চট্টগ্রাম বুধবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২৪

বিংশ শতাব্দীর সুফিসম্রাট হযরত আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভান্ডারী স্মরণে

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

২৪ জানুয়ারি, ২০২১ | ২:২৫ অপরাহ্ণ

হযরত গাউছুল আজম শাহ সুফি মাওলানা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভান্ডারী হচ্ছেন প্রায়োগিক অর্থে মানবতার সার্বজনীন উপাদান তথা সত্য, সুন্দর, কল্যাণ ও আনন্দ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অসাম্প্রদায়িক স্বর্গীয় সত্তায় মুক্ত প্রেমবাদের বীজ বপনকারী এবং খোদার নৈকট্য লাভের শর্ত হিসেবে সামগ্রিক আত্মিক ও আর্থ-সামাজিক মঙ্গল সাধনের আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত যুগোপযোগী দর্শনের সূচনাকারী। বস্তুতপক্ষে পবিত্র কোরআন, হাদিস ও সুন্নাহ’র আলোকে  ইহকাল এবং পরকালের জীবন ব্যবস্থার প্রতি অবিচল আস্থা, ধারণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যে নিগূঢ় প্রেমের নিবেদন ও বন্ধন স্থাপন, জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে তার সার্বিক প্রতিফলন ঘটিয়ে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারী মানবমুক্তির পবিত্র সনদ রচনা করে গেছেন। যুক্তি ও জ্ঞানের সুচারু সম্মিলনে দেহ ও আত্মার উন্নয়নের যে মননশীল পরিক্রমা, নির্লোভ ও নির্মোহ জীবনযাত্রার কঠিন শিক্ষা এবং আরাধনার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত জাগতিক চর্চার অনুপম কৌশলে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারী’র আধ্যাত্মিকতা পবিত্র ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ-সুফিবাদকে এক গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে উন্নীত করেছে।

ধর্মের বেসাতি করে ভন্ডামি ও নষ্টামি দিয়ে যারা সহজ সরল ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার বিভিন্ন অপপ্রয়াস অব্যাহত রেখেছিল, তাদের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে একজন প্রতিবাদী সাধক হিসেবে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভা-ারী তারঁ অবস্থানকে সুদৃঢ় ও স্পষ্ট করেছেন নিষ্কলুষ, পবিত্র এবং সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য ও অনুকরণীয় এক সুমহান আদর্শ হিসেবে। বিশ্বনবী হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (স.)’র জীবনাদর্শকে ভিত্তি করে ধর্ম-কর্ম ও জীবন নির্বাহে আত্ন-নির্ভরশীল হওয়া (ফানা আনিল ফালাখ), অনর্থক কাজ-কর্ম, কথা-বার্তা পরিহার করা (ফানা আনিল হাওয়া) ও খোদার ইচ্ছাশক্তিকে প্রাধান্য দেওয়া (ফানা আনিল এরেদা)-এই তিন মহৎ গুণের সমাহারকে ব্যক্তিত্ব বিকাশের প্রধান উৎস হিসেবে চিহ্নিত করে আত্নসংযম, আত্মসমালোচনা ও নির্বিলাস জীবনের ধারাবাহিকতায় সর্বোপরি আত্মপরিপূর্ণতার পবিত্র দিগ্ধসদর্শন দিয়ে গেছেন এই মহান অলি। এখানেই তাঁর বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। প্রখ্যাত পন্ডিত এবং দেড়শত কিতাব বা গ্রন্থের রচয়িতা হযরত মুহীউদ্দিন ইবনুল আরবী (র.) বলেন, ‘হযরত রসূলে করিম (স.) এর প্রতিনিধি ছাড়া এ পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকতে পারে না। প্রতিনিধিদের মধ্যে একজন থাকেন যাঁকে কুতুব বা খুঁটি বলা যায়। কোন এক যুগে এবং কোন এক নির্দিষ্ট স্থানে তারঁ জন্ম হয়। তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক গুণাবলীর পরির্পূণতা থাকে এবং তাকে সাধারণতঃ ছাহেবে জমান বলা হয়।’

উপরোক্ত বক্তব্যের সমর্থনে বলা যায়- বিশ্বনবীর ওফাত মোবারকের প্রায় পাচঁশত বছর পরে যখন পবিত্র ইসলাম ধর্ম বহুবিধ মতবাদ ও পন্থায় বিভ্রান্ত এবং রসূলের (স.) আদর্শ বিচ্যুত এক ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অসৎ জ্ঞানভিত্তিক ধর্মচর্চা পবিত্র ইসলামকে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল, তখনই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র ইসলামকে শাশ্বত ধারায় জাগ্রত করার জন্য ৪৭০ হিজরীর পবিত্র রমজান মাসে ইরান দেশের অন্তর্গত জিলাননগরে হযরত গাউছুল আজম মহিউদ্দিন শাহ সৈয়দ আবদুল কাদির জিলানী (রা.) কে এই দুনিয়াতে পাঠান। এর প্রায় সাড়ে সাতশত বছরের অধিককাল পর আবার যখন ইসলামের আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও জগতের যথার্থ প্রচার ও প্রসারে অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বন্ধাত্ব নেমে আসতে শুরু করে এবং প্রেমবিহীন এক কৃত্রিম খোদাপ্রীতির আড়ালে ভোগবাদের ভঙ্গুর অবয়বের বিস্তার শুরু করে, তখনই এই ধরাধামে ১২৪৪ হিজরী বা ইংরেজি ১৮২৬ সালে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভা-ারীর আবির্ভাব ঘটে।

জন্মের তিন দিন পরই যখন শিশু গাউছুল আজম এর নাম রাখার আয়োজন চলছিল তখন তাঁর পিতা স্বপ্ন দেখলেন যে, হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (স.) তাঁকে বলছেন, “হে মতিউল্লাহ! তোমার ঘরে আমার প্রিয় মাহবুব আসিয়াছে। আমি তারঁ নাম আমার ‘আহমদ’ নামে আল্লাহ যুক্ত করিয়া আহমদ উল্লাহ রাখিলাম”। এভাবেই জন্মের শুরুতেই অভিনব বেলায়েতী মহিমায় হযরত গাউছুল আজম আলোকিত বিশ্বের অনুসন্ধানে অনন্ত জীবনযাত্রায় অভিষিক্ত হলেন। তাঁর বয়স যখন দু’বছর, তখনই স্বেচ্ছায় মাতৃ-দুগ্ধ পান বন্ধ করে এক অর্পূব কেরামতিতে আল্লাহপাক বর্ণিত কোরআনের আদর্শ পালন শুরু করলেন। বাল্যকালে বাংলা ও আরবী শিক্ষা নিতে গিয়ে পাঠশালায় এক অনুপম চরিত্রের অধিকারী হলেন। সকলের সাথে সম্প্রীতি, গুরুভক্তি, পাঠ্যক্রমে মনোযোগী, মিতভাষী চরিত্রের অধিকারী হয়ে এক গুণীব্যক্তিত্বের প্রকাশ অব্যাহত রাখলেন। সাতবছর বয়সে নামাজ শিখে জামাতে নামাজ আদায় করার জন্য উদ্বিগ্ন থাকতেন। লেখাপড়ায় উনি সবসময় প্রথম স্থান অধিকার করতেন।

পরবর্তীতে উচ্চশিক্ষার জন্য কলিকাতায় গমন করে ১২৬০ হিজরিতে আলীয়া মাদ্রাসায় অধ্যয়ন শুরু করেন। তিনি রাতের অধিকাংশ সময় আল্লাহর ইবাদতে ও ধ্যানে মগ্ন থাকতেন। ১২৬৮ হিজরিতে হাদিস, তফসির, ফিকহ,  হেকমত, বালাগাত, উছুল, আকায়েদ, ফিলছফা ও ফরায়েজ যাবতীয় শাস্ত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন করে আরবি, উর্দূ, ফার্সি ভাষায় পারদর্শী হয়ে কলকাতার মাদ্রাসায় শেষ পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এক্ষেত্রে হযরত গাউছুল আজম মাহবুবে সোবহানী গাউসে সমদানী হযরত সাইয়্যেদুনা আবদুল কাদের জিলানী (রা.) জ্ঞান অর্জনে বুৎপত্তি লাভের সঙ্গে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারীর জ্ঞান অর্জন ও আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির অপূর্ব মিল খুঁজে পাওয়া যায়। হযরত গাউছূল আজম মাইভান্ডারীও শিক্ষার জন্য শুধু কলিকাতায় গমন করেননি, সেখানে তিনি তারঁ জীবন যাত্রার কঠিন অনুশীলনগুলো রপ্ত করেছেন। তিনি আল্লাহ ছাড়া কারও মুখাপেক্ষী না হয়ে এমনকি জায়গীরও না থেকে নিজের চেষ্টায় প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সাধনা অব্যাহত রেখেছিলেন।

১২৬৯ হিজরী সনে যশোরে কাজী পদে এবং বছরখানেক পরে তা ত্যাগ করে মাদ্রাসায় প্রধান মোদারেছ হিসেবে যোগদান হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারীর পেশাগত জীবনের সুউচ্চ মর্যাদায় আসীন হওয়ার স্বাক্ষ্য বহন করে। পরবর্তীতে পবিত্র বাগদাদ শরীফের হযরত গাউছূল আজম (রাঃ) বংশধর এবং কাদেরীয়া ত্বরীকত খেলাফত প্রাপ্ত গাউছে কাওনাইন শেখ সৈয়দ আবু শাহমা মোহাম্মদ সালেহ কাদেরী লাহোরী ও তারঁ অগ্রজ চির কুমার শাহ সৈয়দ দেলওয়ার আলী পাকবাজ এর সংস্পর্শে এসে হযরত গাউছুল আজম আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভা-ারী ফয়েজ ও কামালিয়াত প্রাপ্ত হন। এ প্রসঙ্গে হযরত জা’ফর ছাদেক (র.)’র উদ্বৃতি টেনে বলা যায়, আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ তা’আলা (নিজ বান্দাগনের মধ্য হইতে) যাহাকে ইচ্ছা স্বীয় রহমতের সহিত বিশিষ্ট (খাছ) করিয়া থাকেন”। সকল ইবাদত, রিযাজত ও কেরামতের মাধ্যমে পরবর্তীতে হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারী তাঁর জীবদ্দশায় এবং তিরেধানের পরও সকলের জন্য সকল সময়ে এ সত্যই প্রতিষ্ঠা করেছেন।

প্রখ্যাত ইসলামী পন্ডিত হযরত মুহীউদ্দিন ইবনুল আরবী (র.) ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন যে, “নবী করিম (দ.) এর আরবে অস্তমিত রবি এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে পুনঃউদিত হইবে। তাহাঁর নাম থাকিবে খোদার জাতি নাম আল্লাহ এর সহিত সংমিশ্রিত, নবী করিম (দ.) এর বেলায়েতী নাম আহমদ। অতএব, মনে হয় ‘আহমদ উল্লাহ’ আল্লাহর এর জাতি নাম ও নবী করিমের (দ.) বেলায়েতী নামের সংমিশ্রণ। তাহার জন্মস্থান ভূখ- মধ্য রেখার পূর্বপার্শ্বে অবস্থিত থাকিবে। উহা চীন পাহাড়ের পাদদেশে বৌদ্ধ এবং বিভিন্ন জাতির সমাবেশ স্থল হইবে। তাহাঁর আকৃতি প্রকৃতি হইবে নবীবর আহমদ মোজতবা মোহাম্মদ মোস্তফার (দ.) পূর্ণ সাদৃশ্যতার প্রতীক, তিনিও খাতেমুল অলদ হইবেন। নবীবর এর ন্যায় কোন পূত্রসন্তান জগতে রাখিয়া যাইবেন না। তাহাঁর ভাষা হইবে সংমিশ্রিত এক ভাবপ্রবণ ভাষা। তাহাঁর রহস্যময় কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, চালচলন সাধারণ লোকের পক্ষে বুঝা নিতান্তই দায় হইবে”। অছীয়ে গাউছুল আজম-সোলতানে গাউছে আজম, বেলায়েতের স্বরূপ উন্মোচক শাহসুফী হযরত সৈয়দ দেলওয়ার হোসেন মাইজভান্ডারী (ক.) কর্তৃক প্রণীত “গাউছুল আজম মাইজভান্ডারীর জীবনী ও কেরামত” গ্রন্থের উদ্ধৃতি থেকে জানা যায় যে, হযরত গাউছূল আজম মাইজভান্ডারী (ক.) সকল পবিত্র জীবনচরিত ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে হযরত মুহীউদ্দিন আরবীর (র.) ভবিষ্যত বাণীর বাস্তব প্রতিফলণ ঘটেছে।

হযরত গাউছুল আজম (ক.) মাইজভান্ডারী  নিজেই ঘোষণা করেন- “রসুলুল্লাহ (স.) দুই টুপির একটি আমার মাথায় এবং অপরটি পীরানে পীর ছাহেবের মাথায় পরিয়ে দিয়েছেন। আমার নাম পীরানে পীর ছাহেবের সাথে সোনালী অক্ষরে লেখা ছিল। আমি এবং আমার ভাই পীরানে পীর ছাহেব একদা কা’বা শরীফে ঢুকে রসূলুল্লাহ (স.)-এর বক্ষস্থলে ডুব দিলাম। দেখলাম এর অনন্ত দরিয়া”। হযরত গাউছূল আজম (ক.) মাইজভা-ারী এর বর্ণনায় স্পষ্ট যে, হযরত আবদুল কাদের জিলানী (র.) এবং তিনি ছাড়া আর কেউ গাউছুল আজম দাবী করেননি। এ বক্তব্য অবশ্যই তাঁর আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বকে দায়িত্বের সাথে প্রতিষ্ঠা করে যা আমাদের জ্ঞান বা ধারণা বহির্ভূত।

পবিত্র কোরআন মজিদ ও সুন্নাহ সম্মত সূফী ব্যবস্থার সার্বিক চর্চা পরিচর্চার মাধ্যমে জীবনের পরিপূর্ণ কল্যানের পথকেই উম্মোচন করেছেন হযরত গাউছূল আজম (ক.) মাইজভান্ডারী। মাইজভান্ডারী   দর্শনের আদর্শ উদ্দেশ্যকে ধারণ করে অসংখ্য সুফি, অলি-দরবেশ বহুকাল ধরে এ উপমহাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হেদায়েত করে আসছেন। বর্তমানে এটি স্বীকৃত ও সর্বজনবিদিত যে, মহাসাগর যেমন সকল নদী, সাগর ইত্যাদির সাবলীল স্রোতধারার অনাবিল মিলনকেন্দ্র, মাইজভান্ডার দরবার শরীফও সকল তরিকা ও মতামতকে একই লক্ষ্যবিন্দুতে পরিণত করেছে। হযরত গাউছূল আজম (কঃ) মাইজভান্ডারী যেমন ১ মাঘ জন্মগ্রহণ করেছিলেন, ৭৯ বছর বয়সে ১৩১৩ বঙ্গাব্দ (১৯০৬ সাল) তেমনি মাঘ মাসের ১০ তারিখে এই ধরাধাম ত্যাগ করেন। আজকের দিনে এ মহান অলি এবং তাঁর সুযোগ্য উত্তরসুরী হযরত বাবাভান্ডারী (র.), হযরত দেলওয়ার হোসাইন মাইজভান্ডারী (র.) ও শাহানশাহ হযরত জিয়াউল হক মাইজভান্ডারী (র.)’র প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও অজস্র সালাম নিবেদন করছি।

লেখক: প্রফেসর ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী শিক্ষাবিদ, সমাজ-

অপরাধবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

 

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট