চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৮ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

বস্তির শিশু নাঈম : এক ক্ষুদে বীর

মুহাম্মদ আবু নাসের

২৯ এপ্রিল, ২০১৯ | ১:৫২ পূর্বাহ্ণ

আমরা নিজেরা যেমনই হইনা কেন, চারদিকের মানুষজন সম্পর্কে কিন্তু আমাদের অভিযোগের অন্ত নেই। আমরা নিজেকে ছাড়া অন্য কারো মধ্যে কোন ভালোমানুষি বা গুণাবলী দেখিনা। প্রতিটি মানুষই যেন আমাদের কাছে একেকটা শয়তানের পিন্ড। যাদের অন্তঃকরণ জুড়ে শুধুই পাপাচার, দোষের আকর। মানুষগুলো খারাপ, ধান্দাবাজ, পরশ্রীকাতর, লোভী, অন্যের নামে বদনাম করে, এর বিরুদ্ধে ওর কাছে লাগায়, সংকীর্ণমনা, স্বার্থপর, হিংসুটে ও ধর্মান্ধ। শুধুই নিজেরটা ফাটায়, প্রচার করে তার অন্যের বদনাম গায়। আমাদের চারপাশের লোকজন সম্পর্কে এ ধারণা যে একেবারেই মিথ্যে, তা হয়ত নয়। তবে, এর মধ্যে অতিকথন আছে, একথাও সত্যি। আমাদের মধ্যে ভালো-খারাপ উভয়ই আছে। কিন্তু কি এক অজানা কারণে আমরা মানুষের খারাপটা নিয়ে বেশি চর্চা করি। এর অবশ্য কারণও আছে বৈকি। আবার নীরবে কর্তব্য কর্ম করে যাচ্ছেন, যতটুকু সাধ্য সাহায্য-সহযোগিতা করছেন, একজনকে উদ্ধার করে ছুটে যাচ্ছেন আরেকজনের কাছে, কোন ছবি তোলার বালাই নেই, আত্মপ্রচারের মোহ নেই, কেবলই কাজ আর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন, এমন মানুষও আছেন। আবার, বিপদাপন্ন ব্যক্তির জন্য কিছু করতে না পারার ব্যর্থতা ও অসহায়ত্বের দাঁতে-দাঁত চোপে কাঁদছেন-এমন মানুষও একেবারে বিরল নয়। বনানীর এফআর টাওয়ারে আগুন লাগার পর আমরা মানুষের জটলা দেখলাম। কিন্তু সবচেয়ে অবাক করার সে দৃশ্যটি আমাদের আবেগকে নাড়া দিয়েছে, তা হল একজন শিশুর দমকলের একটি পানির পাইপের ফুটো বা ছিদ্র বন্ধ করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা। কেউ তাকে বলেনি, দায়িত্ব দেয়নি বরং নিজ দায়িত্বের সে চেষ্টা করেছে পাইপের সেই ফুটোতে পলিথিন জড়িয়ে বন্ধ করতে, যেন পানির অপচয় না হয়। যেন আগুন নেভানোর কাজে পুরো পানিটা কাজে লাগে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ঘটা করে কত-না কৃতী ব্যক্তিকে পুরস্কৃত করা হয়, কিন্তু এই অবোধ বালকটিকে কেন রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারে ভূষিত করা হবে না? এতটুকু বয়সে এমন বীরত্ব আমাদের সমাজে কে কবে দেখিয়েছে? অগ্নিকা-ের দিন যে ছোট্ট ছেলেটিকে বনানীর রাস্তায় দেখা গেল, বিদেশি গণমাধ্যমে তাকে ‘লিটল সুপারম্যান’ বলে আখ্যা দেয়া হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখার তা-ববন্ধে পানির পাইপের লিক্ বন্ধ করে দাঁতে দাঁত চেপে বসেছিল এই সুপারম্যান! কি এমন বয়স তার, বড়োজার ১০-১১! তার নাম নাঈম। থাকে কড়াইল বস্তিতে। অভাবের সংসারে কোনো রকমে বেঁচে থেকে বস্তির আনন্দ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ে। ঘটনার দিন অনেক মানুষই কিন্তু ভিড় জমায়, মোবাইলে ছবি আর সেলফি তুলে। সে ভিড় সরাতে হিমশিম খায় দমকল আর পুলিশ। আর একজন দায়িত্বশীল শিশু তার কাজটি করেছে নিজের সমস্ত শক্তি আর আন্তরিকতা দিয়ে। নাঈমের ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। লাভ-লোভের বশবর্তী হয়ে প্রতিনিয়ত আইন অমান্য করে যখন এদেশের লেখাপড়া-জানা বড় দায়িত্বের মানুষগুলো অগণিত মানষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তখন সবধরনের ভীরুতা-কাপুরুষতা আর দায়িত্বহীনতাকে পায়ে ঠেলে নাঈম সত্যিই এক অনন্য নজির হয়ে হাজির হয়েছে। সে হাজারো সনদধারী শিক্ষিতের মাঝে এক অনন্য বীর। সবাই যখন মানবতার করুণ দৃশ্য নিয়ে সেলফি আর ভিডিও-তে মশগুল, সেখানে এই ক্ষুদে বীর মানবতার পাইপ চেপে ধরে জানান দিল এখনো শিক্ষিতদের শেখার বহু কিছু বাকি আছে। জয়তু নঈম!

লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক, সমাজকর্মী

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট