চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

মি’রাজুন্নবীর (সা.) সেই চির তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা

মনিরুল ইসলাম রফিক

৪ মার্চ, ২০২১ | ৩:০১ অপরাহ্ণ

ইসলামের মহান নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে মি’রাজ সেই সব ঘটনার অর্ন্তভুক্ত, যেগুলো বিশ্বে সর্বাধিক প্রসিদ্ধ লাভ করেছে। সাধারণ বর্ণনা অনুযায়ী  এই ঘটনা হিজরতের আনুমানিক এক বছর আগে ২৭ রজবের  রাতে সংঘটিত হয়েছিল। কুরআন পাকেও এই ঘটনার উল্লেখ হয়েছে এবং হাদীস শরীফেও । মি’রাজ কি কারণে হয়েছিল এবং আল্লাহ তায়ালা তাঁর রাসূল (সা.) কে ডেকে নিয়ে কি হিদায়েত দিয়েছিলেন, তা কুরআন বলে দিয়েছে। মি’রাজ কিভাবে হলো আর এ সফরে কি ঘটনা ঘটেছিল, তা হাদীস শরীফে ব্যাখ্যা রয়েছে।

পবিত্র সূরা বণী ইসরাঈলে বলা হয়েছে: পরম পবিত্র মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাত্রি বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন  মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত  যার চারিদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দেই। নিশ্চয় তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনশীল।’

সূরা নাজমে বলা হয়েছে : অত:পর নিকটবর্তী  হলো ও ঝুঁকে গেল। তখন দুই ধনুকের ব্যবধান ছিল অথবা আরো কম। তখন আল্লাহ তার বান্দার প্রতি যা প্রত্যাদেশ করবার তা প্রত্যাদেশ করলেন। রাসূল (সা) এর অন্তর মিথ্যা বলেনি যা তিনি দেখেছেন। তোমরা কি বিষয়ে বিতর্ক করবে যা তিনি দেখেছেন?’ (আয়াত : ৮-১২)

মি’রাজের বিস্তারিত বিবরণ সমসাময়িককালের ২৮ জন রাবীর মধ্যমে আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। এর মধ্যে ৭ জন বর্ণনাকারী স্বয়ং মি’রাজের যুগে বর্তমান ছিলেন। আর ২১ জন বর্ণনাকারী এমন ছিলেন, যারা পরে  রাসূলে করীম (সা.) এর জবান মুবারকে মি’রাজের ঘটনা শুনেছিলেন। বর্ণনাকারীদের বিভিন্ন বর্ণনা ঘটনাটির বিভিন্ন দিকের উপর আলোকপাত করে। সবগুলো মিলালে এমন একটি সফরনামার বিবরণ তৈরী হয়, যার চেয়ে অধিক হৃদয়গ্রাহী, অর্থবহ ও দৃষ্টি আকর্ষণকারী সফরনামা মানবসাহিত্যের ইতিহাসে আর একটিও  পাওয়া যায়না।

হযরত মুহাম্মদ (সা.) রিসালাত প্রাপ্ত হয়েছেন ১২ বছর আগে যখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর। কারো কারো বর্ণনা মতে, ক্বাবার হারাম শরীফে তিনি শুয়েছিলেন। এমন সময় হঠাৎ ফেরেশতা জিবরাঈল (আ.) এসে  সালাম দিয়ে তাঁকে জাগালেন। আধা ঘুম আধা জাগরণ অবস্থায় তাঁকে জমজম কুপের নিকট নিয়ে গেলেন। সিনাসাক (বক্ষ বিদারণ) করলেন। জমজমের পানি দিয়ে তা ধুয়ে নিলেন। তারপর তাঁকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সহিষ্ণুতা, ঈমান ও ইয়াকীনে ভরে দিলেন। এরপর তার আরোহণের জন্য জীব পেশ করা হলো। এর রং ছিল সাদা। আকারে খচ্ছরের চেয়ে কিছু ছোট ছিল। বুরাক বা বিজলির গতিতে চলতো। এই সাদৃশ্যের কারণে এর নাম বুরাক দেয়া হয়েছিল। তিনি যখন আরোহণ করতে যাচ্ছিলেন বুরাক চমকে উঠেছিল। জিব্রাইল (আ.) তখন ধমক দিয়ে বললেন, দেখ তুমি কি করছো, আজ পর্যন্ত হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মতো কোন ব্যক্তিত্বশালী  মানুষ তোমার পিঠে অরোহণ করেনি। এরপর তিনি এর উপর আরোহণ করলেন। জিব্রাইল (আ.) তার সাথে চললেন। প্রথম মঞ্জিল ছিল মাদীনাতুল মুনাওয়ারা। এখানে অবতরণ করে তিনি নামায পড়লেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এখানে আপনি হিজরত করে আসবেন। দ্বিতীয় মঞ্জিল ছিল মুসা নবীর (আ.) পূণ্য স্মৃতিবিজড়িত সিনাই উপত্যকা। তৃতীয় মঞ্জিল ছিল বেথেলহাম। এখানে হযরত ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন। চতুর্থ মঞ্জিল ছিল বায়তুল মুকাদ্দাস। এখানে অসংখ্য নবীর কবর, বিশেষ করে হযরত ইবরাহীম ও তার সন্তান নবী ইসহাক (আ.) এর মাজার। এখানে বুরাকের মাধ্যমে সফরের প্রথম পর্ব শেষ হয়। এই সফর চলাকালে এক জায়গায় কোন আহবানকারী আহবান করে বললো: এদিকে এসো। তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না। জিব্রাইল (আ.) বললেন, সে অপনাকে ইহুদীবাদের দিকে আহবান করছিল। আর একদিক থেকে আওয়াজ এলো, এদিকে এসো। তিনি সেদিকেও লক্ষ্য করলেন না। জিব্রাইল (আ.) বললেন সে আপনাকে ঈসাইয়াতের দিকে আহবান করছিল। এরপর খুব সাজগোজ করা নারী নজরে পড়লো। সেও নিজের দিকে আহবান জানালো। তিনি তার দিকেও ফিরে তাকালেন না। জিব্রাইল (আ.) বললেন এ হলো পার্থিব জগত। এরপর একটি বৃদ্ধা নারী সামনে এলো।

জিব্রাইল (আ.) বললেন দুনিয়ার বয়স এর বয়স থেকে অনুমাণ করে নিন। এরপর আরো একটি লোক এলো, লোকটিও তাকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে চাইলো। কিন্তু রাসুলে করীম (সা.) তাকে অতিক্রম করে আগে অগ্রসর হলেন। জিব্রাইল (আ.) বললেন, এ ছিল শয়তান। এর অভিপ্রায় ছিল আপনাকে বিপদগামী করা। বায়তুল মুকাদ্দাস পৌঁছে তিনি বুরাক থেকে নেমে গেলেন। এখানে তিনি সেই জায়গায় বুরাক বাঁধলেন, যেখানে অন্যান্য নবীগণও বাঁধতেন। হায়কালে সুলায়মানীতে প্রবেশ করলে সৃষ্টির শুরু থেকে আরম্ভ করে ওই সময় পর্যন্ত যত নবী-রাসূল (আ.) দুনিয়াতে জন্মগ্রহণ করেছেন, সকলকে এখানে উপস্থিত পেলেন। তিনি এখানে পৌঁছা মাত্রই নামাজের কাতার দাঁড়িয়ে গেল। ইমামতি করার জন্য কে আগে অগ্রসর হবেন, সকলে এই অপেক্ষায় ছিলেন। জিব্রাইল (আ.) হাত ধরে তাকে আগে বাড়িয়ে দিলেন। তিনি সকলের নামায পড়ালেন, হলেন নবীদের নবী, ইমামদের ইমাম, সাইয়্যেদুল আম্বিয়া। এরপর একটা সিড়ি তাঁর সামনে পেশ করা হলো। জিব্রাইল (আ.) তাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে আকাশের দিকে চলে গেলেন। আরবী ভাষায় সিঁড়িকে মি’রাজ বলা হয় এবং সামঞ্জস্যের কারণে এই পূর্ণ ঘটনা মিরাজ নামে খ্যাত হয়েছে ।

প্রথম আকাশে পৌঁছে তারা দরজা বন্ধ পেলেন। দ্বাররক্ষী ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করলেন- কে আসছেন? জিব্রাইল তাঁর নিজের নাম বললেন। জিজ্ঞেস করলেন আপনার সাথে কে আছেন? উত্তরে জিব্রাইল (আ.) বললেন, মুহাম্মদ (সা.)। তারা জিজ্ঞেস করলো, তাকে কি ডেকে পাঠানো হয়েছে? বললেন, হ্যাঁ ডেকে পাঠানো হয়েছে। তারা দরজা খুলে দিলেন। এখানে হৃদয় নিংড়ানো সংবর্ধনা জানানো হলো। এখানে অবস্থানরত ফেরেশতাকুল ও মহামানবদের রূহের সাথে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। এখানে এদের মধ্যে খুবই শানদার উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের একজন মহামানব ছিলেন। মানবীয় গঠনের পরিপূর্ণ নমুনা ছিলেন তিনি। জিব্রাইল (আ.) বললেন, ইনি হলেন আদম (আ.)। আপনার সর্বপ্রথম পূর্বসুরী। এই মহামানবের আশেপাশে আরো অনেক লোক ছিলেন, তিনি ডান দিকে তাকালে খুশী হতেন, আর বাঁ দিকে তাকালে কেঁদে ফেলতেন। জিজ্ঞেস করলেন এর রহস্য কি ? উত্তরে বলা হলো এরা আদম সন্তান। আদম (আ.) তার নেক সন্তানদের দেখে খুশী হতেন। আর খারাপ সন্তানদের দেখলে কেঁদে ফেলতেন। তারপর তাকে বি¯তারিত দেখার সুযোগ দেয়া হলো। এক জায়গায় তিনি দেখলেন কিছু লোক ফসল কাটছে। আর যত কাটে ততই তা বেড়ে চলে। জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? উত্তরে বলা হলো, এরা আল্লাহর পথে জিহাদ করতেন। তারপর দেখলেন পাথর দিয়ে কিছু লোকের মাথা চুর্ণ করে দেয়া হচ্ছে। জিজ্ঞেস করলেন এরা কারা? বলা হলো যাদের অলসতা তাদেরকে নামায পড়ার জন্য উঠতে দিতনা। আরো কিছু লোক দেখলেন, যাদের পোশাকের সামনের ও পিছনের দিকে তালি লাগানো ছিল। তারা জানোয়ারের মত ঘাস খাচ্ছিলো। জিজ্ঞেস করলেন, এরা কারা? বলা হলো এরা মালের যাকাত খয়রাত কিছুই দিতনা। (আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)

লেখক: মনিরুল ইসলাম রফিক অধ্যাপক, টিভি উপস্থাপক ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত খতীব।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট