চট্টগ্রাম শনিবার, ২০ এপ্রিল, ২০২৪

সর্বশেষ:

চট্টগ্রামে বিদেশী শিক্ষার্থীদের ‘মেডিকেল এডুকেশন ট্যুরিজম’ ও সম্ভাবনা

মিরাজুল ইসলাম

১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ | ১:১৯ অপরাহ্ণ

উপমহাদেশে শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাস খুঁজতে গেলে সবার আগে মনে পড়বে প্রাচীন ভারতের মগধ রাজ্যে খৃস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে প্রতিষ্ঠিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। একই ধরনের শিক্ষাকাঠামোয় চট্টগ্রামে প্রাচীন শিক্ষাব্যবস্থায় উল্লেখ পাওয়া যায় ‘পন্ডিত বিহার’ নামের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। তিব্বত ও বৌদ্ধসংস্কৃতি বিশেষজ্ঞ শরচ্চন্দ্র দাস এবং অন্যান্য গবেষকদের মতে খৃস্টীয় ৮ম শতকে এই পন্ডিতবিহার ছিল বঙ্গ-সমতট-হরিকেল অঞ্চলে পালবংশ থেকে শুরু করে সেনবংশ অব্দি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম বিষয়ে শিক্ষা ও মতবাদ প্রচারের প্রাণকেন্দ্র। ইতিহাস সাক্ষী দেয় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু বৌদ্ধপ-িত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে জ্ঞানলাভ করতে আসতেন।

এরপর দীর্ঘ বিরতিতে চট্টগ্রামে শিক্ষাব্যবস্থা মূলত সীমাবদ্ধ ছিল ধর্মভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে। মুসলমানদের মক্তব-মাদ্রাসা, হিন্দুদের টোল-পাঠশালা ও বৌদ্ধদের বিহারভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল আঠারোশত শতক অব্দি। চট্টগ্রামে বৃটিশ শাসনামলে ইউরোপিয়ান ঘরানার শিক্ষাব্যবস্থা প্রথম চালু হয়। মূলত ১৮১৩ সালে বৃটিশ পার্লামেন্টে ভারতে শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সনদ পাশ হবার পর মিশনারীরা উদ্যোগ গ্রহণ করেন শিক্ষার প্রসারে। তার ধারাবাহিকতায় ১৮৩৬ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘চট্টগ্রাম জিলা স্কুল’।  পরবর্তীতে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদ্রাসা ও কলেজপর্যায়ে শিক্ষাব্যবস্থার বিস্তার ঘটলেও উচ্চশিক্ষার প্রসারের জন্য চট্টগ্রামবাসীকে অপেক্ষা করতে হয় বৃটিশ শাসনের অবসান পর্যন্ত। অথচ প্রাচীন কাল থেকে শিক্ষাব্যবস্থার যে কোন পর্যায়ে শিক্ষা গ্রহণের জন্য চট্টগ্রামের ভূ-প্রকৃতি ও আবহাওয়ায় আকৃষ্ট হয়েছিলেন অন্যান্য অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে অন্যতম বৃহত্তম বন্দর হিসেবে চট্টগ্রামের অবস্থানগত ও বাণিজ্যিক গুরুত্বের কারণে এই অঞ্চলে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেতে আগ্রহী শিক্ষার্থীরা উন্মুখ থাকতেন।

চট্টগ্রামের নগরায়ন পরিবেশ ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্যমন্ডিত। পৃথিবীতে খুব নগরীতে এমন বৈচিত্র দৃশ্যমান। এক সাথে পাঁচটি প্রাকৃতিক উপাদান এই নগরীতে বিদ্যম্যান। তা হলো- সাগর, নদী, পাহাড়, হ্রদ ও বনভূমি। সেই সূত্রে চট্টগ্রামের প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হন দেশী-বিদেশী পর্যটকরা।

কিন্তু হাজার বছরের আন্তর্জাতিক পরিচিতি থাকলেও যথার্থ পরিকল্পনা ও ভৌত অবকাঠামোগত সুবিধাদির অভাবে নগর চট্টগ্রাম বিশ্বমানচিত্রে এখনো ‘আকর্ষণহীন’। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও অবারিত সম্ভাবনা থাকা সত্বেও চট্টগ্রামের পিছিয়ে পড়া ক্রমাবনতির ধারায় একটি ভিন্ন ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম তার ঐতিহাসিক সুনাম বজায় রাখার ইঙ্গিত দিচ্ছে। তা হলো- মেডিকেল শিক্ষাব্যবস্থায় চট্টগ্রামের কদর ও চাহিদা। স্বাস্থ্যসেবা খাতে উচ্চশিক্ষায় চট্টগ্রামের বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে বিদেশী শিক্ষার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিকতাকে নতুন করে মনে করিয়ে দিচ্ছে।

ভারত, নেপাল, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্যখাতের বিশাল অংশ মেডিক্যাল ট্যুরিজম তথা বিদেশী রোগীদের উপর নির্ভরশীল। একইভাবে চট্টগ্রামের চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থায় গত তিন দশকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের আগমনে নগরীর চালচিত্র যথেষ্ট বদলে গেছে।

চট্টগ্রামে আধুনিক চিকিৎসা শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয় বেশীদিন হয় নি। ১৯২৭ সালে আন্দরকিল্লায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ভবনে প্রথম চালু হয় ‘চট্টগ্রাম মেডিকেল স্কুল’। এলএমএফ ডিগ্রী প্রদান করা হতো তখন। সেই প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা চিকিৎসকদের চাহিদা বৃদ্ধি হওয়ায় ১৯৫৭ সালের ৬ আগস্ট সর্বপ্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় চকবাজারস্থ চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ ভবন। ১৯৬২ সালে প্রথম এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করেন ১২ জন চিকিৎসক।

দেশ স্বাধীন হবার পর সরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে নির্দিষ্ট কোটায় সীমিতসংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারতেন। তবে বিদেশী শিক্ষার্থীদের আগমনের চিত্র পুরোপুরি বদলে যায় ১৯৯১ সালে। ফয়’স লেক এলাকায় প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম বেসরকারী মেডিকেল কলেজ ‘ইনস্টিটিউট অব এপ্লাইড হেলথ সায়েন্সে’ সর্বপ্রথম বিদেশী শিক্ষার্থী হিসেবে নেপাল থেকে দুইজন ও প্যালেস্টাইন থেকে দুইজন মোট চারজন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন। এটি তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ছিল।

মেডিকেল কলেজটি ১৯৯২ সালে স্বতন্ত্র বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় ইউএসটিসি’র মেডিসিন ফ্যাকাল্টিতে একীভূত হয়। এরপর থেকে ক্রমে বিদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় ইউএসটিসি। জাতীয় অধ্যাপক ডা. নূরুল ইসলাম ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা। নেপাল থেকে আগত দুই শিক্ষার্থীর নাম ছিল যথাক্রমে শামা থাপা ও মারিয়া শ্রেষ্ঠা। তাদের পথ অনুসরণ করে পরবর্তী ত্রিশ বছর প্রায় দুই হাজার নেপালী ছাত্র-ছাত্রী চট্টগ্রামের আলো-বাতাসে চিকিৎসক হবার সুযোগ পেয়েছেন। কেবল নেপাল থেকে নয়, অন্যান্য দেশের মধ্যে ভারত, প্যালেস্টাইন, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া, শ্রীলংকা, ভূটান থেকে উল্লেখযোগ্য শিক্ষার্থী ইউএসটিসি’তে ভর্তি হন। তবে কিছুটা ভৌগোলিক সমিলতার কারণে নেপাল থেকে শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামে এসেছে বেশী।

বিদেশী ছাত্রদের চট্টগ্রামকে বিশেষ পছন্দ করবার ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামের অদূরে চন্দনাইশ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত বিজিসি ট্রাস্ট মেডিক্যাল কলেজে নেপালী শিক্ষার্থীরা প্রথম ভর্তি হন ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে। সেই বছর ২৮জন নেপালী শিক্ষার্থী চিকিৎসক হবার স্বপ্ন নিয়ে চট্টগ্রামে আসেন। ইতিমধ্যে মোট ৪৭ জন নেপালী ছাত্র সেই প্রতিষ্ঠান থেকে চিকিৎসক হিসেবে কৃতকার্য হয়েছেন।

বিভিন্ন সময়ে চট্টগ্রামে বাণিজ্য ও বসত গড়তে এসেছিলেন আরব, আফ্রিকা, পর্তুগীজ, ডাচ, আরাকানী, আফগানী, ইংরেজ, মুঘলসহ নানা জাতের নাগরিকগণ। ভিন্ন বেশে ভিন্ন ভূমিকায় তারা চট্টগ্রামে আশ্রয় নিয়েছেন। চট্টগ্রাম সূত্রে লাভবান হয়েছেন। চট্টগ্রামের সেই ক্ষমতা ছিল এবং এখনো আছে সকল বিদেশীদের আপন করে নেবার। কিন্তু বিগত দশকে নীতি নির্ধারকদের অদূরদর্শিতায় সঠিক সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামের পক্ষে যায় নি।

তবে আমরা লক্ষ্য করেছি, শতবছরের পরিক্রমায় বাণিজ্য এখন ভর করেছে উচ্চশিক্ষাব্যবস্থায়। বিশেষ করে মেডিক্যাল শিক্ষাব্যবস্থা সূত্রে চট্টগ্রাম নানা কারণ ও নিয়ামকের জন্য বিদেশী শিক্ষার্থীদের পছন্দের শীর্ষে। নগরীর বেসরকারী মেডিকেল কলেজগুলোতে বিপুলসংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর ভর্তি হতে আসলেও সেই তুলনায় চট্টগ্রামের চিকিৎসাব্যবস্থা তথা হাসপাতাল পরিকাঠামো এখনো আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারে নি। তবে সম্প্রতি কিছুটা পরিবর্তনের আভাস পাওয়া গেলেও মেডিক্যাল ট্যুরিজমের আন্তর্জাতিক সমমানে পৌঁছাতে পারে নি। কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে যদি দক্ষ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সহজ ও সফল করা যায় তবে হয়তো এডুকেশন ট্যুরিজমের মতো মেডিক্যাল ট্যুরিজমেও চট্টগ্রাম এগিয়ে যেতে পারে।

২০১৩ সালে ‘এশিয়ান মেডিক্যাল ট্যুরিজম এনালাইসিস’-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে এই খাতে ৮.৫ বিলিয়ন ইউএস ডলার পরিমাণ অর্থ আয় করেছে ভারত, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যা-ের হাসপাতালগুলো। ২০১২ সালে ভারত আয় ক রেছে বিদেসী রোগীদের কাছ থেকে ২.২ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সেই বছরই সিঙ্গাপুরের জিডিপি’তে চিকিৎসা খাত থেকে আয় হয়েছে ১.৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার।

সেই তুল্যমূল্য ও বাণিজ্যিক বিবেচনায় আন্তর্জাতিক মানদন্ডে বাংলাদেশের অবস্থান নেই বললেই চলে। অথচ সম্ভাবনাময় সেবা খাতটি শিল্প হিসেবে স্বাস্থ্যসেবায় যুক্ত হতে পারতো। সেই সুযোগ সীমিত থাকলেও তা থেকে যাচ্ছে অধরা। বিপুলসংখ্যক বিদেশী শিক্ষার্থী এই এলাকায় শিক্ষা লাভ করতে পারলেও বিদেশী রোগীরা তথা নাগরিকরা আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে অনাগ্রহী। যেহেতু আমাদের নিজেদেরই চাহিদার তুলনায় চিকিৎসক ও সেবাকর্মীর অভাব রয়েছে।

অন্যদিকে শিক্ষাখাতে বিদেশী শিক্ষার্থীরা চিকিৎসকের স্বীকৃতি পেতে পারলেও আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা তার সাথে আনুপাতিক হারে তাল মেলাতে এখনো যোগ্য হয়ে ওঠে নি। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ তাদের স্বাস্থ্যখাত’কে শিল্পখাত হিসেবে গণ্য করেছে। তারা হলো যথাক্রমে ভারত, চীন, সংযুক্ত আরব আমীরাত, ফ্রান্স, জার্মানী, থাইল্যান্ড, বৃটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর। এর মধ্যে প্রতিবেশী ভারত তাদের এগারটি প্রদেশে মেডিক্যাল ট্যুরিজমকে শিল্পখাত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।

আমাদের ক্ষেত্রেও এমন সম্ভাবনা রয়েছে, যা সফল হতে পারে উপযুক্ত পরিকল্পনা ও সার্বিক মান নিয়ন্ত্রণের দক্ষতায়। চট্টগ্রামে মেডিক্যাল কলেজগুলোতে উচ্চশিক্ষায় এডুকেশন ট্যুরিজমের সাফল্য যদি মেডিক্যাল ট্যুরিজমের পরিপূরক হিসেবে প্রতিস্থাপিত করা যেত, তবে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাতের বুনিয়াদ নিয়ে গর্ব করার সুযোগ থাকতো।

আমরা কি প্রস্তুত নিজেদের সেই পর্যায়ে উন্নীত করতে?

মিরাজুল ইসলাম লেখক, গবেষক, জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট