চট্টগ্রাম বৃহষ্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

অপ্রতিরোধ্য কিশোর গ্যাং : অনুব্রত প্রতিকার প্রসঙ্গে

ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী

২১ জানুয়ারি, ২০২১ | ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ

নিবন্ধের সূচনায় বিশ্বকবি রবিঠাকুরের ‘মোহের আশঙ্কা’ কবিতাটি উপস্থাপন করতে চাই- ‘শিশু পুষ্প আঁখি মেলি হেরিল এ ধরা-/ শ্যামল, সুন্দর, স্নিগ্ধ, গীতগন্ধ-ভরা;/ বিশ্বজগতেরে ডাকি কহিল, হে প্রিয়,/ আমি যতকাল থাকি তুমিও থাকিয়ো ॥’

কী অসাধারণ আবেগে শিশু-পুষ্পের আবরণে জীবনের নান্দীপাঠ উচ্চকিত হয়েছে উল্লেখ্য পংক্তিসমূহে। পূত-পবিত্র, নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ বোধের গভীরে প্রোথিত সত্য-সুন্দর-আনন্দ-প্রীতির নিগূঢ় বন্ধনের অবগাহনে বেড়ে ওঠা মানুষের বাল্যজীবন। সময়ের সাথে সুষম প্রতিযোগিতায় নির্মিত হয় শৈশব-কৈশোর-তারুণ্য-প্রৌঢ়-বার্ধক্যের ইতিবৃত্ত। ‘ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে’ প্রচলিত প্রবাদে অঙ্কিত হয় প্রতিটি শিশুর প্রোজ্জ্বল ভবিষ্যৎ। প্রাণপ্রিয় পিতা-মাতার মতোই প্রকৃত মনুষ্যত্ব-মানবিকতা ধারণ করে রচিত হয় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের যাত্রার অনন্তকাল।

বিশ্বখ্যাত দার্শনিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড মন: সমীক্ষণ অনুধ্যানে মানব মনের তিনটি স্তর বা সজ্ঞান, অর্ধ-সজ্ঞান ও নির্জ্ঞান স্তরের ব্যাখ্যায় বলেছেন, সজ্ঞান বা চেতন স্তরে ব্যক্তি মানুষ চিন্তা-ভাবনা ও ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে পরিপূর্ণ সচেতন থাকে। এই স্তরে নিরন্তর কর্মশীল থাকে অন্তরের অগোচরে অবদমিত কামনা-বাসনা ও ইচ্ছার অফুরন্ত নির্যাস। দ্বিতীয় অর্ধজ্ঞান বা অবচেতন স্তরে নানা ঘটনা, চিন্তা-চেতনা ইত্যাদি কারণে-আকারণে সাময়িক বিস্মৃত হলেও সুকৌশল অবলম্বনে তা মনের সজ্ঞান স্তরে ফিরিয়ে আনা যায়। তৃতীয় স্তরের ক্ষেত্রে প্রেষণা ও নানামুখী প্রেরণা সম্পর্কে মানব হৃদয় সজাগ থাকেনা এবং লুকায়িত ইচ্ছা-আগ্রহ-স্মরণ পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় না। মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড ব্যক্তিত্ব কাঠামোর উন্নয়নে কিছু মৌল উপাদান, অহম এবং অধিসত্ত্বার বিশ্লেষণে মানুষের সহজাত জৈবিক প্রবৃত্তির বহি:প্রকাশ উল্লেখ করেছেন। আদিম সত্ত্বার সাথে পরিবেশের দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় জন্ম নেয়া বিবেক বা বাস্তবতাবোধ, আদর্শবোধ তথা শুভ-অশুভ, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা, সুন্দর-অসুন্দরের বিভাজিত যুক্তি-জ্ঞান প্রচলিত মূল্যবোধ ও অনুসৃত পরিশুদ্ধ বিবেকের সমন্বয় ঘটিয়ে থাকে।

সমাজের সদস্য হিসেবে মানুষ সামাজিক মূল্যবোধ শুধু লালন-পালন করে না; প্রকৃষ্ট পরিচর্যায় বিপরীতপন্থী কর্মযজ্ঞে স্বকীয় সত্ত্বাকে বিলীন করতেও চায় না। এই স্বাভাবিক ও সাবলীল সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াকে অবজ্ঞা করা হলেই বিচ্যুত আচরণের মনোবৃত্তি বৈপরিত্য সচলতায় সমাজকে কলুষিত করে তোলে। দেশবাসী সম্যক অবগত আছেন যে, সাম্প্রতিক সময়ে করোনা অতিমারির চেয়েও ভয়াবহ নতুন বিপর্যয়ের বিপদসঙ্কুল প্রত্যয় হচ্ছে ‘কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং উপ-সংস্কৃতি’। দেশের নগর-শহর-জেলা-উপজেলাসহ প্রত্যন্ত প্রান্তিক অঞ্চলে এই উপ-সংস্কৃতির বিকাশ ও বিস্তার ইতিমধ্যে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদন, গবেষণার ফলাফল ও জনশ্রুতি অনুসারে পারিবারিক-সামাজিক-ধর্মীয় অনুশাসনের অপচর্চা, অপরাজনীতির কদর্য প্রভাব বা আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টা, অনৈতিক-অবৈধ পন্থায় বিভিন্ন দল-প্রতিষ্ঠানে নরপশুতুল্য অর্থ ও ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তিদের পদ-পদায়ন, জঙ্গী-সন্ত্রাসী-মাদকসেবী-দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিকের কুৎসিত প্রভাবে কিশোর গ্যাং উপ-সংস্কৃতির প্রসারমানতা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে।

দরিদ্রতা-শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মবঞ্চিত-নিপীড়িত-নিগৃহীত ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-সম্প্রদায়-বস্তিবাসীসহ নিম্ন-উচ্চবিত্তের সন্তানদের অনেকেই অবলীলায় এই উপ-সংস্কৃতির শিকারে পরিণত হচ্ছে। একদিকে রাতারাতি বা স্বল্প সময়ের মধ্যেই অনৈতিক প্রাচুর্যের উর্ধ্বগতি, অন্যদিকে প্রত্যাশার তুলনায় প্রাপ্তির ব্যাপক দূরত্বের সাংঘর্ষিক মিথস্ক্রিয়া এই অপসংস্কৃতিকে প্রগাঢ় গতিশীল করছে। সর্বোচ্চ উচ্চশিক্ষা থেকে শুরু করে নিম্নতম পর্যায়ের শিক্ষা-সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে মেধাশূন্য অযোগ্য-অপদার্থ ব্যক্তিদের নিকৃষ্ট-জঘন্য অপকৌশল অবলম্বনে লবিং-তদবির-কথিত সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে পদ-পদবি-পদক দখলের ঘৃণ্য দৃশ্যাদৃশ্যে কোমলমতি কিশোর-তরুণদের অধিকাংশই হতাশার গহ্বরে নিপতিত হচ্ছে। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টিতে এসব অবুঝ, অনেকটা নির্বোধ শিশু-কিশোরদের ব্যবহারে ব্যতিব্যস্ত কথিত ‘বড় ভাই’ নামধারীরা কোন না কোনভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতা অর্জনে সক্ষম হচ্ছে। এদের ধনসম্পদ ও বিত্ত-বৈভবের জঘন্য উড্ডীন প্রক্রিয়ায় কিশোরদের অসহায় অবলোকন ও প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ যারপরনাই নেতিবাচক উন্মত্ততায় আচ্ছাদিত।

জাতিসংঘের অন্যতম সহযোগী সংস্থা ইউনিসেফ’র মতে, বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। কিশোর অপরাধের প্রাপ্ত পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১২ সালে ৪৮৪ টি মামলায় ৭৫১ জন শিশু-কিশোর আসামি ছিল। ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে ৮ শত ২১ টি মামলায় গ্রেফতারের সংখ্যা ১ হাজার ১৯১ জন। ২০১৭ সালে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে ঢাকা ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে ১২ টি সক্রিয় কিশোর গ্যাংয়ের ৮ টির সঙ্গেই রাজনৈতিক নেতাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনে সারাদেশে আরও কমপক্ষে ৩৫ টি কিশোর গ্যাংয়ের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। ১৯৬০ সালে কিশোর অপরাধ বিষয়ক প্রথম গবেষণা প্রকল্পের ধারাবাহিকতায় অদ্যাবধি সম্পাদিত গবেষণার সংখ্যা প্রায় ৭০ টি। পাকিস্তান আমলে এই ধরনের অপরাধের শীর্ষে ছিল চুরি ও পকেটমারি। পরবর্তীতে অপরাধের বহুমাত্রিকতা মাদক-খুন-ধর্ষণ-চাঁদাবাজি-মারামারি-আক্রোশ-ক্রোধ-প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ পরায়ণতা-আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হেনস্তা বা স্তব্ধ করার বর্বরতায় আবির্ভূত।

২ জানুয়ারি ২০২১ গণমাধ্যম প্রতিবেদনে সুস্পষ্ট হয়েছে যে, বিগত দুই বছরে ৩৪ জনসহ ১৭ বছরে ঢাকায় কিশোর অপরাধীদের হাতে খুন হয়েছে ১২০ জন। বিভিন্ন বিনোদন মাধ্যম-সামাজিক যোগাযোগ-ফেসবুক ও প্রযুক্তির অপব্যবহারে কিশোর গ্যাং সদস্যরা স্ব স্ব এলাকায় ‘হিরোইজম’, সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেম ঘটিত সম্পর্ক-বিরোধ ইত্যাদি অসৎ কর্মে অতিমাত্রায় প্ররোচিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক আইন শৃঙ্খলা বাহিনী বিশেষ করে র‌্যাব’র প্রতিবেদনে ঢাকায় অর্ধশত কিশোর গ্যাং সক্রিয় বলে উল্লেখ করা হলেও বিভিন্ন সূত্রমতে এর সংখ্যা শতাধিক পেরিয়ে গেছে। র‌্যাবের সম্মানিত উচুমার্গের দক্ষ ও যোগ্য মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন কিশোর গ্যাং এর বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান ‘জিরো টলারেন্স’ দাবি করেছেন। এলাকাভিত্তিক কিশোর অপরাধীদের নাম-ঠিকানা-সংখ্যা ইত্যাদির হালনাগাদ তালিকা অনুযায়ী বড় ধরনের অভিযান পরিচালনার সংবাদে দেশের আপামর জনগণ চন্দ্রাতপ আশাজাগানিয়া প্রোৎসাহে উদ্বেলিত।

আমাদের হয়ত অনেকেরই জানা, বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এই অপসংস্কৃতির উৎসমূলে রয়েছে উনবিংশ শতাব্দীর দ্রুত সামাজিক পরিবর্তন ও বিপুল জনসংখ্যা বৃদ্ধি। সাধারণত নানামুখী জীবন নির্বাহের ধরণ, কর্মসংস্থান, অপরিকল্পিত নগরায়ন-শিল্পায়নের ফলে সক্রিয় হয় গ্রাম থেকে শহরমুখী গণ-স্থানান্তর, চরম বৈষম্যের ব্যাপ্তির নরোত্তম প্রসারণ। বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি, দ্রুততর সময়ের মধ্যে ক্ষমতা-অর্থ সম্পদ-বিত্তশালী হওয়ার প্রলোভন ও জীবন প্রবৃত্তিরই বিপরীত-নেতিবাচক বীভৎস তাড়না সভ্যতার সুস্থ ও মঙ্গলময় বিকিরণে অপশক্তিমান হয়েছে নানা অবাঞ্চিত প্রতিবন্ধকতা এবং অন্তরায়। এ কারণেই উন্নত বিশ্বের প্রায় প্রত্যেক নগরেই ১৮৭০ সালে স্থায়ী পুলিশ বিভাগ স্থাপিত হয়। বিংশ শতাব্দীর প্রাথমিক পর্যায়ে কিশোর অপরাধ বিকাশ প্রতিরোধে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য পুলিশ বিভাগে বিশেষায়িত শাখা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ সময় মহিলা অফিসারদেরকে এসব কর্মকা- তদারকির ভার দেওয়া হয়।

১৯২৪ সালে প্রায় বৃহৎ নগরসমূহে ‘কিশোর ব্যুরো’ স্থাপিত হয়। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট ও সংশ্লিষ্ট প্রচণ্ড বিধ্বস্ত অর্থনীতি এই কিশোর অপরাধকে গ্যাং ভিত্তিক উপ-সংস্কৃতিতে পরিণত করে। আমরা হয়ত এও জানি যে, উনিশ শতকের মাঝামাঝি যুক্তরাজ্যে কিশোর গ্যাংগুলো ভয়ানক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। ১৮৯০ সালের দিকে কিছু প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিবর্গ এদের  কর্মকান্ডে অতিষ্ঠ জনগণের সুরক্ষায় উদ্ভাবনী এক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তারই ফলে সৃষ্ট বিশ্বখ্যাত ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ও ম্যানচেস্টার সিটি ক্লাবের প্রতিষ্ঠা এবং সন্ত্রাসী তরুণদের খেলা ও মননশীল বিনোদনের দিকে মনোযোগ আকর্ষণ করার লক্ষ্যে ফুটবল খেলা অধিকতর স্বল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠে। উল্লেখিত এই ক্লাব দুটির মাধ্যমে কিশোর-তরুণদের বিকৃত মনোভাবকে পাল্টে দিয়ে সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে প্রচন্ডভাবে  উৎসাহিত করা হয়।

২০১৮ সালের ৬ জানুয়ারি বাংলাদেশে উত্তরা ট্রাস্ট স্কুল এ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনানের নৃশংস হত্যাকা-ের জন্য দায়ী ‘নাইন স্টার’ ও ‘ডিসকো বয়েজ’র সংঘাতের বিষয়টি বাংলাদেশের জনগণের বিস্মৃত হওয়ার কথা নয়। এসব অপরাধী সংগঠনের সাথে কালক্রমে যুক্ত হয়েছে ‘বিগবস’, ‘কাশ্মীরি গ্রুপ’, ‘টিকটক অ্যাপ’, ‘ফার্স্ট হিটার বস’, ‘এফবিএএইচ’,‘মোল্লা রাব্বি’, ‘স্টার বন্ড’  নামের বিভিন্ন কিশোর গ্যাং। অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন গ্রুপে রয়েছে ভিন্ন পোষাক পরিচ্ছদ, চুল কাটার ধরণ ও রংয়ের ভিন্নমুখী ব্যবহার। বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিত পর্যালোচনায় দেখা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধোত্তর ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাবে ক্রমবর্ধমান অসমতা ও বৈষম্য সমাজে ব্যাপক নৈরাজ্য সৃষ্টি করে। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৫ সাল থেকে বিপুল সংখ্যক কিশোর অপরাধী এবং গ্যাং’র উত্থান ঘটে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অধিকতর অর্থ ও সুযোগ সুবিধা সহজে প্রাপ্তির কারণে কিশোররা বেপরোয়াভাবে তাদের স্বাধীন সত্ত্বার অপব্যবহারে লিপ্ত হয়।

সম্ভবত ‘টেডস’ যুদ্ধোত্তর বিশ্বে প্রথম উপ-সংস্কৃতি। পরবর্তীতে ‘রক এন রোল’ জাতীয় বহুমাত্রিক কদাচার কিশোর গ্যাং উপ-সংস্কৃতির অশুভ অগ্রসরমানতাকে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিশোরদের অধিকার যথার্থ সংজ্ঞায়িত করে এসব নষ্টামি থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক আইন-কনভেনশন-গাইডলাইন তৈরি করে। ১৯৮৯ সালে ‘শিশু অধিকার সনদ (সিআরসি)’ প্রণয়ন ও ‘আর্টিকেল ২’র ব্যাখ্যায় ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-ভাষা-জাতীয়তা-রাজনৈতিক মতামত, নৃজাতিক-সামাজিক পরিচিতি, সম্পদ, প্রতিবন্ধী, জন্ম এবং অন্যান্য সকল মর্যাদার বিষয়টি আমলে নিয়ে কিশোর-তরুণ ও পিতামাতা-অভিভাবকদের দায়িত্ব-কর্তব্য-অধিকার বর্ণিত হয়েছে। মুক্তির মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর ১৯৭৪ সালে প্রণীত শিশু-কিশোরদের জন্য জাতীয় শিশু আইন আধুনিক ও যুগোপযোগী ২০১৩ সালে নতুন শিশু আইনে পরিণত হয়।

এছাড়াও শিশু-কিশোরদের কেন্দ্র করে প্রণীত নীতিমালার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ১৯৯৪ সাল, ২০১৩ সালে জাতীয় শিশুনীতি ও ২০১০ সালে জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি। ২০১৬-১৭ অর্থ বছর থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য ৭ টি মন্ত্রণালয় আলাদা বাজেট প্রণয়ন করে। বর্তমানে এই তালিকায় মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা ১৫। ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও ক্রীড়ার ক্ষেত্রে বাজেটে বড় অংশের অন্তর্ভুক্তিতে মন্ত্রণালয় গুলোর জন্য বরাদ্দ ছিল ৬৫ হাজর ৬৫০ কোটি টাকা যা পরবর্তী বছরে গিয়ে দাঁড়ায় ৮০ হাজার ১৯০ কোটি টাকায়। সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের মনন ও সৃজনশীল কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধা ও প্রতিভা বিকাশে শিশু একাডেমি-বাংলাদেশ স্কাউটস, গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিকস-প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদি আয়োজনে সঙ্গীত-চিত্রাঙ্কন-আবৃতি-লেখালেখি-নাটক ইত্যাদিরও প্রয়োগিক অনুশীলন অব্যাহত রয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সকল ক্ষেত্রে এসব প্রগতিসমৃদ্ধ ক্রিয়াশীল কর্মোদ্যাগ গ্রহণ শিশু-কিশোরদের অপরাধ-নষ্টামি পরিহারে অবশ্যই সহায়ক হবে।

ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের বড়মাপের প্রায় নগর ও শহরে দ্রুত সংগঠিত হওয়া এসব কিশোর গ্যাং সদস্যদের অপরাধ প্রবৃত্তিকে নিধনের জন্য র‌্যাবের নেতৃত্বে সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বিত আইনি ব্যবস্থার কঠোর প্রয়োগ অপরিহার্য। আবশ্যক মনোযোগ হবে যাতে অপরাধীরা জামিনে বেরিয়ে এসে অধিকতর বেপরোয়া ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে না পারে। বিভিন্ন সংশোধনাগার, সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগ, পরিবার-সমাজ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সকলের শিশু-কিশোরদের দৈহিক ও মানসিক পরিবর্তনে উপযোগী আচরণগত উন্নয়ন প্রশিক্ষণ অবশ্যম্ভাবী। বস্তু-সত্যনিষ্ঠ মূল্যায়নে গভীর অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গি এই ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতকল্পে যথার্থ অর্থে কার্যকর উদ্যোগ হবে। কিশোর অপরাধ নির্ধারণে কোন নির্দিষ্ট শ্রেণি-পেশাকে বিবেচনায় না এনে সামষ্টিক আর্থ-সামাজিক উন্নত ভবিষ্যত রচনায় শিশু-কিশোরদের সম্মুখে ‘জাতীয় আদর্শ’র উম্মোচন একান্তই জরুরী। দেশপ্রেমিক-সৎ-যোগ্য-মেধাবী-নীতি নৈতিকতায় ঋদ্ধ-ত্যাগী ব্যক্তিত্ব-পেশাজীবী-রাজনীতিকদের সমৃদ্ধ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নতুন উপমার প্রত্যাশিত বিষয়বস্তু তৈরি করার মধ্যেই অপরাধ প্রবণতা সংহারে প্রযোজ্য উপকরণ হবে। পাঠ্যবই-অন্যান্য বিষয়ে রচিত পুস্তকসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ করার গৃহীত সকল প্রচেষ্টাই হবে অনুব্রত প্রতিকারের প্রতিচ্ছবি এবং এটি ভয়ংকর উপ-সংস্কৃতি নিধনে দৃশ্যমান হবেই- নি:সন্দেহে তা বলা যায়।

লেখক: ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী শিক্ষাবিদ, সমাজ-অপরাধবিজ্ঞানী; সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্বকোণ/এএ

শেয়ার করুন

সম্পর্কিত পোস্ট