চট্টগ্রাম শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪

সর্বশেষ:

জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ : একটি পর্যালোচনা

রাবাত রেজা খান

১৯ জুন, ২০১৯ | ১২:২০ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম অর্থমন্ত্রীর পাশাপাশি বাজেট বক্তৃতায় অংশ নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী অসুস্থ, তাই প্রধানমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা পড়েছেন। বিষয়টি অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য।
নতুন অর্থমন্ত্রীর এটিই প্রথম বাজেট।
কি আছে জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এ। এ নিয়ে জাতীয় বাজেটের একটি পর্যালোচনা যেতে চাই।
জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এর মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫,২৩,১৯০ কোটি টাকা। যা চলতি ২০১৮-১৯ সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৮০,৬৪৯ কোটি টাকা বেশি।
চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ছিল ৪,৪২,৫৪১ কোটি টাকা।
সবচেয়ে বেশি ব্যয় ধরা হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ৭৯,৪৮৬ কোটি টাকা। এর পরেই আছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাত ৬৩,৬৭৯ কোটি টাকা।
সবচেয়ে কম বাজেট কৃষি খাতে ১৯,৩৫৪ কোটি টাকা।
শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে ব্যয় অন্যান্য খাতের তুলনায় বেশি। শুধুমাত্র শিক্ষা খাতেই কিন্তু এই ব্যয় নয়, প্রযুক্তি খাতের ব্যয়ও একসাথে ধরা হয়েছে। তাই, আপাতদৃষ্টিতে এই খাতে ব্যয় বেশি বলে মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু তা নয়। বরং একটি গড় ব্যয় শিক্ষা খাতে ধরা হয়েছে।
পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে যে কর্মযজ্ঞ চলছে তাতে এই খাতে ব্যয় একটু বেশিই ধরা হয়েছে।
জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এ আয় ধরা হয়েছে ৩,৮১,৯৭৮ কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি আয় ধরা হয়েছে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) থেকে। ১,২৩,০৬৭ কোটি টাকা। আয় ও মুনাফা থেকে কর ধরা হয়েছে ১,১৩,৯১২ কোটি টাকা।
জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এ ঘাটতি ধরা হয়েছে ১,৪১,২১২ কোটি টাকা। যার উৎস হিসেবে ধরা হয়েছে দেশে ব্যাংক থেকে ঋণ ৪৭,৩৬৪ কোটি টাকা, দেশে ব্যাংকের বাইরে থেকে ঋণ ৩০,০০০ কোটি টাকা এবং বিদেশি ঋণ ৬৩,৮৪৮ কোটি টাকা।
বাজেটে লক্ষ্যণীয় আয়ের অধিকাংশ উৎস হল মূল্য সংযোজন কর ও মুনাফা থেকে কর। তাই কিছু কিছু জিনিস পত্রের দাম পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে বেড়ে যাবে।
ঘাটতি পূরণ করতে বিদেশি ঋণ ধরা হয়েছে ৬৩,৮৪৮ কোটি টাকা, এতো বিশাল বিদেশি ঋণের বোঝা রাষ্ট্রযন্ত্র বইতে পুরোপুরি সক্ষম কিনা তা ভাবা জরুরি। বিদেশি ঋণ নিয়ে ব্যয় করলে সেই ঋণের টাকা শোধ করতে হবে এদেশের সাধারণ মানুষকেই। তাই সংশোধিত বাজেটে বিদেশি ঋণের ব্যাপারে সংশোধন করা যেতে পারে।
সবচেয়ে কম ব্যয় ধরা হয়েছে কৃষি খাতে যদিও কৃষি যন্ত্রে স্থানীয় ভ্যাট ছাড় দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। কৃষি খাতে আরো নজর দেওয়া উচিত না হলে খাদ্যে স্বয়ংস¤পূর্ণ বাংলাদেশ ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের যোগান দিতে ভবিষ্যতে হুমকির সম্মুখীন হতে পারে।
ধানের দাম নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিছুই বলেননি। শুধুমাত্র কৃষকদের জন্য শস্য বিমার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। তবে শস্য বিমা বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষকেরা উপকৃত হবে। বিষয়টি প্রশংসা যোগ্য। বাজেট পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় অনেক জিনিস পত্রের দাম বাড়ে কমে। দাম কমবে এমন জিনিসগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রুটি- বিস্কুট, কৃষি যন্ত্র, ক্যানসারের ওষুধ, দেশীয় লিফট, বজ্রপাত সুরক্ষা সামগ্রী, চিকিৎসায় ব্যবহৃত বিভিন্ন গ্যাস ইত্যাদি। প্রান্তিক কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উপকার হবে রুটি বিস্কুট ও কৃষি যন্ত্রের দাম কমলে। বাকি সুবিধাগুলো তাদের আহামরি কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না।
দাম বাড়বে ভোজ্যতেল, চিনি, তৈজসপত্র, বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, বিদেশি গুড়া দুধ ইত্যাদি। এই যায়গায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কপাল পুড়ছে। নিত্য প্রয়োজনীয় তেল, চিনি, বাসনকোসনের দাম বাড়লে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর দৈনন্দিন ব্যয়ে আঘাত হানবে।
এবার জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ এর একটি পোস্টমর্টেম দেখা যাক। বাজেটে জমি ও ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যারা সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি করে টাকার পাহাড় বানিয়েছে, অনৈতিক উপায়ে ও সরকারি টাকা আত্মসাৎ করে কোটি কোটি টাকা ইনকাম করেছে তাদের কাজকে আরো উৎসাহিত করার জন্য কালো টাকা সাদা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জমি ও ফ্লাট কেনায় টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন করবে না সরকার। আর ঢাকা শহরের মধ্যে জমি এবং ফ্ল্যাট বড়লোকরা এবং দুর্নীতিবাজরাই বেশি বেশি কিনতে পারে, সাধারণ কর্মচারী ও সৎভাবে চাকরি করা মানুষেরা খুব কমই ঢাকায় জমি, বাড়ি গাড়ি কিনতে পারে।
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দিয়ে দুর্নীতিবাজদের একপ্রকার উৎসাহিত করা হল বলে মনে হয়।
সোনা আমদানিতে শুল্ক কর কমেছে। পোশাক রপ্তানিতে ১% নগদ সহায়তা। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বলে মনে হয়। দেশের পোশাক শিল্পকে আরো রপ্তানিমুখী করতে এটি ভূমিকা রাখবে যা ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজনও বটে। গবেষণায় ৫০ কোটি, ফুটবলে ২০ কোটি, তরুণ উদোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকা, ভাঙনকবলিতদের জন্য ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গবেষণায় আরো বড় বাজেট প্রয়োজন ছিল। দেশের অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো তুলে আনতে ও কার্যকর সমাধানে গবেষণার বিকল্প নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করতে হলে গবেষণা ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বাজেট একটু বাড়াতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য ১০০ কোটি টাকা বাজেট ভবিষ্যতে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে । ভাঙন মোকাবেলায় বাজেটও প্রয়োজন ছিল।
এবারের বাজেটে নতুন করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির সুযোগ থাকছে। পৌরসভার জমি কেনা বেচায় ক্রেতা বিক্রেতার কর শনাক্ত করণ নম্বর থাকতে হবে। বিড়ি, সিগারেট, জর্দা, চিনি, তেলের দাম বাড়বে। তবে চিনি ও তেলের দাম না বাড়ানো উচিত ছিল। এতে মধ্যবিত্ত শ্রেণী উপকৃত হতো।
রেলে মহাপরিকল্পনা থাকছে, হাইটেক পার্কে বিনিয়োগ করলে আছে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ। গাড়ি নিবন্ধনে ব্যয় বাড়বে, মোটরসাইকেলের টায়ারের দাম বাড়বে, শেয়ার বাজারে প্রণোদনা থাকছে।
মুঠোফোনের উপকরণের দাম কমলেও ব্যাপক হারে বাড়ছে স্মার্টফোনের দাম। স্মার্টফোন আমদানিতে শুল্ক ১০% থেকে বাড়িতে ২৫% করা হয়েছে। ফোনে কথা বলার খরচও আগের তুলনায় বাড়বে, মুঠোফোন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ৫% বাড়ানো হয়েছে।
সঞ্চয় পত্রের উৎসেও কর আরোপ করা হয়েছে। ব্রান্ডের দোকানে কেনাকাটায় বাড়তি খরচ বাড়বে, এখানে ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে। পুনরায় সার্বজনীন পেনশনের আশ্বাস দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
জাতীয় বাজেট ২০১৯-২০ একটি গতানুগতিক বাজেট হয়েছে। মেগা প্রকল্প বা বড় ধরনের সংস্কার ধরতে গেলে কিছু নেই। নতুন অর্থমন্ত্রী হিসেবে নতুন বাজেটে নতুন কোনো চমকও নেই। রাজস্ব আদায়ে যে পরিমাণ ঘাটতি থাকে তাতে এই বাজেট বাস্তবায়ন করা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে পারে। লক্ষ্য মত রাজস্ব আদায় করা গেলে বাজেট বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হবে বলে মনে হয় না। তবে বিদেশি ঋণের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে, যত কম বিদেশি ঋণ নেওয়া যায় ততই দেশের জন্য কল্যাণকর হবে।

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট