ছে তা কিনা কঠোর নজরদারী রাখতে হবে। এবং মাল দেশে পৌঁছার পর বা গুদামে পৌঁছার পর এলসি অনুযায়ী মালামালের সার্ভে ও তদন্ত নিয়মিত চালু রাখতে হবে।

আমরা আশা করতে চাই, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে মুনাফাশিকারীদের অপতৎপরতা রোধ করতে এবং বাজারকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে রাখতে সরকার টিসিবিকে জনমানুষের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়াসহ প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপই গ্রহণ করবে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এটাই সাধারণ ভোক্তাদের একমাত্র চাওয়া।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট