চট্টগ্রাম মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চিকিৎসার নামে প্রতারণা : সমাধান কোন পথে

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক

১৯ মার্চ, ২০২১ | ৩:১৬ অপরাহ্ণ

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে যত উন্নতি সাধিত হচ্ছে ততই লাফিয়ে বাড়ছে চিকিৎসার নামে প্রতারণা। গ্রাম, মহল্লা পেরিয়ে শহরের অলিতে-গলিতে পর্যন্ত হাতুড়ে চিকিৎসকদের দৌরাত্ম্য যেন রীতিমত ভয়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাথে আছে কবিরাজি, স্বপ্নের ওষুধ, বনাজি, পাহাড়ী ওষুধের ভয়ানক সয়লাব। চট্টগ্রাম শহর থেকে ১৪-১৫ কিলোমিটার দূরে ইসলামিয়াহাট নামক জায়গায় হাতুড়ে হাঁড়ভাঙ্গা চিকিৎসা করা হত এককালে। ক্রমেই ভুক্তভোগীদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় হাতুড়ে হাঁড়ভাঙ্গা চিকিৎসকরা আস্তানা গুটিয়ে পালিয়েছে, যা এখন দেখা যায় না বললেই চলে।

আমরা ছোটবেলায় ইসলামিয়া হাটের নাম প্রচুর শুনেছি, গাছ থেকে কেউ পড়ে গেলে অথবা গ্রাম্য বিবাদে আহত ব্যক্তিদের এখানে নিয়ে আসা হত। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে এক ধরনের ব্যান্ডেজ দিয়ে রাখা হত রোগীদের, ফলশ্রুতিতে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে হাত বা পায়ে গ্যাংগ্রীন বা পঁচন ধরে যেত। যখন রেজিস্টার্ড অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে নিয়ে আসা হয় তখন দেখা যায়, সমুদ্রের পানি অনেক গড়িয়েছে, বাধ্য হয়ে সার্জনরা পঁচনশীল নির্দিষ্ট অঙ্গ কেটে ফেলতেন। এভাবেই অনেক অসহায়, দরিদ্র মানুষ এমনিতর গুরুতর অপচিকিৎসার কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়েছেন অথবা না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

তবে আশার কথা, আধুনিক চিকিৎসার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হওয়ার সাথে সাথে তথাকথিত হাঁড়ভাঙ্গা চিকিৎসা, বনাজি, গাছ-গাছালি চিকিৎসা বলতে গেলে অনেক হ্রাস পেয়েছে। ওদিকে মাছের কাঁটা তোলার নামে অভিনব প্রতারণা করে চলেছে অর্ধবয়সী কয়েকজন মহিলা চট্টগ্রামের হাটহাজারীর অধীন চড়ারকূল নামক জায়গায়। এ প্রতারণাটা এখনো জিইয়ে রেখেছে কতিপয় দালাল প্রকৃতির মানুষ, গ্রাম্যমাতব্বর, বিপথগামী রাজনৈতিক কর্মী। বিগত ৩০ বছর ধরে এ প্রতারণা প্রশাসনের নাকের ডগায় চলে আসলেও উল্লেখিত দালালচক্র লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। শুধু চড়ারকূল নয়, নন্দিরহাট নামক জায়গায়ও কাঁটা তোলার নামে এ অপচিকিৎসার আস্তানা এখনো চালু রয়েছে। আজ থেকে ১৫ বছর আগে এ ব্যাপারে দৈনিক পূর্বকোণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তৎকালীন হাটহাজারী সার্কেল এর এএসপি বাবুল আক্তার কোন সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে এ অপচিকিৎসার কেন্দ্রসমূহ বন্ধ করতে পারেননি।

বাঙালি জাতি সহজ-সরল প্রকৃতির, তারা সহজেই মানুষকে বিশ্বাস করে নেয়। এ সুবাদে প্রতারকগণ তাদের দুষ্কর্ম অব্যাহত রাখতে পারছে। প্রতিদিন অসংখ্য ভুক্তভোগীর সাক্ষাৎ পাই, যারা অপচিকিৎসার কবলে পড়েছেন। এমনও দেখা গেছে মাছের কাঁটা বিধেছে ১টি কিন্তু বের করে আনা হয় ২ থেকে ৩টি, আবার ব্যক্তিবিশেষের গলায় বিদ্ধ নির্দিষ্ট কাঁটার বদলে অন্য মাছের কাঁটা বের করে আনা হয়, যা প্রতারণার জ্বলন্ত উদাহরণ। এরপরও সাধারণ মানুষ ওসব প্রতারকের কবলে পড়ে নিমিষেই। যে ব্যক্তির মাছের কাঁটা বিধেছে ১২ বছর আগে তাও তুলে আনারও দুঃসাহস দেখান এক প্রতারক মহিলা। প্রতিটি ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ থেকে কাঁটা তোলার নামে ৫০০ টাকা দাবী করে সে। গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করে সাধারণ মানুষকে প্রতারিত করার মাধ্যমে।

শরীরের যে কোন অংশে কাঁটা বিধলে তা অবশ্যই বের করে আনতে হবে। নয়তো বা তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়। এভাবে কয়েকদিন থাকলে ইনফেক্শন হয়ে যায়। আর ইনফেক্শন হলেই পুঁজ হয়ে পঁচন ধরে যায়। আর কাঁটা  হচ্ছে শরীরের জন্য অপ্রত্যাশিত বস্তু। তাই কাঁটা বিধলেই শরীর রিএ্যাক্ট করবেই। উক্ত মহিলা ঝাড়-ফুঁক দিয়ে যে চিকিৎসা করছেন, তা বিজ্ঞানসম্মত নয়। এ ধরনের রোগী আমার চেম্বারে অনেক আসেন, তাঁদের কাছ থেকে ঘটনা শুনে বিজ্ঞানভিত্তিক দিকটি তুলে ধরি এবং উক্ত ভুক্তভোগী রোগীদেরকে প্রতারণার বিষয়টি বোঝাতে সক্ষম হই। এভাবে যদি প্রত্যেক নাক, কান, গলা বিশেষজ্ঞগণ ভুক্তভোগীদের মোটিভেশন করার চেষ্টা করেন, তাহলে এধরনের অপচিকিৎসা বন্ধ করার পথ খুঁজে পেতে বেগ পেতে হবে না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসন উদ্যোগ নিলে অনেক নিরীহ সাধারণ মানুষ প্রতারকদের খপ্পর থেকে নিজেকে ও সমাজকে বাঁচাতে পারবে। তবে এ ব্যাপারে জনসচেতনা বেশী প্রয়োজন।

লেখক: ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট